Tuesday 26 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শিক্ষার্থী মূল্যায়ন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় শিক্ষকের দৃষ্টিভঙ্গি

ড. কে এম আতিকুর রহমান
৩০ জুন ২০২৩ ১৯:০৮

‘যাদের রোল নম্বর আগের দিকে তাদের পরীক্ষার খাতায় আমরা সাধারণত একটু বেশী নম্বর দিয়ে থাকি। কারণ তারা ভাল ছাত্র। তাছাড়া পরীক্ষার হলে তাদের খাতা অন্যরা দেখাদেখি করে লিখে; তাই পেছনের রোলধারী শিক্ষার্থীদের নম্বর আমরা কমিয়ে দিয়ে থাকি।’ নবম শ্রেণিতে পাঠদানকারী একজন শিক্ষকের এই উক্তিটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এটা হচ্ছে বাংলাদেশের শিক্ষার্থী মূল্যায়নের একটি অন্যতম অবিচারপ্রসূত মূল্যায়ন পদ্ধতি। এতে অনেক ক্ষেত্রেই পিছনের কোন ভাল শিক্ষার্থীর সামনে উঠে আসার পথ অনেকটা বন্ধ হয়ে যায়। এইভাবে সামনের সারির শিক্ষার্থী সামনে, আর পিছনের সারির জন পেছনে পরে স্বপ্নহীন মানুষে পরিণত হতে থাকে। হয়তো ব্যতিক্রমও আছে, তবে তা নগণ্য। একজন শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ জীবন অনেকটাই নির্ভর করে, শিক্ষক কিভাবে একজন শিক্ষার্থীর আচরণ ও একাডেমিক পারফরম্যান্স মূল্যায়ন করলো তার উপর। পরিবার ও বিদ্যালয়েই সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার যাত্রা শুরু হয়। যেখানে মা-বাবা ও শিক্ষক রোল মডেল হিসেবে কাজ করে। তাই সামাজিক ন্যায়বিচারহীনতার জন্য শিক্ষক ও পরিবার উভয়ই দায়ী।

বিজ্ঞাপন

বহুল প্রচলিত একটা কথা এই যে, প্রাইভেট যারা পড়ে শিক্ষক তাকে বেশী নম্বর দেয়। এটা এখন আর প্রচলিত নয়; অনেকটা প্রমাণিত ইস্যু। শুধু নম্বর বাড়িয়ে দিয়েও তারা ক্ষান্ত থাকেন না, ঐ প্রাইভেট টিউটর পরীক্ষার সময় তাকে প্রশ্ন পর্যন্ত ফাঁস করে দেন। ফলে প্রাইভেট পড়ে না এমন শিক্ষার্থীদের জায়গা হয় ‘পিছনের সারিতে’। বঞ্চিত শিক্ষার্থী মুখ বুঝে এই অনিয়ম সহ্য করলেও তার মনস্তত্ত্বের বিরাট ক্ষতিসাধন হয়। কখনো কখনো তারা পড়ালেখাই বাদ দিতে বাধ্য হয়। তাদের জন্য নির্ধারিত হয় ক্ষেত-খামার, কলকারখানায় শিশু শ্রমিক হিসেবে অথবা বাল্য বিবাহের মাধ্যমে ‘শিশু বধূ’ হিসেবে বেঁচে থাকার জায়গা। অভিভাবকগণ হয়তো কোনদিন জানতেই পারে না যে, তার সন্তান অবিচার বা বৈষম্যের শিকার হয়ে বিদ্যালয় বা কলেজ হতে ঝড়ে পড়েছে। ব্যবহারিক পরীক্ষার নম্বরও অনেক ক্ষেত্রে নির্ধারিত হয় প্রাইভেট-কোচিং বা শিক্ষকের সঙ্গে ভাল পরিচিতির সূত্র ধরে। প্রভাবশালী মা-বাবার সন্তানরা সকল ক্ষেত্রে নম্বর বা প্রিভিলেইজ বেশী পেয়ে থাকে। মা-বাবা সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের প্রভাবিত করেন, নিজের টাকা-পয়সা ও পদ-পদবি ব্যবহার করে। শ্রেণিকক্ষ, পরীক্ষার হল, এমনকি পরীক্ষার উত্তরপত্রে তারা এই অনৈতিক সুবিধা পেয়ে থাকে। আপাতত ঐ শিক্ষার্থী হয়তো ভাল গ্রেড পেয়ে পাশ করছে; কিন্তু ভর্তি পরীক্ষা, চাকরির প্রতিযোগিতায় তারা কিন্তু টিকছে না। দুর্ভাগ্য, ওই খানেও তারা প্রভাব খাটিয়ে, স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে নিজেদের জায়গা করে নিচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

ন্যায়বিচার বঞ্চনা তাই শুরু হয় পরিবারের মা-বাবার হাত ধরে। শিক্ষকরা এই অবিচারকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান করেন। বঞ্চিত বা অবিচারের শিকার শিক্ষার্থী এগুলো দেখে দেখে শিখে। পরবর্তী জীবনে তারাও একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। কারণ তারা মনে করে এটাই নিয়ম অথবা এই অবিচার জিইয়ে না রাখলে আমি সমাজে টিকতে পারবো না বা উপর তলায় উঠতে পারবো না। সুতরাং, এই বিচারহীনতার প্রবণতা চক্রাকারে ঘুরপাক খেয়ে সমাজকে মাকাল ফল বানিয়ে ফেলছে। সুতরাং ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি’ আদালতে নয়; এটা শুরু হয় পরিবার ও শিক্ষালয়ে। পশ্চাদপদ পরিবার হতে আগত শিক্ষার্থী ‘বেক বেঞ্চার’ হতে হতে এক সময় বিদ্যা শিক্ষা হতে ঝড়ে পড়ে। ব্যক্তিজীবনে তারা হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে এক সময়ে মনে করে আমার কোন যোগ্যতা নেই, আমি পারবো না। কারণ শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক তাদেরকে ‘বিশেষ নজর’ দেওয়া দূরে থাকুক, তারা সর্বদা লাঞ্চনার শিকার হয়। যদিও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত এত বেশী যে, শিক্ষক ইচ্ছা থাকার পরও অনেক সময় পশ্চাদপদ শিক্ষার্থীকে সমান দৃষ্টিতে দেখা বা বিশেষ নজর দিতে পারে না। শিক্ষায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য একজন শিক্ষকের জন্য সর্বোচ্চ ৭০ জন শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষে পড়ানোর ব্যবস্থা করা নীতি নির্ধারক ও প্রশাসনের একটা বড় দায়িত্ব। কোন কলেজে শিক্ষার্থী নেই; আবার কিছু প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত ভিড়। এগুলো ‘রেশনিং করা’ সময়ের দাবী।

শিক্ষার্থী শিক্ষকের সঙ্গে তর্কে লিপ্ত হলে বা বেশী বেশী প্রশ্ন করলে পরীক্ষার খাতায় তার গ্রেড বা নম্বর অনেক ক্ষেত্রেই কমে যায়। যেমন: স্নাতক পর্যায়ের ‘ইনকোর্স নম্বর দেওয়া’ ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে কোন শিক্ষার্থী বঞ্চনা বা অবিচারের শিকার হলে সমাজে কিভাবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে? হ্যাঁ, তবে একাডেমিক বিধি-বিধান না মানার ক্ষেত্রে ‘গ্রেড যোক্তিক পর্যায়ে’ কমিয়ে দিলে বরং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হয়। যে প্রাপ্য নয়, সে বেশী গ্রেড বা নম্বর পেলে সমাজে অহংকারসূচক দুর্বিচার প্রতিষ্ঠিত হতে বাধ্য। অর্থাৎ যার যা প্রাপ্য, তাকে তাই দেওয়াটাই শিক্ষকের মহান দায়িত্ব। অন্যথায় জীবনের মসৃনতা হোঁচট খায়।

শ্রেণিকক্ষে আচরণের অথবা পারফরমেন্সের স্বীকৃতি দেওয়াটাও ন্যায়বিচার। দুর্বল বা পশ্চাদপদ পরিবারের সন্তানদের স্বীকৃতি দিলে তারা বেশী খুশি হয়। তারা বেশী অনুপ্রাণিত হয়। অন্যদিকে তারা স্বীকৃতি বা শিক্ষকের নিকট হতে পুরস্কার না পেলে তারা হীনমান্যতায় ভোগে। তাদের এই ধারণা হয় ‘আমরা পশ্চাদপদ বা দুর্বল ছাত্র বলে স্যার আমাদের অবহেলা করে’। এই ধারণার সৃষ্টি হলে ন্যায়বিচারের পরিবেশ আছে তা পুরোপুরি বলা যায় না। মনে করা হয় ‘সুবিধাভোগী শিক্ষার্থীরাই শিক্ষকের অনুকম্পা পাচ্ছে’। সকল ব্যাকগ্রাউন্ডের ছেলে-মেয়েদের সমান দৃষ্টিতে দেখতে পারলে ‘অন্তর্ভূক্তিমূলক শিক্ষা’ নিশ্চিত করাটা সহজ হয়।

অনেক শিক্ষার্থী শিক্ষকের নিকট যাওয়া, কথা বলা, শ্রেণিকক্ষে প্রশ্ন করার সাহস পায় না। এমন শিক্ষার্থী অধিকাংশ ক্ষেত্রে বঞ্চিত হয়। শিক্ষকের দায়িত্ব ঐ শিক্ষার্থীদের ‘মনস্তত্ত্ব’ বুঝে তাকে স্ব-প্রণোদিত হয়ে সেবা দেওয়া। এমনকি সবার জন্য পর্যাপ্ত তথ্য বা অন্যান্য সেবা নিশ্চিত করার জন্য স্যোশাল মিডিয়া, এসএমএস, ই-মেইল সেবা চালু করা যেতে পারে। এই কমন প্লাটফর্ম ব্যবহার করে সবাই সমান তথ্য, গাইডলাইন ও পরামর্শ সেবা পেতে পারে। অবলা ছেলে-মেয়েরা এতে বেশী উপকৃত হবে বলে মনে হয়। এটা শুধু ন্যায়বিচারই নয় বরং কল্যাণমূলক কাজ।

প্রত্যেক শিক্ষার্থীর সমস্যা, অসুবিধা আলাদা আলাদা বিশ্লেষণ করে ‘পাঠ পরিকল্পনা’ ও অন্যান্য সমাধানমূলক পন্থা অবলম্বন করা শিক্ষকের নৈতিক দায়িত্ব। এটাকে বলা যেতে যেতে পারে ‘স্বত প্রণোদনা ন্যায়বিচার’ যা শিক্ষার্থীদের বেশী সুবিধা প্রদান করে, যদিও কাজটা সহজসাধ্য নয় একজন শিক্ষকের জন্য। কারণ আমাদের সমাজে নানা সমস্যায় ক্লান্ত। বৈষয়কি স্বার্থ শিক্ষকের অবশ্যই থাকবে। কারণ সে একজন মানুষ। তবে বৈষয়িক স্বার্থটা লোভের পর্যায়ে গেলে ঐ শিক্ষকের পক্ষে শিক্ষার্থীর মাঝে সাম্য প্রতিষ্ঠা বা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হয়ে যায়। প্রশাসনিক বা করণিক সেবায়ও আর্থিক স্বচ্ছতার ঘাটতি যদি থাকে তাতেও একজন শিক্ষকের পক্ষে শ্রেণিকক্ষে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা দুরুহ ব্যাপার হয়ে দাড়াঁয়।

রশিদ ছাড়া বেশী টাকা নিয়ে কোন সেবা যেমন: সনদ, ট্রান্সক্রিপ্ট প্রদান শিক্ষার্থীদের মাঝে বেদনা তৈরি করে, যা প্রকারান্তরে শিক্ষকরাই বেশী ভুক্তভোগী হয়। কারণ শিক্ষার্থীরা তখন শিক্ষকদের মনে প্রাণে গ্রহণ করতে পারে না। শিক্ষকতা পেশাটা মহান, সংবেদনশীল ও আদর্শ। সম্ভব না হলেও শ্রেণিকক্ষে সবাইকে সমান দৃষ্টিতে দেখার, মূল্যায়ন করার আপ্রাণ চেষ্টা করার নামই শিক্ষকতা। ন্যায়বিচারের অভাবে একজন শিক্ষার্থী পথ হারাতে পারে; আবার ন্যায়বিচার বা সুদৃষ্টি পেলে একজন দুর্বল ছাত্রও পথ খুঁজে পেতে পারে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, গাছবাড়িয়া সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম

সারাবাংলা/এসবিডিই

ড. কে এম আতিকুর রহমান মুক্তমত শিক্ষার্থী মূল্যায়ন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় শিক্ষকের দৃষ্টিভঙ্গি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর