পথশিশুদের অধিকার ও শিক্ষা ভাবনা
১ জুলাই ২০২৩ ১৫:১৩
পথশিশুদের নিয়ে কবি সাখাওয়াত হোসেনের কবিতা_
‘আমরা পথশিশু জন্মপরিচয় নাই
জীবনভর হই পদপিষ্ট, কেউ বলে টোকাই
বুকে যন্ত্রনা নিয়ে চলি জীবনের অলিগলি
ভালবাসার ফুলকলি ছিঁড়ে নিভি আর জ্বলি
মনের কথা কলি কেউ শুনে না আমরা পথের ধুলি
কে বাবা, কে মা জানিনাতো কিছু
পথে হাঁটতে হাঁটতে হলাম পথশিশু।’
আমাদের দেশের শহরের রাস্তার পাশে অথবা রেল লাইনের পাশে ও বস্তিতে প্রতিনিয়ত বেড়ে উঠছে অসংখ্য মৌলিক অধিকার বঞ্চিত শিশুরা। রাতের শহরে রাস্তার পাশে হেঁটে গেলে প্রায়ই চোখে পড়ে অযত্নে অবহেলায় বেড়ে উঠা এমন অসংখ্য পথশিশুদের। অযত্নশীল অবস্থায় রাস্তার রেলিং এর পাশে শুয়ে আছে একেকজন। যাদেরকে পথশিশু বলে ডাকা হয় অথবা টুকাই। যারা রাস্তার পাশে অথবা নর্দমায় পড়ে থাকা বোতল, কাগজপত্র ইত্যাদি সংগ্রহ করে বিক্রি করে অথবা শ্রমিকের ন্যায় পরিশ্রম করে যাচ্ছে তাদের এই শৈশব বয়সে। অথচ যে বয়সে অন্য সকল বাচ্চাদের মতো তাদেরও শৈশবের সময় হওয়ার কথা ছিল রঙিন। বাকিদের মতো বাবা-মায়ের হাত ধরে পার্কে ঘুরে বেড়ানো, খেলাধুলা এবং স্কুলে থাকার কথা। তাদের কাছে বাস্তবটা তখন ভিন্ন ! তাদের নির্মম ভাগ্য ও নিষ্ঠুর পৃথিবী তাদের রেখে দিয়েছে এখানেই রাস্তার পাশে। স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে উঠা শিশুদের সাথে পথশিশুদের মধ্যে রয়েছে ব্যাপক ব্যাবধান। ভাবতেই ভেবাচেকা খাওয়ার কথা শিশুদেরও জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। যে বয়সে তাদের হাতে থাকার বই, খাতা; বিপরীতে তারা যখন বই পুস্তক আর খেলানা নিয়ে খেলার কথা তখন এইসব পথশিশুরা জীবিকা নির্বাহের জন্য রাস্তাঘাটে বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করে, তারা প্লাষ্টিক-বোতল সংগ্রহ করে, ফুল বিক্রি করে তাছাড়া অনেক ঝুকিপূর্ণ কাজে নিজেদের নিয়জিত করে ফেলে তখন। এই নিয়ে মনে হয় না আমাদের পাষন্ড সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের হৃদয়ে কখনো নাড়া দেয় বলে ! এই সব পথশিশুদের অধিকাংশরই বাবা-মা কেউ নেই অথবা জন্মের পরে বাবা-মায়ের পরিচয় আর খোঁজে পায় নি কিংবা বাবা-মা থেকেও যেন নেই ! পথশিশুরা নির্দিষ্ট পরিচয় বিহীন হলেও তারা কিন্তু এদেশের সম্পদ। তাদের মূল পরিচয় তারাও বাংলাদেশের সন্তান ও সম্পদ। আমাদের একটা কথা সবসময় মনে রাখা উচিত সম্পদের ভালো ব্যবহার করলে তা একদিন ভালো কাজেই আসে আর অপব্যবহার মন্দের দিকে ঝুঁকে নিঃস্ব করে। কেননা তারা এই বয়সে অভিভাবকের প্রকৃত গাইডের অভাবে ধাবিত হয় ভয়ংকর পথে। তাদের ভিতরে হানা দেয় মাদকের ভয়াবহ ছোবল! বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্যমতে, পথশিশুদের ৮৫ ভাগই কোনো না কোনোভাবে মাদক সেবন করে। এমতাবস্থায় এসব শিশুরা মাদক সংগ্রহের জন্য তখন চুরি, ছিনতাই সহ নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করতে বাধ্য হয় এইসব পথশিশুরা। এক পর্যায়ে তা অতিমাত্রায় ধারণ করতে করতে হয়ে উঠে সন্ত্রাসীর স্তরে। তারপর বড় হয়ে তাদের একেকজন হয় একেক এলাকার কুখ্যাত সন্ত্রাসী। তখন তাদের আচারে অতিষ্ঠ হয়ে তাদের প্রতি জন্মায় একরাশ ঘৃণা ও ভয়। অথচ তাদের এই ভয়ংকর পরিস্থিতির জন্য আমরাই দায়ী। দায়ী আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র। কেননা আমরা তাদেরকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে পারিনি, তাদের কোনো খোঁজ রাখিনি, তাদেরকে আলোর পথে আনতে চেষ্টা করিনি। আমরা কেন সময় মতো তাদের সু-পথে ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ? যেহুতু তারা অভিভাবকহীন সুতরাং এই সমাজ, এই রাষ্ট্র তাদের অভিভাবক। তাহলে কেন তাদের অধিকার নিয়ে আমাদের মাথাওয়ালাদের কোনো চিন্তাভাবনা অথবা সু-দৃষ্টি নেই। বর্তমানে বাংলাদেশে রাস্তার বেড়ে উঠা শিশুদের সংখ্যা নিয়ে সরকারি কোনো পরিসংখ্যান নেই। আর তাদের সংখ্যা কোয়ান্টিফাই করা প্রায় অসম্ভব কেননা প্রতিনিয়ত তাদের সংখ্যা বাড়ছে বছরে বছরে। যদিও ইউনিসেফের তথ্যমথে, বর্তমান বাংলাদেশ ১১ লাখ ৪৪ হাজার ৫৫৪ জন এর মতো পথশিশু রয়েছে । তবে ধারনা করা হয় পথশিশুদের মধ্যে এদের ৭৫% ই দেশের রাজধানী ঢাকা শহরে বসবাস করে ও বেড়ে উঠছে।বাংলাদেশে রাস্তার এসব শিশুদের জন্য কোনো নির্দিষ্ট বয়স নেই যারা ৬ থেকে ১২ বছর বয়সের তারা জীবিকার উদ্দেশ্যে সহজলভ্য হিসাবে ভিক্ষাবৃত্তির কাজ করে, আর যারা অন্য কাজ করেন তাদের বয়স ১৩ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে। এমনকি পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুরাও রাস্তায় ঘুরে ঘুরে ভিক্ষাবৃত্তি করে তাদের জীবন যাপনের উদ্দেশ্যে নেমে আসছে পথে। আর মেয়ে পথশিশুদের তথ্যে দেখা যায় বাংলাদেশের অধিকাংশ রাস্তার পথশিশু মেয়েরা ১০ বছর বয়সেই বিবাহিত জীবনে পারি দিতে হচ্ছে, তখন তাদের খুব কঠিন জীবনে কাটাতে হচ্ছে, আর পুরুষ শিশুদের পরিবারের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হচ্ছে। এছাড়া অল্প বয়সী এসব মেয়েরা অনেক সময় অপব্যবহারের শিকার হয়। তাদের দিয়ে যৌন কাজে লিপ্ত হতে বাধ্য করা হয় কিংবা রোজগার নেশার ও পেটের দায়ে এই পেশায় অগত্যা যেতে হতে হয় তাদের। অথচ এই অল্প বয়সী মেয়েদের যৌন শিক্ষা সম্পর্কে কোনো ধারনাই থাকেনা। ফলে অল্প বয়সেই এসব মেয়েরা যৌন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তারপর সু-চিকিৎসার অভাবে বিদায় নিচ্ছে নশ্বর পৃথিবী থেকে, পৃথিবীর নিষ্ঠুর নিয়মকে অভিশপ্ত করে।
এখন আসা যাক পথশিশুদের শিক্ষার অধিকার ও ভাবনা নিয়ে কিছু কথায়। লেখাটি লিখতে গিয়ে আমি পথশিশুদের নিয়ে কাজ করছে দেশের এমন কতগুলো সংগঠনের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করি। সংগঠন গুলো জানায় তারা চাইলেও পথশিশুদের সবাইকে খুব সহজে শিক্ষার ধারে কাছে আনা সম্ভব হচ্ছেনা। প্রথমেই তাদের আর্থিক ফান্ডের জটিলতা পড়তে হচ্ছে। তারপর দেখা যাচ্ছে ঐসকল ছেলে মেয়েরা ইতিমধ্যেই কুচক্র মহলের অপব্যবহারের শিকার হয়ে যাচ্ছে। তাদের যে কিশোর দল তৈরি হচ্ছে তাদেরও দলপতি রয়েছে। যারা আড়ালে তাদের পরিচালনা করে থাকে, শিশুদের দিয়ে অপরাধ করাচ্ছে, ভিক্ষাবৃত্তি করাচ্ছে, সেই ভিক্ষাবৃত্তি থেকে তারা শিশুদের থেকে চাঁদা আদায় করে থাকে। আবার রাজনৈতিক মিছিল, মিটিং ও বিশৃঙ্খলা, নাশকতামূলক কাছে তাদের অপব্যবহার করা হচ্ছে। ঐসকল কথিত অভিভাবকরাই মূলত চায় না তারা শিক্ষা গ্রহণে আসুক, তারাও ভালোভাবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হোক। তাদের দেওয়া আর্থিক প্রলোভন ও আদর্শ অভিভাবকের অভাবের কারণে তাদেরকে শিক্ষার দুয়ারে পৌঁছনো সম্ভব হচ্ছেনা। এর মূল নিমিত্তে অপরাধীদের সহজ টার্গেট এসব ছিন্নমূল বা পথশিশু। পেশাদার অপরাধীরা পথশিশুদের অপরাধমূলক কাজে নিয়জিত করে। মাদক ব্যাবসা চুরি ছিনতাই ইত্যাদি কাজে জড়িয়ে পড়ছে এমনকি নিজেরাও মাদকাসক্ত হয়ে যাচ্ছে এবং খুব সহজেই তারাও পেশাদার অপরাধীতে পরিনত হয়ে যাচ্ছে। নিজের জীবন পরিবর্তন করার জন্য যেই পরিবেশ দরকার আর যেই সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন তা তারা পাচ্ছে না। এছাড়াও বছরে অনেক শিশু বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে কুচক্রী মহলের স্বার্থের নিমিত্তে ৷ এছাড়া জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনিষ্টিটিউটের তথ্য মতে ঢাকার মাদকাসক্ত শিশুদের মধ্যে ৩০ শতাংশ ছেলে আর ১৭ শতাংশ মেয়ে। ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী ছেলে মেয়েরা মানসিক ও শারীরিক ঝুকির মধ্যে রয়েছে। এই শিশুদের বেশির ভাগ পথশিশু। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন শহরের অলিতে গলিতে ও রেল লাইনের পাশেও এমন অমানবিক ভাবে বেড়ে উঠছে পথশিশুরা। তারপর তারাও মনের দিক দিয়ে হয়ে উঠছে অমানবিক। অথচ তাদের মনে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে পাড়লে ফুলের মতো প্রস্ফুটিত হতো তারা আলোকিত হতো আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজ। সুতরাং এই বিষয়ে বাংলাদেশের মাননীয় সরকারের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ও পথশিশুদের নিয়ে কাজ এমন সংগঠনগুলোর পাশে থেকে তাদেরকে আর্থিক ফান্ডের সহযোগীতার মাধ্যমে পথশিশুদের শিক্ষার আলোয় পৌঁছনো সম্ভব। তাদের সঠিক গাইডের মাধ্যমে আনতে পারলেই অবহেলায় বড় হওয়া পথশিশুদের সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব। এভাবে জন্ম নেওয়া তাদের পাপ নয়, তবে তাদের সুযোগ্য আবাস্থল দিতে না পাড়া আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজের পাপ। তাই আসুন অবহেলিত এসব পথশিশুদের পাশে একটু