গণতন্ত্রের পরিপূর্ণতা পেতে নৈতিকতারও দরকার
২৬ জুলাই ২০২৩ ১৪:১১
দেশ স্বাধীন হবার পর আজ অবধি কোনো সরকারই জনগণের মনের ভাষা বোঝেনি, তবে বুঝেছিলেন শেরে বাংলা, ভাসানি, বঙ্গবন্ধু। তাইতো তারা স্বাধীনতার নায়ক-মহানায়ক হতে পেরেছিলেন। আমরা কোটি কোটি জনগণ যেমন বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম, প্রাণ দিয়েছিলাম, তিনিও স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা করে তার প্রতিদান দিয়েছেন।
এখন কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সকলেই কাজ করবে এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। এ সত্য ভুলে গেলে চলবে না। এখন যারা ক্ষমতায় আসছে কেবল তারাই নিজেদেরকে দেশপ্রেমিক মনে করছে আর বাকিদেরকে মনে করছে রাষ্ট্রদ্রোহী, দেশদ্রোহী, রাজাকার আরও কত কী! মাসের পর মাস, বছরের পর বছর কারাগারে বন্দি রেখে অনেক রাষ্ট্রীয় নেতাকে শেষ করে দেওয়া হচ্ছে যা অন্যায়। আর কতকাল ধরে চলবে এই অত্যাচার? এই প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতি? এটাই কি স্বাধীনতা? এটাই কি মানবাধিকার? প্রশ্নগুলো কার কাছে করবো? এমন মানুষও আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
আমরা গ্রাম-গঞ্জের মানুষ ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তর অবধি ইতিহাস সৃষ্টি করেছি। ক্ষোভে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছি। এখন আমাদের কাজ নতুন প্রজন্মদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে ভবিষ্যৎ দেখানো। দেশের প্রায় সাড়ে তিন কোটি তরুণ বেকার। দেশে মধ্যবিত্তের সংখ্যা এখন প্রায় ছয় কোটি। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু করে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন হয়ে বর্তমান পর্যন্ত যা কিছু সামাজিক আলোড়ন হয়েছে সবই সম্ভব হয়েছে তরুণদের কারণে। অথচ সেই তরুণরা আজ বঞ্চিত বাকস্বাধীনতা থেকে, স্বাধীন মত প্রকাশ থেকে, ভোটাধিকার থেকে। ফলে তাদের মধ্যে নতুন নতুন চিন্তা ও আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশ ঘটছে না।
আমরা এগিয়ে যাবার নতুন পথও খুঁজে পাচ্ছিনা। তাদেরকে বাদ দিয়ে দেশ গড়া যেমন সম্ভব হতে পারে না ঠিক তেমনি সমাজের লেখক, প্রকাশক, বুদ্ধিজীবী ও ভিন্নমতের মানুষ হত্যা করে দেশ চালানো সম্ভব নয়। লেখক, প্রকাশক, বুদ্ধিজীবী ও ভিন্নমতের মানুষ হত্যার মতো জঘন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে কি জাতীয় সংসদে বা মন্ত্রিসভায় কার্যকর আলোচনা হয়েছে? একজন লেখক কখনো কখনো সমগ্র মানবজাতির ওপরই সুদূরপ্রসারী ও শক্তিশালী অবদান রাখতে পারেন। একটি মহল প্রতিবাদী লেখকদের মেরে ফেলতে চাইছে অথচ সংসদেও সে বিষয়ে নির্ভীক কোনো আলোচনা নেই, বিরোধীদলের তেমন প্রতিবাদ নেই। কীভাবে মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞান ক্রমেই উন্নত স্তরে পৌঁছাবে যদি বিরোধী দলের তেমন প্রতিবাদ না থাকে?
বিরাজমান জ্ঞানের সঙ্গে মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত নতুন জ্ঞানের সংঘর্ষের ফলেই মানব সমাজের জ্ঞান বৃদ্ধি ঘটে। অতএব, মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত এই নতুন জ্ঞান তাকে প্রকাশ করতে দিতে হবে। তা না হলে সমাজে জ্ঞান-বৃদ্ধি ঘটবে না এবং সমাজ একদিন একটা বদ্ধ ডোবায় পরিণত হবে। প্রশ্ন হলো, বিরাজমান জ্ঞানের সঙ্গে নতুন জ্ঞানের সংঘর্ষ কীভাবে হবে? আলোচনা-সমালোচনা, বিতর্ক হলো সেই মাধ্যম, যা এই সংঘর্ষ তৈরি করে। বিতর্ক একটা সমাজ এবং দেশের মানুষের মাঝে গতি তৈরি করে। এ গতিই সমাজ এবং দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।
ইউরোপ যে জ্ঞান-বিজ্ঞানে অভূতপূর্ব উন্নতি করছে, তার মূলে ছিল বিতর্ক ও অন্যায়-অবিচার-বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করলে পরিষ্কারভাবে দেখতে পাই যে, ঐতিহাসিক কয়েকটি ঘটনা আজকের এই আধুনিক পৃথিবীর জন্ম দিয়েছে। যেমন পুনর্জাগরণ, ফরাসি বিপ্লব, শিল্পবিপ্লব প্রভৃতি। অর্থাৎ এসব ঘটনা না ঘটলে শিল্পবিপ্লব কখনোই মানবজাতির পক্ষে আজকের এই উন্নত জীবন অর্জন সম্ভব হতো না। কারণ, এই ঘটনাগুলো ব্যক্তির চিন্তা, কর্ম ও সৃজনশীলতার পথ খুলে দিয়েছিল।
কয়েক বছর আগে ফরাসির প্রাক্তন প্রেসিডেন্টের তিন বছরের সাজা হয়, কারণ তিনি দুর্নীতি করেছিলেন কোনো এক সময় যা আমাদের দেশে কোনো ব্যাপারই না। ফরাসি দার্শনিক ভলটেয়ারের বিখ্যাত উক্তিটি মনে পড়ে গেল, ‘আমি তোমার বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করি কিন্তু তোমার বক্তব্য প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আমি আমার জীবন দিতে প্রস্তুত।’ আমরা ভুলে গেছি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের শিক্ষা, ভুলতে শুরু করেছি স্বাধীনতা আন্দোলনের শিক্ষা। অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ভাষাগত অধিকারের জন্য কথা বলতে পারার নাম স্বাধীনতা। নিজের মতো করে ব্যক্তির কথা বলা, কথা শোনা ও কথা লেখার অধিকারের নাম স্বাধীনতা।
এসব অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হলে মূল্যহীন হবে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা, ব্যর্থ হবে শহীদদের চরম আত্মত্যাগ। ২০২৩ সালে এসে সেটা দেখা যাচ্ছে, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ তরুণদের মনে রাখেনি। তরুণদের মনে রেখেছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। এ আইনে বন্দিদের বেশির ভাগই তরুণ। এ কারণে তরুণরা আন্দোলন করছে তরুণ বিরোধী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে। নতুন প্রজন্ম এ সরকারকে বিশ্বাস করতে চেয়েছিল। অনলাইনে বেশিরভাগ লেখকই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অনুকূলে। কিন্তু কী হয়েছে? সরকার তাদের পরিত্যাগ করেছে। অনেকের অপমৃত্যু সরকার ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছে।
অনেক লেখক-সাংবাদিক-শিল্পী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে আটক হয়েছেন, নির্যাতিত হয়েছেন। সরকার আর রাষ্ট্র এক নয়। অথচ সরকার আর রাষ্ট্রকে এক করে ফেলা হয়েছে। সরকারের বিরোধিতাকে রাষ্ট্রবিরোধী বলে আখ্যায়িত করে দমন-পীড়ন চালানো হচ্ছে। তাহলে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর দোষ কোথায় ছিল? পাকিস্তানি সামরিক জান্তারা ১৯৭০ সালে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে পারলো অথচ আমরা সেই রকম একটি নির্বাচন করার যোগ্যতাও হারিয়েছি। আজ তরুণদের সকল অধিকার হরণ করে নিয়ে তাদেরকে বোবা করে দেওয়া হচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কারণে জবানের স্বাধীনতা ধ্বংস করা হচ্ছে। সত্যকে সঠিকভাবে প্রকাশ করার মতো সাহস জাতির কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। স্বাধীন করেছিলাম বাংলাদেশ পরাধীন হয়ে বেঁচে থাকার জন্য নয়, এ বিষয় আমরা একমত নিশ্চয়ই। আমরা যদি একমত সত্যিই হই তবে গণতন্ত্রের বেস্ট প্র্যাকটিসে বাঁধা কেন?
আমরা দৈনন্দিন নানা সমস্যার সমাধানে বিজ্ঞানের দ্বারস্থ হই। সব সমস্যার ভিন্নতা ভেদে বিজ্ঞানেরও কিছু আলাদা সুপ্রতিষ্ঠিত শাখা গড়ে উঠেছে। যেমন পদার্থবিদ্যা যেমন প্রকৃতির গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, রসায়ন বিভিন্ন মৌলের পারস্পরিক পরিবর্তন এবং জীববিজ্ঞান শারীরতত্ত্বের ওপর কাজ করে, ঠিক তেমনি নৈতিকতা মানুষ ও প্রাণীর আচরণ এবং মানসিক প্রক্রিয়া সম্বন্ধে অনুধাবন করে থাকে। বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখার মতোও এটা যথেষ্ট তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে পরীক্ষা ও গবেষণামূলক একটি বিজ্ঞান। যদি শুধু নৈতিকতা নিয়ে গবেষণা করি গবেষণা হয়তো শেষ হবে নৈতিকতা শেখা হবে না। কারণ আমাদের জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিটি কার্যকলাপের ওপর আমাদের আচরণের প্রভাব রয়েছে। নৈতিকতা মানুষের মানসিক প্রক্রিয়া এবং আচরণের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করতে পারে। নৈতিকতা মানুষের মনের কার্যকলাপ, সংগতি, বিচ্ছিন্নতা, অনুভূতি ও মানসিক সমস্যার সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান প্রদান করে।
সমাজে যারা মানসিক বৈকল্যের শিকার, তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের সেবার জন্য আমাদের নৈতিকতার জ্ঞান দ্বারস্থ হতে হয়। কেননা, নৈতিকতা জীবন, সমাজ তথা গণতন্ত্রের বড় একটা অংশ, এটাকে উপেক্ষা করে বিশ্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। আর এ জন্য নৈতিকতার প্রচার ও প্রসার অবশ্যই প্রয়োজন। গণতন্ত্রে যদি নৈতিকতা না থাকে তবে সে গণতন্ত্র পরিপূর্ণতা লাভ করতে পারবে না।
লেখক: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
সারাবাংলা/এসবিডিই
গণতন্ত্রের পরিপূর্ণতা পেতে নৈতিকতারও দরকার মুক্তমত রহমান মৃধা