Thursday 15 May 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ঢাকা শহর নয়, এ যেন ডেঙ্গুর শহর

মুহাম্মদ নাহিদ হোসেন নাঈম
২৩ জুলাই ২০২৩ ১৪:১৯ | আপডেট: ২৩ জুলাই ২০২৩ ১৪:২১

উপক্রান্তিয় এবং ক্রান্তীয় অঞ্চলের গ্রীষ্ম-প্রধানর্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ অংশেও এর প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ ডেঙ্গু সংক্রমণ ঘটে। সময় এবং অঞ্চল-বিশেষে এই রোগ মহামারির আকারও ধারণ করে। বিনা চিকিৎসায়, ভুল চিকিৎসায়, এবং দেরিতে চিকিৎসার জন্য অনেক ক্ষেত্রেই রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হয়।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অতিবর্ষণজনিত কারণে বন্যার প্রকোপের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ডেঙ্গুর বিস্তার। বিশ্বের অর্ধেক মানুষ এ বছর মশাবাহিত ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে বলে সতর্কবার্তা দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

বিজ্ঞাপন

মানুষের সাধারণত দুই ধরনের ডেঙ্গু জ্বর হয়- ক্ল্যাসিকাল এবং হেমোরেজিক। ক্ল্যাসিকালে জ্বর সাধারণত দুই থেকে সাত দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। বিপদ ঘটে হেমোরেজিকের ক্ষেত্রে। এই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ব্যক্তির অবস্থা পাঁচ থেকে সাত দিন পর মারাত্মক সংকটাপন্ন হতে পারে।

হেমোরেজিকের ক্ষেত্রে রোগীর রক্তপাত হয়, রক্তে অনুচক্রিকার মাত্রা কমে যায় এবং রক্ত প্লাজমা কমে যায়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবার দেখা দেয় ডেঙ্গু শক সিনড্রোম। এতে রক্তচাপ বিপজ্জনকভাবে হ্রাস পায়। কিছু সময় আক্রান্ত ব্যক্তির মুখ, দাঁতের মাড়ি এবং নাক থেকে রক্তপাত ঘটে। মলের সঙ্গেও মাঝে মাঝে রক্ত বের হতে পারে।

ডেঙ্গু আক্রান্ত নারীর ক্ষেত্রে পিরিয়ডের সময়ও অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়। এমনকি কারো কারো রক্তের প্লাটিলেট বা অণুচক্রিকা কমে গিয়ে শরীরের চামড়ার নিচে ইন্টারনাল ব্লিডিং হয়। পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে যখন রোগীর হাত-পা দ্রুত ঠান্ডা হওয়া শুরু করে এবং রক্তচাপ কমে যায়।

বিজ্ঞাপন

আক্রান্ত ব্যক্তি এ সময় মাত্রাতিরিক্ত ঘামা শুরু করে। এতে তার মধ্যে এক ধরনের ছটফটানিও আরম্ভ হয়। কেউ কেউ বমি করে বা তাদের বমি বমি ভাব হয়। এই সময়টায় কোনো কোনো রোগীর হোয়াইট ব্লাড সেল স্বল্পতা, ইলেক্ট্রোলাইটের অসমতা, লিভারে সমস্যা, অথবা ব্রেনে রক্তক্ষরণের মতো ঘটনা ঘটে। এতে তাদের শকে চলে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। দুঃখজনক হলো, এর ফলে অনেক রোগীর মৃত্যুও হতে পারে।

বাংলাদেশে ডেঙ্গুর শঙ্কা বাড়ছে৷ আশঙ্কা করা হচ্ছে, এবার ডেঙ্গু গত বছরের চেয়েও প্রকট হবে৷ মৌসুমের শুরুতেই হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর ভিড় দেখা যাচ্ছে৷ আর বৃষ্টি শুরু হলে জুন থেকে অক্টোবরে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে৷

এদিকে ডেঙ্গু এখন সারা বছরের রোগে পরিণত হয়েছে৷ এর কোনো বর্ষা বা শীত নেই৷ ৩১ ডিসেম্বর তীব্র শীতে একদিনে ভর্তি হয়েছেন ৪৭ জন৷

ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশার ওপর জরিপ এবং হাসাপাতালে রোগী ভর্তির হার- দুটিই খারাপ ইঙ্গিত দিচ্ছে৷বিশ্লেষকরা বলছেন বাংলাদেশে এখন ১২ মাসই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাচ্ছে৷ কারণ বৃষ্টির বাইরেও উন্নয়নমূলক কাজসহ নানা কারণে এডিস মশা জন্ম নিচ্ছে৷

ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ

১.সাধারণভাবে ডেঙ্গুর লক্ষণ হচ্ছে জ্বর। ১০১ ডিগ্রি থেকে ১০৩ ডিগ্রি তাপমাত্রা থাকতে পারে। জ্বর একটানা থাকতে পারে, আবার ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে দেয়ার পর আবারও জ্বর আসতে পারে।

২.ডেঙ্গুর অন্যতম লক্ষণ শরীরে ব্যথা। সঙ্গে মাথাব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা হতে পারে। সঙ্গে চামড়ায় লালচে দাগ বা র‌্যাশ থাকতে পারে।

৩.শরীর ঠান্ডা হচ্ছে মনে হতে পারে। ক্ষুধা কমে যাওয়া, শরীর ম্যাজম্যাজ করার লক্ষণও দেখা দিতে পারে

৪.সিভিয়ার ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে তীব্র পেট ব্যথা, পেট ফুলে যাওয়া, রক্তবমি, মাড়ি থেকে রক্তক্ষরণ, ত্বকের নিচে রক্তক্ষরণ, শ্বাসকার্য কঠিন বা দ্রুত হওয়া, শরীর ঠান্ডা অনুভব বা ঘাম হওয়া, দ্রুত নাড়ি স্পন্দন এবং ঘুম ঘুম ভাব, চেতনা হারানো।

৫.শসনড্রোম থেকে মানবদেহে পানিশূন্যতা তৈরি হয়। সঙ্গে সঙ্গে পাল্স রেট অনেকটা বেড়ে যায় এবং রক্তচাপ খুব কমে যায়। শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়। শ্বাসপ্রশ্বাস খুব দ্রুত চলে। রোগী অস্থির হয়ে ওঠেন। তখন সময় নষ্ট না করে হাসপাতালে ভর্তি করানো উচিত।

ডেঙ্গু পরিস্থিতিঃ

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপর্যন্ত দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন ১,০৮২ জন৷ মারা গেছেন ১২ জন৷
ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি৷ সারাদেশে মোট ভর্তি রোগীর ৩৯০ জনই ঢাকায়৷ মারা গেছেন ৯ জন৷

এরপরই চট্টগ্রামের অবস্থান৷ চট্টগ্রামে এই বছর হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত ভর্তি রোগীর সংখ্যা ২২৮ জন৷ মারা গেছেন তিনজন৷২০২২ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সারাদেশে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৬২ হাজার ৩৮২ জন৷ মারা গেছেন ২৮১ জন৷২০২১ সালে মোট ভর্তি হয়েছিলেন ২৮ হাজার ৪২৯ জন৷ মারা যান ১০৫ জন৷

ঢাকায় হঠাৎ করেই বাড়ছে ডেঙ্গু সংক্রমণ। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত পূববর্তী ২৪ ঘণ্টায় ১৭ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। যার মধ্যে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৬ জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে মঙ্গলবার পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

কন্ট্রোল রুমের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ১২৬ জন ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এরপর তিন মাসে সারাদেশে মাত্র ৬৩ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছিলেন। তবে গত মাসে সারাদেশে ১৬৩ জন ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। যেখানে এই মাসে এক সপ্তাহে ডেঙ্গু নিয়ে ১১১ রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

গত ২৪ ঘণ্টায় আক্রান্তদের নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা দাঁড়াল ৪৬৩ জনে। এদের মধ্যে চিকিৎসা নিয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ৩৮৮ জন।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৬ জন। আর ঢাকার বাইরে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা এক জন।রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) জানিয়েছে, ডেঙ্গু উপসর্গ নিয়ে চলতি বছর এখনও কোনো মৃত্যু সংবাদ আসেনি।

রাজধানীর ১৮ শতাংশ বাড়িতে এডিস মশার লার্ভার উপস্থিতি পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সাধারণত কোন এলাকার ৫ শতাংশ বাড়িতে এই লার্ভা পাওয়া গেলে ওই পরিস্থিতিকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ধরা হয়।

জাতীয় ম্যালেরিয়া ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় ১৮ থেকে ২৭ জুন জরিপ চালিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৯৮ ওয়ার্ডে চালানো এই জরিপে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া রোগের বাহক মশার প্রজননস্থল শনাক্ত, পূর্ণাঙ্গ মশা ও লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপ ও ম্যাপিং করা হয়েছে।বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশি লার্ভা পাওয়ার অর্থ ঢাকায় এবার এডিস মশাও বেশি পাওয়া যাবে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, এ বছর ২৭ জুন পর্যন্ত সারা দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৭ হাজার ৭৫৪ জন, মৃত্যু হয়েছে ৪৭ জনের। বাংলাদেশে এর আগে জুন মাস পর্যন্ত কখনও ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে এত পরিমাণ রোগী হাসপাতালে ভর্তি ও মারা যায়নি।

জরিপের প্রথম আট দিনের তথ্যে দেখা গেছে, ২৫ জুন পর্যন্ত ঢাকার ২ হাজার ৫১১ বাড়ির মধ্যে ৪৫৩ বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। আর ২ হাজার ৭৩৮টি পাত্রের মধ্যে ৬২৫টিতে পাওয়া গেছে এই লার্ভা।

ডিএনসিসির ৯৬২ বাড়ির মধ্যে ২১০টি বাড়ি এবং ৯৯৪টি পাত্রের মধ্যে ২৭৭টি পাত্র এবং ডিএসসিসি এলাকার ১ হাজার ৫৪৯টি বাড়ির মধ্যে ২৪৩টি বাড়ি এবং ১ হাজার ৭৪৪টি পাত্রের মধ্যে ৩৪৮টি পাত্রে মিলেছে এডিস মশার লার্ভা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, ঢাকা উত্তর সিটি এলাকার হাউজ ইনডেক্স ২১ দশমিক ৮, ব্রুটো ইনডেক্স ২৮ দশমিক ৭৯। দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় হাউজ ইনডেক্স ১৫ দশমিক ৭, ব্রুটো ইনডেক্স ২২ দশমিক ৪৭।

মশার লার্ভার উপস্থিতি হিসাব করা হয় ব্রুটো ইনডেক্সের মাধ্যমে। জরিপে প্রতি একশ প্রজনন উৎসের মধ্যে ২০টি বা তার বেশিতে যদি এডিস মশার লার্ভা বা পিউপা পাওয়া যায়, তাহলে সেটাকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ উপস্থিতি বলা যায়।

ডেঙ্গু জ্বরের প্রতিকারঃ

১.ডেঙ্গু একটি মশা-বাহিত রোগ। তাই মশার কামড়ের হাত থেকে নিজেকে এবং আপনার পরিবার কে বাঁচান।

২.বাড়ির চারপাশে জল জমতে দেবেন না। জমা জলে মশারা বংশবিস্তার করে। জল জমতে না দিয়ে মশার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সপ্তাহে অন্তত একবার জল জমতে পারে এমন জায়গা পর্যবেক্ষণ করুন। এবং গাছের টব, ফুলদানি, পরে থাকা গাড়ির টায়ারের জমে থাকা জল ফেলে দিন।

৩.শরীর ঢাকা জামা কাপড় যেমন লম্বা-হাতা শার্ট, লম্বা প্যান্ট, মোজা এবং জুতা পরুন।

৪.ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী মশা ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি সক্রিয় থাকে। এই সময় অতিরিক্ত সতর্ক থাকুন।

৫.রাতে শোবার সময় মশারী ব্যবহার করুন।

৬.মশা নিরোধক কেমিক্যাল যেমন পারমেথ্রিন ব্যবহার করুন।

ডেঙ্গু জ্বর একটি সাধারণ রোগ। কিন্তু অবহেলা করলে এই রোগ মারাত্মক হতে পারে। শহরাঞ্চলে এর প্রকোপ বেশি। তাই নগরবাসীকে আরেকটু সজাগ ও সচেতন হতে হবে। বিশেষ করে যাদের ডেঙ্গু হয়েছে তাদের অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে হবে। দ্বিতীয় ডেঙ্গু সংক্রমণ মারাত্মক হতে পারে। সচেতন থাকুন, সুস্থ থাকুন এবং ভালো থাকুন।

লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সারাবাংলা/এসবিডিই

ঢাকা শহর নয়- এ যেন ডেঙ্গুর শহর মুক্তমত মুহাম্মদ নাহিদ হোসেন নাঈম