মানবতা ও আলো নিয়ে দাড়াই। তাদের সুযোগ্য আবাসন ও শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে পারলে তারাই একদিন এই রাষ্ট্রকে সুন্দরভাবে পরিচালনা করতে সহযোগীতা করবে। পথশিশুদের অপরাধ প্রবনতা কমাতে আমাদের বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত। অপরাধের পথ থেকে ফেরাতে তাদেরকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে, তবে শিক্ষার আগে আবাসন ও খাওয়া দাওয়ার নিশ্চয়তা প্রধান করতে হবে। আর এই ধরনের উদ্যোগ আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজকেই নিতে হবে। সেচ্ছাসেবী সংগঠনের মাধ্যমে পথশিশুদের নিয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি মূলক ক্যাম্পিং করতে হবে। প্রশাসনের একার পক্ষে কখনই সমাজের সকল সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়। সুতরাং পথশিশুদের আবাসন,খাওয়া দাওয়া ও বস্ত্রের ব্যাবস্থা করতে সমাজের বিত্তবানদের সুনজর প্রয়োজন এবং সঠিক পরিকল্পনা প্রয়োজন। সুতরাং আসা যাক তাদের মৌলিক অধিকার নিয়ে। অনেক সময় দেখা যায় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্দোগে পথশিশুদের মাঝে খাবার বিতরণ করা হয়। তাছাড়া অনেকে ব্যাক্তিগত উদ্দোগেও পথশিশুদের পাশে দাঁড়ায়। এটা নিশ্চয়ই তাদের ভালো মনমানসিকতার পরিচয়। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মধ্যে অন্যতম ‘বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন’। প্রতি বছর ২রা অক্টোবর জাতীয় পথশিশু দিবস পালিত হয়। যার লক্ষ্য থাকে পথশিশুদের পুনঃনির্বাসন তথা তাদের জীবনমান উন্নত করার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা। তারপর ২০৩০ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়নের ১৭ টি লক্ষ্যমাত্রায় অর্জন করতে যাচ্ছে। এসব লক্ষ্যসমূহের অনেকগুলোই নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত পথশিশুদের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে। সুতরাং বলাই যাচ্ছে এই লক্ষ্যমাত্রা সম্ভব হবে তখনই যখন সকল শিশু তাদের ন্যায্য অধিকার পাবে। কেননা দেশের এই বিপুল সংখ্যক পথশিশু শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বস্ত্র ও পুষ্টিসহ নানা মৌলিক সুযোগ-সুভিধার ধরা ছোঁয়ার বাহিরে রয়েছে। তাদেরকে সুযোগ-সুবিধার থেকে বঞ্চিত রেখে দেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। এমতাবস্থায় পথশিশুদের পাশে এসে দাঁড়ানো সংগঠনের সংখ্যা বাড়াতে হবে যারা পথশিশুদের সুন্দর জীবন গঠনে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। পথশিশুদের সুন্দর জীবন নিশ্চয়তা দিতে সকল সচেতন মহলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। কেননা পথশিশুদেরও অধিকার আছে সুন্দর-স্বাভাবিক জীবন যাপন করার।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই