Tuesday 26 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিষবৃক্ষ মেহগনি এবং মাটিকে ধ্বংস করার রাজনীতি

রাতুল মুন্সী
২৫ জুলাই ২০২৩ ১৫:০৯

গাছ আমরা কেনো রোপন করি? নিশ্চয়ই বেশ কিছু উপকার করে গাছ। কিন্তু যদি কোনো গাছ আমাদের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়? হ্যাঁ সব গাছ সব পরিবেশের জন্য উপযোগী নয়। আমাদের মাটি, পানি, বাতাস ও পরিবেশের জন্য এমনই একটি ক্ষতিকর গাছ মেহগনি। আমেরিকায় জন্ম নেয়া আমাদের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এই গাছ কিভাবে এত জনপ্রিয় হয়ে উঠল এই দেশে? যত দেখছি ততই অবাক হচ্ছি; কারা এদেশে বৃক্ষ রোপণের নামে মেহগনির মতো বিষবৃক্ষ বাংলার সোনার মাটিতে ছড়িয়ে দিয়েছে? আমাদের মাটিকে অনুর্বর করে দেয়া, আমাদের পানিকে দূষিত করে দেয়া, আমাদের বাস্তুসংস্থানে বিপর্যয় ঘটিয়ে কারা লাভবান হয়?

বিজ্ঞাপন

মেহগনি ১৭৯৫ সনে পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ থেকে প্রথম ভারতীয় উপমহাদেশে আনা হয়। অন্যান্য নাম: মেহগনি, মেহগিনি, মেহগেনি, মেহাগিনী। ইংরেজি: mahogany, mahogany tree.

কলকাতার বোটানিকাল গার্ডেনে পরীক্ষামূলক এ বৃক্ষের আবাদ করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে এর সম্ভাব্যতা যাচাই করে উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে এর চাষ সম্প্রসারণ করা হয়। পৃথিবীতে এ যাবত তিন প্রজাতির মেহগনি বৃক্ষ আছে বলে জানা গেছে। এটি দ্বিবীজপত্রী গুপ্তবীজী উদ্ভিদ। এটি meliaceae (নিম) গোত্রের অন্তর্গত Swietenia গণের কিছু প্রজাতির সাধারণ নাম। এই প্রজাতিগুলোর ভিতরে তিনটি প্রজাতিকে বিশেষভাবে মেহগনি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।

এই প্রজাতিগুলো হলো- Swietenia mahagoni (L.) Jacq., Swietenia macrophylla King, and Swietenia humilis Zucc।
আবার অনেক গবেষক মনে করেন,মেহগনি গাছের আদি নিবাস উত্তর আমেরিকার ক্রান্তীয় অঞ্চল। বিশেষ করে পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জকেই এদের আদি নিবাস হিসাবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।

ইউরোপীয় বণিকদের মাধ্যমে ভারতবর্ষসহ পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে এই গাছটি ছড়িয়ে পড়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার দক্ষিণে এই গাছগুলো প্রাকৃতিকভাবে জন্মে থাকে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই গাছের চাষ করা হয়। প্রজাতিভেদে বড় বা ছোট মেহেগনি নামে অভিহিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশ Swietenia mahagoni এবং Swietenia macrophylla প্রজাতি দুটির চাষ হয়ে থাকে। এর ভিতরে Swietenia macrophylla জাতীয় গাছ বেশি দেখা যায়। এদের পাতা বেশ বড় বড় হয়ে থাকে। এই গাছগুলো প্রায় ৫০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে।

ফিলিপিন্সে, পরিবেশবিদরা পরিবেশ ও বন্যজীবনের উপর এর নেতিবাচক প্রভাবের কারণে সম্ভবত মাটির অম্লতা সৃষ্টি এবং বন্যজীবের কোনও ক্ষতি করতে পারে বলে মেহগনির রোপণ বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

মেহগনি গাছের পাতার ক্ষতিকারক রস মাটিকে অনুর্বর করে তোলে, কোনো কীটপতঙ্গ বাঁচতে পারে না। এ গাছের ফল কোন পশু-পাখি ভক্ষণ করে না এবং কোন পাখি গাছটিতে বাসা বাঁধে না। এর গঠনগত কারণেই পাখির বাসার জন্য অনুপযোগী। এ গাছের পাতা পানিকে মারাত্মকভাবে দূষিত করে।ফলে চাষের মাছ সেখানে ক্ষতিগ্রস্ত হয় । এ গাছ হাঁস-মুরগি ও পাখিদের ক্ষতিকর নিউ ক্যাসেল রোগের জন্য দায়ী।

যে গাছ রোপণের ফলে আমাদের মাটি অনুর্বর হয়ে যাচ্ছে পরিবেশ, প্রকৃতি এবং বাস্তসংস্থানের ক্ষতি হচ্ছে। সেই ক্ষতির কথা জেনেও কেন এই বিষ বৃক্ষ রোপণে বাধা প্রদান করা হচ্ছে না? কেন কোন রকম নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে না?

সারা দেশে অসংখ্য মেহগনি আমাদের স্থানীয় বৃক্ষকে প্রতিস্থাপিত করে সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে। দেশের অর্থ, পুষ্টি ও পরিবেশের জন্য উপযোগী দেশীয় বৃক্ষের বদলে ক্ষতিকর বৃক্ষে সয়লাব হয়ে গেছে আমাদের উর্বর জমি। মৃত্তিকা গবেষণা ইন্সটিটিউটের গবেষণা মতে আমাদের প্রায় পঁচাশি ভাগ জমি অনুর্বর হয়ে গেছে। প্রতি বছর কোটি কোটি বিষাক্ত মেহগনি ফল আমাদের মাটিতে মিশে গিয়ে এর অনুর্বর হয়ে ওঠায় ভূমিকা রাখছে। অথচ পৃথিবীর সবচেয়ে উর্বর ভূমি ও ফুল-ফসলের জন্য সুপ্রাচীনকাল থেকেই বাংলার খ্যাতি রয়েছে পৃথিবী জুড়ে।

বন গবেষনা কেন্দ্র সহ কিছু বেসরকারি সংস্থা নানান তকমা দিয়ে বেড়াচ্ছে। এই বৃক্ষের গুনাগুন পরিচর্চা বিষয়ে। বন গবেষণা কেন্দ্র গবেষণাও করেছে।

যেই বৃক্ষ রোপণ করে আমাদের মাটিই নাই হয়ে যাচ্ছে সেই বৃক্ষ নিয়ে কেন আমাদের এতো বেশি মতামাতি?

কেন একটি ক্ষতিকর বৃক্ষের প্রতি এতো দরদ? তারা কি দেশের কথা, দেশের মানুষের কথা, দেশের পরিবেশের কথা ভাবতে পারেন না? বৃক্ষ হলেই সেটি ভালো? এমন ধারণা তো আদিম কালের অশিক্ষিত মানুষেরও ছিল না; তাহলে এতো এতো শিক্ষিত প্রশিক্ষিত লোকবলের মাধ্যমে দেশের কি হচ্ছে? দেশের ক্ষতির জন্য জনগণের এতো অর্থের অপচয়?

আপনি বলতেই পারেন,সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়। সরকার কে প্ররোচনা দিলো কে ? নিশ্চয় দাতা সংস্থা গুলো? তাহলে দাতা সংস্থা গুলোর লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য কি?

এই দাতা সংস্থাগুলো নিজেদের লাভের বাইরে অন্য কিছু হিসাব করতে জানে না। বড় বড় দাতা সংস্থার চালিকা শক্তি বিভিন্ন ব্যবসায়ী গোষ্ঠী। বাংলাদেশে ক্ষতিকর বৃক্ষ রোপণের মাধ্যমে এই উর্বর জমি অনুর্বর করে দিতে পারলে তাদের হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা আছে। আপাত দৃষ্টিতে যেহেতু বৃক্ষ রোপণ একটি মহৎ কাজ তাই এই পথেই সবচেয়ে সহজে ক্ষতি করা যায়। তাই ব্যাপক হারে স্থানীয় প্রজাতির বৃক্ষ উচ্ছেদ করে বহিরাগত ক্ষতিকর প্রজাতির বৃক্ষ ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এখনো ব্যাপকভাবে চলমান আছে এই প্রক্রিয়া। ভূমি অনুর্বর হলে সারের ব্যবসা আছে, পাখি ধ্বংস হয়ে গেলে কীটনাশকের ব্যবসা আছে, স্থানীয় জাতের বিলুপ্তি ঘটাতে পারলে বীজের ব্যবসা আছে। সার, কীটনাশক, হাইব্রীডের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া থেকে মানুষের বিভিন্ন রোগাক্রান্ত হবার ফলে অষুধের ব্যবসা আছে। প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যবসা। তাই দাতা সংস্থার পরামর্শ শুধু উপকার নয়, ভয়াবহ ক্ষতির কারণও হতে পারে।

মেহগনি রোপণ করা একাধিক কৃষকদের থেকে জানা গেছে, তারা এই গাছের গুনাগুন বিষয়ে তেমন কিছু জানে না। ভাল কাঠ এবং বাজারে এই কাঠের চাহিদা আছে এবং খুব কম টাকায় চারা পাওয়া যায় বলে আমরা মেহগনি রোপণ করি। তবে এই গাছের নীচে কোন ঘাস হয়না।এবং পুকুরের উপর রোপণ করলে পাতা পানিতে পড়ে গ্যাস তৈরি করে।

মাছ মরে যায়। তারপরও কেন এই গাছ রোপণ করেন সেই প্রশ্নে তারা বলেন, সবাই লাগায় বলে আমরাও লাগায়। এছাড়াও কেউ তার অবাদি জমির আইলে, ঘরের উপর মেহগনি গাছ রোপণ করলে বাধ্য হয়ে আমাদেরও মেহগনি গাছ রোপণ করতে হয়। তবে এই গাছ আসলেই ক্ষতিকর।

আশির দশকের দিকে পরিবেশ প্রকৃতি রক্ষার নাম করে বিশ্বব্যাংক সহ বিভিন্ন দাতা সংস্থার মাধ্যমে তাদের দেশের আগ্রাসী গাছ যে আমাদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে তারা প্রমাণ আমরা প্রত্যক্ষ ভাবে লক্ষ্য করছি। আমাদের দেশে বিদেশী গাছের আগ্রাসনে এর মাধ্যমে।

নিশ্চয় সেই দাতা সংস্থা এদেশের না।যদি বাহিরের দেশের হয় তাহলে এই আগ্রাসী ক্ষতিকর বৃক্ষরোপণে উদ্বুদ্ করার পেছনে রয়েছে গভীর ষড়যন্ত্র।

এই ষড়যন্ত্রের মুখোশ যদি আমরা উন্মোচন করতে না পারি তাহলে হারাবো সোনার মতো মাটি,প্রকৃতি,পশুপাখি যেগুলোর সাথে আমাদের জিবন যাপন ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

ঔপনিবেশিক আগ্রাসন শুধু আমাদের দেশের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক উপরে পড়েনি। আমাদের সোনার মতো মাটির উপর তার প্রভাব আমরা লক্ষ্য করতে পারি । নীল চাষে বাধ্য করতে পাশবিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে ব্রিটিশ গেল প্রত্যক্ষ ভাবে, কমলো নিপীড়ন, কিন্তু পরোক্ষ ভাবে এর রেষ থেকেই যাচ্ছে।

যেখানে সেখানে মেহগনি,বাড়ির উঠানে মেহগনি, অবাদী জমির পাশে মেহগনি,মসজিদ মাদ্রাসার সামনে মেহগনি এবং কি যে স্কুলের মাঠে আম,জাম কাঠাল গাছের নীচে বৌচি খেলা জমে উঠতো ক্লাসের ফাকে সেখানেও মেহগনি।

বাংলার মানুষের মগজ এতোটা দখল করে নিয়েছে মেহগনি গাছ পারলে বুক, কলিজায় রোপন করবে এই গাছ। স্কুলে ফল গাছ কেন্দ্রীক অনেক স্মৃতি আছে যা এখনো মনে পড়লে লজ্জায় মুখ ডাকবার জায়গা খুজে পাইনা।

এখনকার ছেলে মেয়েদের এসব স্মৃতি নাই বলে আমার খুব দুঃখ হয়। আমাদের বাড়ির উঠানে যে ফল গাছটা থাকতো সেই ফল গাছে নাম লিখে রাখতাম কে কোনটা খাবে। আর এখন বাড়িতে ফলের গাছ নাই, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফলের গাছ নাই।

চারদিকে শুধু টাকার অলংকার মেহগনি গাছ।রোপণের পর থেকেই হিসাব হয় কত টাকা বিক্রী হবে।আমাদের সন্তানদের তাই শেখানো হয়।

অথচ আমাদের বাবা,মা রা এক সময় গাছের ফল পাকলেই ফল দিয়ে আত্মীয় বাড়ি পাঠাতেন। এখন আর এই বিষয় গুলো নাই বললেই চলে ।

গ্রীষ্মের ছুটিতে মামার বাড়ি যাওয়ার একটা হুলস্থুল পড়ে যেত। কাপড়ের ব্যাগ আগে থেকে গুছানো থাকতো। যে দিন ছুটি হবে ঐদিনই চলে যাবো। মামা বাড়ি গিয়ে কোন গাছটা থেকে কাকে নিয়ে কোন ফলটা পেরে খাবো সেটার হিসাব কষা হতো ঘুমে,স্বপ্নে, বন্ধুদের আড্ডায়। স্বপ্নে এমন কত হয়েছে।

এই সব স্মতি কেবল পথের পাঁচালি কিংবা পল্লীর কবি কবি জসীম উদ্দীনের বই পড়েই হয়তো এই সময়ের ছেলে মেয়েরা বুঝবে।আর এ সকল গল্প পুরান হয়েই থাকবে তাদের মগজে।

তাদের বাবা, মা কিংবা পরিবারে এমন কিছূ তো তারা পাইনি। জন্মের পরপরই একটা ফোন, কাদে ব্যাগ।
পরিবেশ কি?
পরিবার কি?
সমাজ কি?
দেশ কি?
দায়বদ্ধতা কি?
এসব কিছুই শেখানো হচ্ছে না।
পরিবেশের বন্ধু যে গাছ, গাছের অক্সিজেন নিয়ে যে বেঁচে আছি সেটাও জানতে পারে পাঠ্য বইয়ে।
আমাদের পরিবেশ উপযোগী গাছ কই?
আমাদের দেশীয় জাতের দশটা গাছের নাম কি বলতে পারবো?
দশটা দেশি ফলের নাম কি বলতে পারবো আমি?

বার বার সন্দেহই থেকে যায়। আর টিভি সহ নানান মাধ্যমে সুর মিলিয়ে আমরা বলি গাছ লাগান পরিবেশ বাচান।

নাহয় ধরে নিলাম আমরা গাছ লাগাচ্ছি। কিন্ত সেই গাছটি আমাদের পরিবেশের উপযোগী কি না সেই বিষয়ে আমাদের কোন চিন্তা ভাবনা নাই। ভুল বৃক্ষরোপণে নষ্ট হচ্ছে মাটি,পানি,পরিবেশ,প্রকৃতি,বাস্তসংস্থান সহ আমাদের জনজিবন।

কিন্তু আমি পরিবেশ ধ্বংসকারি বৃক্ষরোপণ করে দশ বছর পরে পাঁচ হাজার টাকা বিক্রী করতে পারলেই বাহবা বাহবা করি। অথচ এই বৃক্ষটা যদি সঠিক বৃক্ষ থাকতো কত কিছুর যোগ সূত্র থাকতো এই বৃক্ষের সাথে।

আমরা হয়তো বুঝেও না বুঝার ভান করে বসে আছি। বিগত বছর ধরে বৃক্ষ রোপণ মহৎ কাজ এর কাঠ মহামূল্যবান বলে মেহগনি সহ অন্য যে সকল বিদেশী গাছ চাপিয়ে দিয়ে আমাদের পরিবেশ, প্রকৃতি এবং বাস্তসংস্থানের যে ক্ষতি করা হচ্ছে তা দেখবো ভয়ংকর ভাবে।

লেখক: সভাপতি, ফলদ বাংলাদেশ ফাইন্ডেশন, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় শাখা

সারাবাংলা/এসবিডিই

বিষবৃক্ষ মেহগনি এবং মাটিকে ধ্বংস করার রাজনীতি মুক্তমত রাতুল মুন্সী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর