Thursday 28 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ইতিহাসের মহানায়ক কমরেড জ্যোতি বসু লাল সালাম

সৈয়দ আমিরুজ্জামান
৭ জুলাই ২০২৩ ১৫:৪৮

মার্কসবাদী কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক জীবন্ত কিংবদন্তী ও ইতিহাসের মহানায়ক কমরেড জ্যোতি বসুর ১০৯তম জন্মবার্ষিকী আজ। মহান এই নেতার জন্মদিনে তার প্রতি আমাদের বিনম্র শুদ্ধা ও অভিবাদন।

ব্রিটিশ ভারতের কলকাতায় ১৯১৪ সালের ৮ জুলাই তার জন্ম। ১৯৭৭ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত একটানা ২৩ বছর কমরেড জ্যোতি বসু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৬৪ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত ৪৪ বছর ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআইএম)-এর পলিটব্যুরোর সদস্য ছিলেন।

বিজ্ঞাপন

২০১০ সালের ১৭ জানুয়ারি ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির নেতা জীবন্ত কিংবদন্তী কমরেড জ্যোতি বসুর জীবনাবসানের খবর পেয়ে তখন আমাদের মনে হয়েছিল এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের পতন ঘটেছে। যে নক্ষত্রটি কয়েক দশক ধরে জ্বলজ্বল করে জ্বলছিল তা আর আলো দেবে না। সত্যি কি তাই! কথাটা বোধহয় আংশিক সত্য। যে আলো তিনি জ্বালিয়ে গেছেন তা বহুদিন পর্যন্ত ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনই শুধু নয়, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনকেও পথ দেখাবে। তবু এই মৃত্যু বড়ই বেদনাদায়ক। বাংলাদেশ হারিয়েছিলো এক অকৃত্রিম বন্ধুকে আর ভারতবাসী হারালো তাদের প্রিয় নেতাকে।

এক শিক্ষিত উচ্চবিত্ত পরিবারে তার জন্ম। তিনি লেখাপড়া করেছেন কলকাতার অভিজাত স্কুল ও কলেজে। ইংরেজী সাহিত্যে অনার্স নিয়ে বিএ পাশ করেছেন প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে। তখনো তিনি মার্কসবাদের সংস্পর্শে আসেননি। তার পরিবারের মধ্যে স্বদেশী ও বৃটিশ বিরোধী চেতনাবোধ ছিল, যা স্বাভাবিক কারণেই বালক ও তরুণ জ্যোতি বসুর মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল। তার পিতার সঙ্গে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সশস্ত্র জাতীয়তাবাদী অনুশীলন সমিতির সদস্যদের সঙ্গে তার পৈত্রিক পরিবারের যোগাযোগ ছিল। একবার কোলকাতায় সুভাষ চন্দ্র বসুর সভায় গিয়ে তিনি পুলিশের লাঠিচার্জে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছিলেন।

বিজ্ঞাপন

কলকাতার পড়াশোনা শেষে তিনি লন্ডন গিয়েছিলেন ব্যারিস্টারী পড়তে। বিলাত থেকে ব্যারিস্টার হয়ে তিনি দেশে ফিরে আসলেন, কিন্তু ব্যারিস্টারী করলেন না। তিনি হলেন কমিউনিস্ট পার্টির সার্বক্ষণিক কর্মী। বিলাতে থাকাকালীন তিনি ব্যারিস্টারী পাশ করার পাশাপাশি আরেকটি অনেক বড় অর্জন করেছিলেন। তা হলো মার্কসবাদে দীক্ষাগ্রহণ। গ্রেট বৃটেনের কমিউনিস্ট পার্টির হ্যারি পাল্টি, রজনীপাম দত্ত, বেন ব্রেডলি প্রমুখ তাকে সাহায্য করেছিলেন মার্কসবাদে শিক্ষিত হয়ে উঠতে। উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তান ব্যারিস্টার জ্যোতি বসু দেশে ফিরে আসলেন কমিউনিস্ট হয়ে। কমরেড মুজফফর আহমদ তাকে কমিউনিস্ট হিসাবে কাজ করার পথ দেখালেন। প্রথমে তিনি শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। রেলওয়ে শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নে কাজ শুরু করেন। কমরেড জ্যোতি বসুর আত্মজীবনীমূলক “জনগণের সঙ্গে” গ্রন্থটির প্রথম খন্ডের ভূমিকায় আরেক কমিউনিস্ট নেতা প্রয়াত কমরেড সরোজ মুখার্জি লিখেছিলেন, “তার (জ্যোতি বসুর) লেখাগুলির মধ্য দিয়ে বিশেষভাবে স্বচ্ছ হয়ে ফুটে উঠেছে, কীভাবে একজন ব্যারিস্টার ব্যক্তিগত জীবনে স্বাচ্ছন্দের কথা উপেক্ষা করে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মতৎপরতার সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। মার্কসবাদের জ্ঞান ও আদর্শের প্রতি নিষ্ঠা কত গভীর হলে একজন মধ্যবিত্ত ঘরের যুবক বাড়ি-ঘর-সংসার সম্পর্কে নিষ্পৃহ থেকে সবসময়ের জন্য কমিউনিস্ট কর্মী হিসাবে কাজ করতে পারেন তা জ্যোতি বসুর কর্মজীবনের কাহিনীর মধ্যে পরিস্ফুট। পার্টির নির্দেশ পালন করে কীভাবে ধীরে ধীরে নিজেকে শ্রমিক নেতা হিসাবে এবং পরবর্তী যুগে একজন জননেতা হিসাবে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন তা-ও তার লেখার মধ্যে পরিস্ফুট হয়েছে।”

কমিউনিস্ট হয়ে যাওয়া ব্যরিস্টার জ্যোতি বসু ট্রামে বাসে রাস্তায় পার্টির পত্রিকা বিক্রি করেছেন, রেলওয়ে শ্রমিকদের সংগঠিত করতে নানা জায়গায় ঘুরেছেন, শ্রমিক বস্তিতে থেকেছেন। এইভাবে তিনি নিজেকে শ্রেণীচ্যুত করেছিলেন। কমরেড জ্যোতি বসুর রাজনৈতিক জীবনকে কয়েকটি পর্বে ভাগ করা যায়। প্রথম পর্বে বৃটিশ আমলে শ্রমিক আন্দোলন। দ্বিতীয় পর্বে সংসদীয় রাজনীতিতে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন। এই পার্টি শুরু হয়েছিল ১৯৪৬ সাল থেকে। সংসদীয় সংগ্রামের পাশাপাশি তিনি রাস্তায় সংগ্রামও করেছেন। বিশেষ করে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে কংগ্রেস সরকার বিরোধী গণআন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন। এই সময় খাদ্য আন্দোলন খুবই ব্যাপক ও জঙ্গী রূপ নিয়েছিল যার পুরোভাগে যারা ছিলেন তাদের অন্যতম কমরেড জ্যোতি বসু।

তৃতীয় পর্বটি হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে একটি রাজ্য পরিচালনা করা। টানা ২৪ বছর ধরে বারবার নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। পরে বার্ধক্যের কারণে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বটি তুলে দেন তারই দলের কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টচার্য্যেের হাতে।

১৯৪৬ সালে রেলওয়ে শ্রমিক কর্মচারীদের জন্য নির্দিষ্ট নির্বাচনী এলাকা থেকে তিনি বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার এই বিজয়টি তখন বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছিল। কারণ তার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন কংগ্রেসের নেতা হুমায়ুন কবীর যার তখন ছিল ব্যাপক নাম ডাক। সেই তুলনায় জ্যোতি বসু তখনো স্বল্প পরিচিত। কমিউনিস্ট পার্টির কাজ ও জ্যোতি বসুর নিজস্ব গুণাবলীর কারণেই তিনি বিজয়ী হতে পেরেছিলেন। সেই নির্বাচনে বঙ্গীয় পরিষদে (তখন বাংলা বিভক্ত হয়নি, দুই বাংলা মিলে বৃটিশ ভারতে একটি প্রদেশ হিসাবে ছিল) আর দুইজন কমিউনিস্ট পার্টি থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন দার্জিলিং-এর চা শ্রমিক নেতা রতনলাল ব্রাক্ষণ এবং দিনাজপুরের কৃষক নেতা রূপ নারায়ণ রায়। বঙ্গীয় পরিষদে মাত্র তিনজন সদস্য নিয়েছিল কমিউনিস্টদের এক এই ছোট গ্রুপ, যার নেতা ছিলেন কমরেড জ্যোতি বসু। রেলশ্রমিক নেতা জ্যোতি বসু এই ছোট গ্রুপ নিয়েও সংসদীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। মনে রাখতে হবে যে, কমিনউনিস্টরা হলেন সর্বহারা বিপ্লবী। কিন্তু ভবিষ্যতের বিপ্লবের স্বার্থে প্রয়োজনে সংসদীয় সংগ্রামকেও যোগ্যতার সঙ্গে ব্যবহার করা হচ্ছে লেনিনীয় কৌশলের অন্যতম নীতি।

কমরেড জ্যোতি বসু সংসদীয় রাজনীতির মোহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েননি। সুখ সুবিধা ইত্যাদি তাকে গ্রাস করতে পারেনি। বরং শাসক শ্রেণীর চরিত্র উম্মোচিত করা এবং মেহনতী জনগণের স্বার্থের কথা তুলে ধরার কাজটি তিনি যোগ্যতার সঙ্গে করতে পেরেছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তী যুগে প্রথমদিকে ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনী ছিল এবং পার্টির উপর কংগ্রেসী সরকারের অত্যাচারও ছিল চরম। উপরন্ত গান্ধী, সুভাষ, নেহেরুর কংগ্রেস তখনো যথেষ্ঠ জনপ্রিয় ছিলেন। ১৯৫২ সালে স্বাধীন ভারতে প্রথম নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টি বঙ্গীয় পরিষদে (বিধানসভা) তিনজনের গ্রুপ থেকে প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা পেয়েছিল। তখনও কমরেড জ্যোতি বসু প্রধান বিরোধদলীয় নেতা। পঞ্চাশের দশকে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গে বড় রকমের কৃষক ও শ্রমিক আন্দোলন, শিক্ষক আন্দোলন, রিফিইজি সমস্যা নিয়ে আন্দোলন ও খাদ্য আন্দোলন হয়েছিল। কমরেড জ্যোতি বসু বাইরের গণ আন্দোলনের সঙ্গে সংসদীয় আন্দোলনকে সমন্বিত করতে পেরেছিলেন অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে। এইভাবে তিনি শ্রমিক নেতা থেকে পার্লামেন্টেরিয়ান এবং কমিউনিস্ট পার্টির নেতা থেকে গণনেতায় পরিণত হন। সংসদীয় সংগ্রামে তার কি ধরণের যোগ্যতা ছিল সে সম্পর্কে কৃষ্ণ ধরের এক রচনা থেকে জানা যায়, “তিন সদস্য নিয়ে গঠিত কমিউনিস্ট গোষ্ঠীর নেতা হিসাবে তখনই তিনি আইনসভার মুসলিম লীগ, কংগ্রেস ও কৃষক প্রজা পার্টির দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। স্পিকার ছিলেন সৈয়দ নওশের আলী। তিনিও কমরেড জ্যোতিবসুর সংসদীয় রীতিনীতি সম্পর্কে জ্ঞান এবং পয়েন্ট অফ অর্ডার তুলে অত্যন্ত প্রশাসনিক বক্তব্য সভায় পেশ করার দক্ষতার প্রশংসা করেন। ….. অত্যন্ত ছোট কমিউনিস্ট গোষ্ঠীর নেতা হিসাবে তরুণ ও স্বল্প পরিচিত কমরেড জ্যোতি বসুর দক্ষতা ও সংসদে প্রশ্ন উত্থাপন করার ভঙ্গি ও ভাষা অল্প সময়ের মধ্যেই সভার ভিতরে ও বাইরে, সংবাদপত্র ও সর্বত্র আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে।”

১৯৬৪ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে বিভক্তি আসে। ভারতের বিপ্লবের রণনীতি, রাষ্ট্রের চরিত্র, কংগ্রেস দল ও সরকারের চরিত্র বিশ্লেষণ এবং আন্তর্জাতিক মহাবিতর্ক এতগুলি বিষয়ে গুরুতর মত পার্থক্যের কারণে পার্টি বিভক্ত হয়েছিল। ১৯৬৪ সালে নতুন করে যে মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়েছিল কমরেড জ্যোতি বসু প্রথম থেকেই ছিলেন তার পলিট ব্যুরোর সদস্য। কমরেড জ্যোতি বসুকে অনেকে গণআন্দোলনের নেতা বা পার্লামেন্টেরিয়ান বা সফল মুখ্যমন্ত্রীরূপে দেখেন। এটা খন্ডিত দেখা। তিনি ছিলেন প্রধানতঃ ও মূলত কমিউনিস্ট বিপ্লবী। মতাদর্শের ক্ষেত্রে তার অবস্থান ছিল খুবই স্বচ্ছ। মার্কসীয় মতাদর্শের মর্মবস্তুকে তিনি বুঝতেন এবং স্বার্থকভাবে প্রয়োগ করতে পারতেন। মার্কসবাদে তার দখল ছিল আর সেই সঙ্গে ছিল প্রখর বাস্তব জ্ঞান। সবটা মিলিয়েই তিনি ছিলেন কমিউনিস্ট গণ নেতা, যাঁর জনপ্রিয়তা ছিল প্রায় আকাশ ছোঁয়া।

১৯৬২ চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষ হয়। তখন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির যে অংশ তথাকথিত চীনপন্থী বলে পরিচিত ছিল তাদেরকে সরকার গ্রেপ্তার করেছিল। কমরেড জ্যোতি বসুও গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তখন সরকার চীনকে আক্রমণকারী বলে ঘোষণা দিয়ে সমাজতান্ত্রিক চীন বিরোধী প্রচার তুঙ্গে তুলেছিল। সেই সময় কমরেড জ্যোতিবসু ও অন্যান্য কমিউনিস্টরা প্রকাশ্যে বলেছিলেন যে, এটা সরকারের মিথ্যা প্রচার এবং মার্কিন ষড়যন্ত্রের ফসল। তিনি বললেন, সমাজতান্ত্রিক দেশ আগ্রাসী হতে পারে না। ঐ রকম যুদ্ধ পরিস্থিতিতে নিজ দেশের উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সত্য কথা বলতে যে হিম্মত লাগে তা কমরেড জ্যোতি বসুর ছিল। তখন চীন বিরোধীরা প্রচারে দেশকে এমনভাবে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল যে, মাকর্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টি (জ্যোত্যি বসু যার অন্যতম নেতা) সাময়িকভাবে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু মাত্র কিছুদিনের জন্যই। আবার প্রবল গণ আন্দোলনের মধ্যদিয়ে সিপিআই (এম) পশ্চিমবঙ্গে বৃহত্তম রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছিল, যার ফল পাওয়া গেল ১৯৬৭ সালের নির্বাচনে।

কমরেড জ্যোতি বসু সর্ম্পকে কিছু লিখতে হলে অবশ্যই ১৯৭১ সালে তার এবং তার পার্টির ভূমিকার কথা স্মরণ করতেই হবে। সেই সময় ১ ও ২ জুন কলকাতার বেলেঘাটার এক স্কুলে কয়েকটি বামসংগঠন এক সম্মেলনের মাধ্যমে গঠন করেছিল “বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি।” এই সংগঠনটি বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারকে মেনে নিয়েই দেশের অভ্যন্তরে স্বতন্ত্রভাবে যুদ্ধ করেছিল (ছোট বড় ১৪টি সশস্ত্র গেরিলা ঘাঁটি যাদের ছিল) এবং ভারতে অবস্থিত মুক্তিফৌজের ভেতরে থেকেও যুদ্ধ করেছিল। সিপিআই (এম) তাদের সংগৃহীত অর্থ দিয়ে সাহায্য করেছিল। প্রধানত সাহায্য করেছিল বামপন্থী মুক্তিযোদ্ধাদের। তখন বামপন্থীদের বিশেষ করে যারা চীনপন্থী বলে পরিচিত ছিলেন, তাদের ভারতে চলাফেরা বেশ অসুবিধাজনক ছিল। এক্ষেত্রে সিপিআই (এম) এবং তার নেতা কমরেড জ্যোতি বসু বাংলাদেশের বামকর্মীদের নিরাপত্তা প্রদান ও অন্যান্য সহয়তা প্রদান করেছিলেন।
প্রসঙ্গক্রমে কমরেড হায়দার আকবর খান রনো’র একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করতে চাই। কমরেড হায়দার আকবর খান রনো লিখেছেন, “১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে একবার আমাকে ভারতীয় সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার লোক আগরতলা থেকে ধরে নিয়ে শিলং এ নিয়ে যায়। সেখানে ভারতের সামরিক বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান জেনারেল সুব্রাহ্মনিয়াম আমাকে দুদিন ইন্টারোগেট করে পরে সসম্মানেই প্লেনে করে কলকাতায় পাঠিয়ে দেন। ঘটনাটি আমাকে বেশ বিচলিত করেছিল। কারণ কোন ধরনের গোয়েন্দা সংস্থার সংস্পর্শ আমার পছন্দীয় নয়। কোলকাতায় এসে বিষয়টি কমরেড প্রমোদ দাসগুপ্ত ও কমরেড জ্যোতি বসুর কাছে বিবৃত করেন। আমার মানসিক অবস্থা থেকে কমরেড জ্যোতি বসু একটু হেসে বললেন “বিপ্লব করতে হলে তো কত রকম সংস্পর্শে আসতে হবে। এতে ঘাবড়ানোর কি আছে। তিনি বলেছিলেন যে, “আমরা বাংলাদেশের বামপন্থীদের একমাত্র অস্ত্র দেয়া ছাড়া সবরকম সাহায্য করবো। কারণ অস্ত্রের বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকারের।”

অবশ্য একথা মনে করার কোন কারণ নেই যে, কমরেড জ্যোতি বসু সংকীর্ণতাবাদী ছিলেন। তিনি সর্বপ্রথমে চাইতেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সফল হোক। একইসঙ্গে অবশ্যই তিনি কামনা করতেন সঠিক লাইন গ্রহণের মধ্যদিয়ে এই যুদ্ধের মাধ্যমে কমিউনিস্টরা সামনে আসুক। এটাই তো স্বাভাবিক।”

কমরেড জ্যোতি বসু এক সময় সোভিয়েত লাইনকে সংশোধনবাদ বলে প্রত্যাখান করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি এবং তার পার্টি চীনের অনেক বিষয়ে সমালোচনা করেছিলেন। চীনের পার্টির সংকীর্ণতা ও কতিপয় ভুল তত্ত্ব (যেমন ত্রি-বিশ্ব তত্ত্ব) তারা কখনই গ্রহণ করেননি। অর্থাৎ অনুকরণ নয় বরং স্বাধীনভাবে মাকর্সবাদী তত্ত্বের ভিত্তিতে নীতি গ্রহণ করা ছিল তার ও তার দলের লাইন।

সত্তরের দশকে ইন্দিরা গান্ধী ইমার্জেন্সী জারি করলে ভারতের মার্কবাদী কমিউনিস্ট পার্টি দারুন আক্রমণের মুখে পড়ে। সেই সময় কমরেড জ্যোতি বসু ও তার পার্টি প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে কাজের সমন্বয় করতে শিখিয়েছিলেন সমগ্র পার্টিকে। যারা কমরেড জ্যোতি বসুকে একজন ভালো প্রশাসক এবং “বিপ্লব বিরোধী সংস্কারবাদী শান্তিপূর্ণ পথে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী” বলে মনে করেন তারা পরিপূর্ণরূপে ভ্রান্ত। বস্তুতঃ কমরেড জ্যোতিবসু আগাগোড়া বিপ্লবী এবং মাকর্সবাদের বিপ্লবী সত্ত্বায় আস্থাশীল নেতা ছিলেন।

১৯৭৭ সাল থেকে টানা ২৩ বছর জ্যোতিবসু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। বারবার নির্বাচনে তার দল বিজয়ী হয়েছিল। এমন ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে আরেকটি আছে বলে আমার জানা নেই। প্রশাসক হিসাবে কমরেড জ্যোতিবসু আসাধারণ দক্ষতার ও প্রখর বাস্তব বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছেন। ২৩ বছর মুখ্যমন্ত্রীত্ব করার পর তিনি ঐ দায়িত্বটি তুলে দেন তারই দলের কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্যরে হাতে। এই যে বিরাট সাফল্য তার পেছনে কমরেড জ্যোতি বসুর ব্যক্তিগত যোগ্যতাও যেমন ছিল, তেমনি ছিল অত্যন্ত সুসংগঠিত, সুশৃঙ্খল ও আদর্শনিষ্ঠ পার্টির ভূমিকা। এই সময়কালে তিনি পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যের ক্ষেত্রে তিনি যা করছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ভূমি সংস্কার, বর্গা অপারেশন, শিল্পায়ন এবং পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মাধ্যমে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। ফলে গরিব জনগণ কিছুটা ক্ষমতার স্বাদ পেয়েছিল। গরীব সীমিত আকারে হলেও গরীব জনগণের যে ক্ষমতায়নের কাজটি করতে পেরেছিলেন সেটাই ছিল তার দলের এবং তার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার মূল কারণ। আরও উল্লেখ্য যে পশ্চিমবঙ্গে অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় জাতপাত ও সাম্প্রদায়িকতার বিষয়টি খুবই কম ছিল।

কমরেড জ্যোতি বসুর বাংলাদেশের প্রতি দুর্বলতা ছিল সবসময়। তিনি ছিলেন আসলেই বাংলাদেশের জনগণের অকৃত্রিম বন্ধু। ১৯৯৬ সালে তিনি ঢাকায় এসেছিলেন মূলত গঙ্গার পানি বন্টন বিষয়ে আলোচনা করতে, যদিও তিনি কেন্দ্রীয় সরকারে ছিলেন না। তখনি লক্ষ্য করা গেছে যে বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষা করার ব্যাপারে তার ছিল আন্তরিক প্রচেষ্টা। সম্ভবতঃ নাড়িরটানে তার এই বিশেষ দুর্বলতা ছিল।

কমরেড জ্যোতি বসু ব্যক্তি হিসাবে ছিলেন সন্দেহাতীতভাবে সৎ ও আর্দশনিষ্ঠ। তার মধ্যে ছিল এক দরদী মন। মানুষ হিসাবে তিনি ছিলেন অতি উঁচু এবং কঠিন বিষয়কে সহজে ব্যাখ্যা করার অসাধারণ যোগ্যতা তার ছিল। তার মাঠের বক্তৃতাও আমি শুনেছি। আমাদের দেশে যে ধরনের জ্বালাময়ী বা আবেগপ্রবণ বক্তৃতা করার অথবা নাটকীয় ঢং এ বক্তৃতা করার প্রবণতা আছে অধিকাংশ রাজনীতিবিদদের মধ্যে, কমরেড জ্যোতি বসুর বক্তৃতায় তা পাওয়া যাবে না। তার বক্তৃতা শুনলে মনে হয় যেন তিনি লক্ষ লক্ষ মানুষের সঙ্গে সহজভাবে আলাপ করছেন। তবে তার বক্তৃতায় এক ভিন্ন ধরনের সম্মোহনী ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়।

পাঠক নিশ্চয় জানেন যে, একবার কমরেড জ্যোতি বসুর ভারতের প্রধানমন্ত্রী হবার কথা উঠেছিল। ভারতের লোকসভায় সিপিআই (এম)*এর সদস্যসংখ্যা ছিল বেশ নগণ্য। তারপরও অধিকাংশ দল তাকেই প্রধানমন্ত্রী করতে চেয়েছিলেন। এটা খুব সাধারণ ব্যাপার নয়। অর্থাৎ সর্বভারতীয় পর্যায়েও তিনি ছিলেন জনগণের আস্থাভাজন নেতা। তার পার্টি সিপিআই (এম) এই প্রস্তাবে রাজী হয়নি। তিনি পার্টি সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে এমন আপাত লোভনীয় প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছিলেন। আমাদের দেশের ক্ষেত্রে এমনটা ভাবাই যায় না। আর এর থেকেই বোঝা যায় যে, কমরেড জ্যোতি বসু ছিলেন আসলেই এক ব্যতিক্রমী নেতা।

৯৫ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। এটা স্বাভাবিক বলেই মেনে নেয়া উচিত। তবু মন মানতে চায়নি। মনে হয়, তার আরও কিছুদিন বাঁচা উচিত ছিল বাংলাদেশের স্বার্থে ও ভারতের জনগণের স্বার্থে। সর্বোপরি ভারতবর্ষ ও উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলন বিকাশের স্বার্থে। যে আদর্শ তিনি রেখে গেছেন কাস্তে হাতুড়ি খচিত যে লাল পতাকা তিনি তুলে ধরেছিলেন, তাকে আরও উঁচুতে তুলে ধরে আমরা যেন তাকে যুগ যুগ বাঁচিয়ে রাখি।

লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

সারাবাংলা/এজেডএস

জ্যোতি বসু সৈয়দ আমিরুজ্জামান

বিজ্ঞাপন

গাংনীতে নসিমন উল্টে চালক নিহত
২৮ নভেম্বর ২০২৪ ১৫:৫২

আরো

সম্পর্কিত খবর