সংঘাত নয়, চাই সম্প্রীতিময় রাজনীতি
২৭ জুলাই ২০২৩ ১৬:৫৩
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভাষায় রাষ্ট্র জনগনের জন্য। সেই রাষ্ট্রকে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনার জন্য একটি সরকার থাকবে। রাজনৈতিক দল থেকে সেই সরকার গঠিত হবে। সরকার জনগনের জন্য কাজ করবে। সরকার গঠনের সবচেয়ে উত্তম পন্থা সংসদীয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতি। গণতন্ত্র সম্পর্কে আব্রাহাম লিঙ্কনের সেই সংজ্ঞাটি শতাব্দি থেকে শতাব্দি গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয়। তার মতে গণতন্ত্র হল ‘জনগণের দ্বারা গঠিত, জনগণের জন্য এবং জনগণের সরকার’ (government by the people, for the people, of the people)। কিন্তু বাস্তবে তা কতটুকু দৃশ্যমান?
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। অর্থ্যাৎ বাংলাদেশও সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশ। কিন্তু প্রতিদিনই দেশে গণতন্ত্র নেই বলে মন্তব্য করছে জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। কিন্তু গণতন্ত্র না থাকলে এই কথাটি বলতে পারত না বা তা প্রচার হত কি না সেটা মনে হয় ভেবে দেখা হচ্ছে না।
ক্ষমতার বাইরে থাকলেই রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্র বাস্তবায়নে মরিয়া হয়ে ওঠে যার প্রমাণ বিএনপি ও আওয়ামীলীগ সকল দলের ক্ষেত্রেই রয়েছে। অথচ ক্ষমতায় গেলে তাদের গণতন্ত্রের সংজ্ঞা পরিবর্তন হয়ে যায়। কিন্তু গণতন্ত্র তো জনগণের জন্য। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিজেদের পাশে জনগণ আছে আর বিরোধীদের জনগণ চায় না বলে বিস্ফোরক মন্তব্য করে কিন্তু মূলত জনগন সাথে আছে এমন কোন কাজ করে না। আমার কাছে মনে হয় দোহায় দিয়ে তারা চলতে পছন্দ করে।
২৭ জুলাই রাজধানীতে মহাসমাবেশের ডাক দিয়েছে বিএনপি। তাদের ভাষায়, সরকার পতনে তারা ওইদিন শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশ করবে। এদিকে একই দিনে ঢাকায় ‘শান্তি সমাবেশ’ করার ঘোষণা দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দুটি সহযোগী সংগঠন যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ এবং ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ। বিএনপি মহাসচিব গত ২২ জুলাই রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘তারুণ্যের সমাবেশ’ থেকে ২৭ জুলাইয়ের কর্মসূচির ডাক দিয়েছেন। অপরদিকে সোমবার (২৪ জুলাই) আওয়ামী লীগের দুই সহযোগী ও একটি ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন যৌথ সংবাদ সম্মেলন ডেকে ২৭ জুলাই বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের দক্ষিণ গেটে ‘শান্তি সমাবেশ’ করার ঘোষণা দিয়েছে।
এর আগে যুবলীগ ২৪ জুলাই তাদের ধারাবাহিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে রাজধানীতে বিভাগীয় ‘তারুণ্যের জয়যাত্রা’ সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছিল। প্রথমে তারা ওই কর্মসূচির তারিখ পরিবর্তন করে ২৭ জুলাই পুনর্র্নিধারণ করে। পরে যুবলীগ ‘তারুণ্যের জয়যাত্রা’ কর্মসূচিটি পরিবর্তন করে অন্য দুটি সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে একই দিনে এবং একই স্পটে ‘শান্তি সমাবেশ’ করার ঘোষণা দিয়েছে। সোমবার যৌথ সংবাদ সম্মেলন করে নতুন এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। যুবলীগ তারুণ্যের জয়যাত্রা সমাবেশ ডেকেছিল ডিজিটাল বাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশে উন্নীতকরণের লক্ষ্য সামনে রেখে। অপরদিকে ‘বিএনপি-জামায়াতের হত্যা-ষড়যন্ত্র, নৈরাজ্যের’ প্রতিবাদে শান্তি সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে বলে তারা জানিয়েছে।
২৭ জুলাই রাজধানীতে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। বিপরীত মেরুর দুই রাজনৈতিক শিবিরের কর্মসূচিকে ঘিরে এই সংঘাত ও সংঘর্ষের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ওই দিন রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিএনপির তরফ থেকে সংঘাতের আশঙ্কা করে ক্ষমতাসীনদের কর্মসূচির তারিখ পরিবর্তনের আহ্বান জানানো হয়েছে। অপরদিকে আওয়ামী লীগ সংঘাতের আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়েছে। কোনও উসকানি দেবে না বলেও আশ্বস্ত করা হয়েছে। তবে কেউ সংঘাত-সংঘর্ষে লিপ্ত হলে সরকারি দল হিসেবে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দেবে তারা।
গণতান্ত্রিক দেশ তাই কর্মসূচি পালন গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু কর্মসূচিগুলো কাদের নিয়ে কাদের জন্য? তারা কি এই কর্মসূচি চেয়েছিল? জনগণের নিরাপত্তা দেওয়ার দায়িত্ব সকলের কারণ সকল দলই প্রচার করে তারা জনগণের জন্য কাজ করছে। কিন্তু রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হলো কেন? এই প্রশ্নের উত্তর তাদের কাছে নেই। তাঁরা শুধু বিপক্ষ দলকে দোষারোপপ করতে পারে।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) গত ১০ বছরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৩ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত রাজনৈতিক সংঘাত ঘটেছে ৬ হাজার ১২৬টি। এসব সংঘাতে নিহত হয়েছেন ১ হাজার ৪০০ জন। এ ছাড়া আহত হয়েছে ৮৩ হাজার ১৭ জন। এরমধ্যে আওয়ামী লীগের ৩৯২ জন ও বিএনপি’র ৮৪ জন নেতাকর্মীর মৃত্যু হয়েছে। এই দুই রাজনৈতিক দল ছাড়াও অন্য দলের নেতাকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মৃত্যুও রয়েছে। এ ছাড়া ৩১৩ জন সাধারণ মানুষও নিহত হয়েছেন এই ১০ বছরে। দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম ও নিজস্ব সোর্সে সংগৃহীত তথ্যের আলোকে প্রতিবছর হালনাগাদ প্রকাশ করে মানবাধিকার সংস্থাটি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ এগিয়ে না নিয়ে বুর্জুয়া ধারায় রাজনীতি হচ্ছে। এতে করে সংঘাত হচ্ছে এবং মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। দেশে যথার্থ নির্বাচন হবে, নির্বাচনের মধ্যে ক্ষমতা পরিবর্তন হবে। কিন্তু সেটি হচ্ছে না। সমঝোতাহীন ও বুর্জুয়া রাজনীতির অংশই হচ্ছে এই সংঘাত।
এইসব ঘটনা প্রধানত আওয়ামী লীগ ও বিএনপি জড়িত ছিল৷ এর বাইরে নিজেদের অভ্যন্ত রীণ কোন্দলও সংঘাতের জন্ম দিয়েছে৷ নির্বাচন, নির্বাচন প্রতিরোধ এবং মাঠ দখলে রাখার চেষ্টা ছিল সহিংসতার প্রধান কারণ।
মানুষ হিসেবে আমরা সবসময় ভাল দিকটি নিজের করে পেতে চাই। রাজনৈতিক দল তার ব্যতিক্রম নয় কারণ এর প্রধান একজন মানুষ। তাই ভাল দিকটির দাবিদার হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সম্প্রীতির সম্পর্ক দেখতে চায়। দেখতে চাই জনগণের জন্য রাজনীতি। সংঘাতময় কর্মসূচি এড়িয়ে সহ-অবস্থানের রাজনীতি দেখতে চাই। দেশ এগিয়ে যাচ্ছে দেশকে নিয়ে ভাবনায় একমত দেখতে চাই। তবেই রাজনীতি হবে দেশের জন্য। তাছাড়া আপনারা যতই সংবাদমাধ্যমে প্রচার করেন আপনি দেশের জন্য কাজ করছেন জনগণ তা ধিক্কার দিবে। আগে দেশের স্বার্থে উন্নয়নের স্বার্থে একমত হোন তারপর বলেন জনগণ পাশে রয়েছে। তাছাড়া জনগনকে বিক্রি করে খাওয়া ছাড়া কিছু আমার ভাবনার মধ্যে আসে না। সমস্যা যেখানে সমাধান সেখানে। তাই সংঘাত নয় চাই সম্প্রীতিময় রাজনীতি। নিরাপদ হোক রাজপথ।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই