সাঁওতাল বিদ্রোহের সংগ্রামী ইতিহাস
৩০ জুন ২০২৩ ১৪:৪২
একশত আটষট্টি বছর আগে ‘জমি চাই মুক্তি চাই’ স্লোগানে বিদ্রোহ ঘোষণা করলেও আজও অধিকার ফিরে পায়নি সাঁওতাল জনগোষ্ঠী। নতুন নতুন শাসকের ক্ষমতার পরিবর্তনে ফলে সামাজিক শোষণ, বঞ্চনার শিকার হয়ে আসছে নতুন নতুন রূপে। কালের বিবর্তনে তারা ভিটে, মাটি ও ভাষা হারিয়েছে। সমাজের কুচক্রী মহলের বেদখল, সহিংসতা, মিথ্যা মামলা, জাল দলিল হয়রানি তাদের প্রতিনিয়ত ঠেলে দিচ্ছে ধ্বংসের দিকে।
ইতিহাস বিশ্লেষণের মাধ্যমে জানা যায়, দামিন-ই কোহ ছিল সাঁওতালদের নিজস্ব গ্রাম, নিজস্ব দেশ। বহু কষ্ট করে জঙ্গল কেটে বন সাফ করে তারা জনপদ গড়ে তুলেছিল। অতীতে যে মাটিতে মানুষের কোনো পা পড়েনি, সে মাটিকে তারা বাসযোগ্য করে গড়ে তুলেছিল। সে মাটিতে ধান, গম, ভুট্টা, নানা ধরণের সব্জি আর সোনালী ফসল চাষ করেছিল। সুখে ছিল তারা দামিন-ই কোহতে। সাঁওতালিরা নিজেদের আলাদা একটি সমাজ তৈরী করেছিল এবং তাদের সমাজ ব্যবস্থায় কোনো মহাজন, দালাল, জমিদার ছিলনা। এমন কি কেউ ঋণী ছিলনা।
সাঁওতালিদের সংগ্রামী জীবনের কথা লেখতে গিয়ে মনে পড়ে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা। সাম্যের কবি ও মানবতার কবি তাঁর ফরিয়াদ কবিতায় বলেছিলেন:
‘জনগণে যারা জোঁক সম শোষে তারে মহাজন কয়,
সন্তান সম পালে যারা জমি, তারা জমিদার নয়।
মাটিতে যাদের ঠেকে না চরণ,
মাটির মালিক তাঁহারাই হন-
যে যত ভন্ড ধড়িবাজ আজ সেই তত বলবান।
নিতি নব ছোরা গড়িয়া কসাই বলে জ্ঞান-বিজ্ঞান’।
ইংরেজ শাষকরা ব্যবসায়ী ও মহাজন সেজে দলে দলে আসতে শুরু করেছিল সাঁওতাল পরগনায়। মহাজন ও ব্যবসায়ী শ্রেণি সাঁওতাল পরগনায় ঢুকে বিপুল পরিমাণ ধান, সরিষা ও অন্যান্য তৈলবীজ গরুর গাড়ী বোঝাই করে নিয়ে যেত। বিনিময়ে সাঁওতালদের দেওয়া হতো সামান্য লবণ, টাকা-পয়সা, তামাক অথবা কাপড়। এখানে বিনিময়ের সময় চরমভাবে ঠকানো হতো সাঁওতালদের। কিছু অর্থ, কিছু চাল বা অন্য কোন দ্রব্য ঋণ দিয়ে সমস্ত জীবনের জন্য সাঁওতালদের ভাগ্য বিধাতা ও দন্ডমুন্ডের কর্তা হয়ে বসত মহাজনরা।
মৌসুম ফসল কাটার সময় হলেই মহাজনরা গরুর গাড়ী ও ঘোড়া নিয়ে সাঁওতাল পরগনায় আসত। বছরের খাজনা আদায়ে জন্য মহাজনরা একটি পাথরে সিঁদুর মাখিয়ে নিয়ে আসত এবং সাঁওতালদের বলত যে, এ পাথরের ওজন নির্ভূল। এ পাথরের সাহায্যে ওজন করে মহাজনরা সাঁওতালদের সমস্ত ফসল তুলে নিয়ে যেত। কিন্তু তারপরও আদিবাসীদের ঋণের বোঝা সামান্য হ্রাস পেত না। মহাজনদের ঋণের সুদের হার ছিল অতি উচ্চ।
একজন সাঁওতালকে তার ঋণের জন্য তার জমির ফসল, লাঙলের বলদ এমনকি নিজেকেও বলি দিতে হতো তার পরিবারের কাছ থেকে। আর সেই ঋণের দশগুণ পরিশোধ করলেও পূর্বে যেরুপ ছিল পরেও সেইরুপ ঋণ অবশিষ্ট থাকত।
ব্রিটিশদের অন্যায় অত্যাচার ও মহাজনদের হাত থেকে কিভাবে রক্ষা করা যায় এবং সাঁওতাল রাজ প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে দস্যুদের কাছ থেকে মুক্তি আসবে না।
তারা শুরু করেছিল মুক্তি সংগ্রামে জন্য সশস্ত্র বিদ্রোহ।সিধু, কানুর নেতৃত্বে প্রায় ৫০ জন সাঁওতাল যুবক অস্ত্র সজ্জিত হয়ে শিকারে যাওয়ার পথে দারোগা মহেশ দত্ত, ২ জন সিপাই ও কয়েকজন মহাজনের সামনে পড়ে। দারোগার সঙ্গে ২ টি দড়ি বোঝাই গাড়িও ছিল।
মূলত তারা সাঁওতালদের ঘোষণা ও সিদ্ধান্ত জানতে পেরেছে। দারোগার সঙ্গে তাদের বাক-বিতণ্ডার এক পর্যায়ে বিদ্রোহী সিধু, কানুর সশস্ত্রদল ঘটনাস্থলে দারোগা মহেশ এবং কানু মানিক রায় নামের মহাজনকে হত্যা করে। এ ঘটনার পর ভোগলপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে।
তীর-ধনুক ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল।ইংরেজ বাহিনীর হাতে ছিল বন্দুক ও কামান। তবুও ইংরেজরা পরাজয় মানতে বাধ্য হয়। সাঁওতাল বিদ্রোহের লেলিহান শিখা ব্রিটিশ সরকারের মসনদ কাঁপিয়ে দিয়েছিল। দীর্ঘ ১৭ মাস যুদ্ধের পর ১৮৫৬ সালের নভেম্বর মাসে যুদ্ধ শেষ হয় ও বিদ্রোহের পরিসমাপ্তি ঘটে।
বাংলাদেশে করোনাকালীন সময়ে লকডাউনে সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছি তখন দেখা গেছে তারা কতটা মানবেতর জীবনযাপন করে। তাদের পরিবারের অনেক সন্তান টাকার অভাবে শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। অভাব অনটনে বিপর্যস্ত, তার সঙ্গে এনজিও এবং মহাজনী ঋণের কিস্তি আদায়ের নামে নানা মুখী হয়রানি শিকার হচ্ছে। তাদের জীবন নিয়ে তারা শঙ্কিত। সাঁওতাল বিদ্রোহের পরও আজও বঞ্চিত।
তবে বৈষম্য সহ্য করার জাতি কি সাঁওতাল জাতি? সিধু- কানু শিখে গেছে লড়াই করে বাঁচতে হয়।
অত্যাচারিতদের বাহ্যত দুর্বল মনে হলেও কার্যত এরাই শক্তিশালী। কেননা এদের যে কেবল সংখ্যাধিক্যের শক্তি রয়েছে তা-ই নয়, এদের রয়েছে সততার অপরাজেয় শক্তি। অত্যাচারিতদের অপরিমেয় সেই শক্তির উদ্বোধন করে গেছেন সাঁওতাল বিদ্রোহের বীর সৈনিকরা। ১৬৮ বছর আগেই শোষিত নির্যাতিত ও অধিকার বঞ্চিত মানুষের ঘুম ভেঙে মুক্তির স্বপ্ন-সাহস দেখিয়েছেন, অধিকার-হারা মানবগোষ্ঠীকে অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আত্মবিশ্বাস যুগিয়েছেন, এবং শিখিয়েছেন দৃপ্ত উচ্চারণ।
সাঁওতাল বিদ্রোহ এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। সশস্ত্র গণসংগ্রাম। সাঁওতাল বিদ্রোহীদের সেদিনের দেশপ্রেমিক সংগ্রাম, আদর্শ ও অভূতপূর্ব আত্মত্যাগ পরবর্তীকালে ভারতবর্ষের জাতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেছিল। জুগিয়েছিল সাহস ও উদ্দীপনা। নতুন প্রজন্মের কাছে ইতিহাসের সংগ্রামের এক বড় অনুপ্রেরণার উৎস সাঁওতাল বিদ্রোহ।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
মুক্তমত রাশেদুজ্জামান রাশেদ সাঁওতাল বিদ্রোহের সংগ্রামী ইতিহাস