Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আমরা হারি না, নিজেদের হারিয়ে দিই

অভ্র বড়ুয়া
১৮ জুলাই ২০২৩ ১৭:৩০

ইদানিং আমাদেরই তরুণ প্রজন্মের কিছু ঘটনা ভাবাচ্ছে আমাকে; সে বিষয় নিয়ে কিছু কথা বলি। জীবন বলতে সাধারণত যা বোঝায়, তা হলো যেকোন পরিস্থিতি সাহসের সাথে, বিচক্ষণতার সাথে মোকাবেলা করা, শুধু জয় নয়, মাঝেমাঝে পরাজয়কে সাদরে গ্রহণ করা।

আমরা এখন জীবন বলতে যা বুঝি তা হলো চেষ্টার আগেই হেরে যাওয়া। সমাজের আর পাঁচজন মানুষ কী বলছে তা নিয়ে ব্যস্ত হওয়া। শুধু জিতে গেলে পরাজয় হবে কার? আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা আমরা তরুণ প্রজন্ম পরাজয়টাকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারি না। অনেক সময় নিতে পারলেও, এক পর্যায়ে সে পরাজয়ের কারণে সমাজের আর চার-পাঁচজন কী বলছে সেই মতকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলি। ফলস্বরূপ আমরা কী করি? কীভাবে জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটানো যায়, সেই পথে অগ্রসর হই। জীবনটাকে বোঝার আগেই শেষ করে দেওয়ার মতো বড় বোকামি কিছু নেই!

বিজ্ঞাপন

শুধু প্রথাগত সফলতার পেছনে ছুটে লাভ কী? দক্ষতাটাই বড় বিষয়। বুয়েট, চুয়েট, মেডিকেল, হাভার্ড, অক্সফোর্ড-এ ভর্তি হতেই হবে কোন কথা আছে? আর কেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই? এগুলো দেশখ্যাত, বিশ্বখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঠিক আছে, সবাই এতে ভর্তির সুযোগ পাবে তেমন কোন কথা নেই।

আমরা বড় বড় স্বপ্ন দেখি, এসব নিয়ে। হ্যাঁ দেখাটা মন্দ নয়, আমি নিজেও দেখি; অস্বীকার করছি না। কিন্তু তাই বলে ভর্তির সুযোগ না পেলে কী জীবনটাকে বিসর্জন দিতে হবে নাকি?

এসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তি না হতে পারার স্বপ্ন পূরণ নাহলে আমরা যখন জীবনটাকে বিসর্জন দিয়ে ফেলি, এরপর এসব প্রতিষ্ঠানসমূহ কী আমাদের সে জীবন ফিরিয়ে দিতে পারে। এসব প্রতিষ্ঠানের মূল্য কী একটা জীবনের থেকেও বেশি?

আমি মেডিকেল চান্স পেয়েছি, আমি বুয়েট, চুয়েটের ইঞ্জিনিয়ার, আমি বিশ্ববিখ্যাত হার্ভাড এর ছাত্র। সবার এরকম বড় বড় ট্যাগ এর দরকার নেই, একদমই দরকার নেই। বিষয়টাকে স্বাভাবিকভাবে নিতে জানতে হবে আমাদের।

বিজ্ঞাপন

জীবনটা আমাদের। জীবনটা যে চার-পাঁচজন মন্দ কথা বলে তাদের না। সমাজ অনেক ভয়ংকর একটা রোগ জানেন? ক্যান্সার এর থেকেও ভয়ংকর। সমাজ অসুস্থ, আপনি সমাজের কথায় বেশি কান দিতে গেলে, ভেবে নিন যে আপনি জীবনযুদ্ধে হেরে গেছেন।

আমাদের মন, মানসিকতা, চিন্তা-ভাবনা বেশি বিকৃত হচ্ছে কারণ, আমরা অল্পতেই রাগান্বিত হয়ে যেকোন কিছু করে ফেলি, কথা বলার আগে ভাবি না, ভালো-খারাপের পার্থক্য বুঝি না।

বড়-বড় ডিগ্রি নিয়ে কী হবে বলেন? মানুষের মতো মানুষ যদি আমরা হতে না পারি।

জীবনের মধ্যে মনুষ্যত্বের সকল উপাদান খুঁজে পাওয়া মানুষটি হচ্ছে পৃথিবীর সফল মানুষ। জীবনটা আমার, আপনার। আশে-পাশের মানুষজনের না, সেটা মনে রাখবেন। সুতরাং, আপনার যা ভালো লাগে, আপনার জন্য যেটা উপযুক্ত সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন, সুস্থ আলোচনার মাধ্যমে। সেটা মা-বাবা, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব যে কারো সাথে হতে পারে। অভিমান, রাগ, জেদ, অস্থিরতা; এই চারটি বিষয় সফলতার পথে বড় বাঁধা, সবসময় এই চারটি বিষয়কে এড়িয়ে চলুন দেখবেন, সব কিছু সহজ।

সুনামের পাশাপাশি সমালোচনা গ্রহণ করতে শিখুন, সমালোচনা আমাদের ছোট করে না বরং, ভুল থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে।

আব্রাহাম লিংকন, আলবার্ট আইনস্টাইন, বিল গেটস, চার্লি চ্যাপলিন প্রভৃতি ব্যাক্তিবর্গ একসময় অন্যতম ব্যার্থ মানুষ ছিলেন, কিন্তু সেই ব্যর্থতাকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন বলে, তাদের দেখানো পথে চলছে আজ বিশ্ব।

আব্রাহাম লিংকন _

২৩ বছর বয়সে তার চাকরি চলে যায়। সেই সময়ে তিনি তার প্রথম নির্বাচনেও হারেন। ২৯ বছর বয়সে হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভ এর সদস্য হওয়ার জন্য নির্বাচন করে হারেন।

১৮৪৮ সালে, ৩৯ বছর বয়সী লিংকন ওয়াশিংটনের জেনারেল ল্যান্ড অফিসের কমিশনার হওয়ার জন্য নির্বাচন করে পরাজিত হন। ৪৯ বছর বয়সে সিনেটর হওয়ার জন্য নির্বাচনে দাঁড়িয়ে শোচনীয় ভাবে পরাজিত হন। এত ব্যর্থতার পরও তিনি রাজনীতি না ছেড়ে চেষ্টা করে যান। অবশেষে ১৮৬১ সালে, ৫২ বছর বয়সে তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগের প্রায় পুরোটাই ছিল ব্যর্থতার গল্প। কিন্তু এরপর তিনি ইতিহাস বদলে দেন।

আলবার্ট আইনস্টাইন _

ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়ে প্রতিটি বিষয়ে তিনি এতই বাজে রেজাল্ট করতেন যে, একাধিক বার পড়াশুনা বাদ দেয়ার চিন্তা করতে হয়েছিল। মারা যাওয়ার সময়ে তার বাবার একমাত্র দু:খ ছিল যে এই গর্ধভ ছেলে জীবনে কিছুই করতে পারবে না। বাবার এই কথায় আইনস্টাইন বহুদিন ধরে মনে কষ্ট চেপে রেখেছিলেন।

কোনও কাজ না পেয়ে তিনি বাধ্য হয়ে ইন্সুরেন্স সেলস ম্যানের কাজ নেন। কোনও কাজ না পারলে মানুষ এই ধরনের চাকরি করতো। ২ বছর পর তিনি পেটেন্ট অফিসে কাজ পান। যেখানে নতুন ডিভাইস পেটেন্ট করার আগে পরীক্ষা করা হতো।

কিন্তু একটা সময়ে এই মানুষটাই পৃথিবীর চেহারা পাল্টে দিয়েছেন। তার সেই ‘ডাল ব্রেন’ নিয়ে তিনি পদার্থ বিজ্ঞানের বেশ কয়েকটি মূল সূত্র সৃষ্টি করে গেছেন। বিজ্ঞানে অবদানের জন্য নোবেল প্রাইজ জিতেছেন। প্রমাণ করেছেন যে চেষ্টা করলে সবাইকে দিয়েই সবকিছু সম্ভব।

বিল গেটস _

বিল গেটসের প্রথম প্রজেক্ট অপমানজনক ভাবে ব্যর্থ হয়েছিল? মাইক্রোসফট এর কো-ফাউন্ডার এবং বাল্যবন্ধু পল এ্যালেন আর বিল গেটস মিলে ‘Traf-O-Data’ নামে একটি মেশিন তৈরী করেছিলেন যেটি ট্রাফিক কাউন্টার গুলো থেকে ডাটা সংগ্রহ করে সরকারি ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারদের তা গুছিয়ে সরবরাহ করবে। এমনিতে কাজটি হাতে করতে হতো।

এই যন্ত্রটির ওপেনিং এ স্বয়ং শিয়াটলের ট্রাফিক সুপারভাইজার এসেছিলেন। কিন্তু যন্ত্রটি চালু করার পর কোনওভাবেই কাজ করেছি। এমন লজ্জা আর অপমান গেটসের জীবনে আর আসেনি। কিন্তু তারা থেমে যাননি। এই ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়েই বিল আর পল মিলে পরে মাইক্রোসফটকে সফল করেন।

চার্লি চ্যাপলিন _

তার ৯ বছর বয়সে তার মা পাগল হয়ে যান, এবং তাকে মানসিক হাসপাতালে যেতে হয়। মায়ের মানসিক হাসপাতালে যাওয়ার কারণে চ্যাপলিনকে আবারও ওয়ার্কহাউজে ফিরে যেতে হয়। কিছুদিন পর তাঁর বাবা লিভার নষ্ট হয়ে মারা যান।

এরপর তার মায়ের পাগলামি এতই বেড়ে যায় যে তাকে সব সময়ের জন্য পাগলা গারদে বন্দী করে রাখার প্রয়োজন পড়ে। চ্যাপলিন ও তার ভাই সিডনি একদম পথে বসে পড়েন। দিনের পর দিন না খেয়ে রাস্তায় ঘুরে কাটান।

এভাবে চলতে চলতেই এক সময়ে তিনি মঞ্চে কাজ নেন। বিভিন্ন মঞ্চ নাটকে অভিনয় করতে করতে নিজের কমেডি প্রতিভাকে শক্তিশালী করেন। পরে হলিউডে পাড়ি জমিয়ে সর্বকালের সেরা নির্বাক অভিনেতা হয়ে ওঠেন।

হাসি-মুখে আমাদের হার মানা শিখতে হবে জীবনে, সেখান থেকেই আবার সফলতার পথে হাঁটা শুরু করে সব বাঁধা ডিঙিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। তাহলেই জীবন সুন্দর ভীষণ সুন্দর!

স্বপ্ন পূরণ না হলে মৃত্যুর পথ বেছে নিতে হবে এমন কোন কথা নেই। হাসি-মুখে এক কাতারে সব মানুষের সাথে মিলেমিশে জীবনে ভারসাম্য বজায় রেখে চলুন।

নিজের জীবনের মোড় ঘোরানোর চাবি অন্যের হাতে তুলে দিলে সমস্যা, নিজের জীবনের মোড় নিজেকেই ঘোড়াতে হয়।

পরিশেষে, একটা কথা বলি, মা-বাবার মতামতকে কখনো বিরূপভাবে না নেওয়াটাই ভালো। তারা আমাদের মঙ্গলের জন্য সবসময় বলেন। তাদের রাগ, অভিমান থাকবে; তারাও তো মানুষ। এসব বিষয়গুলোকে স্বাভাবিকভাবে নেওয়া উচিত।

আমিও অনুসরণ করি, করছি, করার চেষ্টা করি। আমরা একসাথে অনুসরণ করি চলুন। কোন মোটিভেশনের জন্য কথাগুলো বলিনি, আমরা মেনে চলার জন্যই বলা।

মৃত্যুকে স্বাভাবিকভাবে তার সময় অনুযায়ী আসতে দিন, আপনাকে তাকে স্বাগত জানানোর প্রয়োজন নেই। মহাপাপ আর বেকামি করা ছাড়া কিছুই নয়।

লেখক: শিক্ষার্থী

সারাবাংলা/এসবিডিই

অভ্র বড়ুয়া আমরা হারি না- নিজেদের হারিয়ে দিই মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর