যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার নিয়ে প্রশ্ন করবে কে?
২৮ জুলাই ২০২৩ ২০:৪৯
মিসৌরির সেন্ট লুইসের হ্যাম্পটন অ্যাভিনিউয়ে গত ১৮ জুলাই একটি গ্যাস স্টেশনে বাংলাদেশি যুবক ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে গুলি করে হত্যা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যের ফিনিক্স শহরের কাছে ক্যাসাগ্রান্ডে এলাকায় স্থানীয় সময় রোববার সকালে এ ঘটনা ঘটে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম টুইট করে এ তথ্য জানিয়েছেন। ২৫ জুলাই এক টুইটে তিনি লিখেছেন, ‘গত পাঁচ দিনে যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিতীয় বাংলাদেশি নিহত হওয়ার খবরে আমরা আতঙ্কিত। সর্বশেষ শিকার আবুল হাশিম।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘এর আগে নিহত ইয়াজউদ্দিন আহমেদ উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলেন। এই মুক্তিযোদ্ধার ছেলে লেখাপড়ার খরচ জোগাতে মুদির দোকানে কাজ করতেন।’
‘যুক্তরাষ্ট্রে গত ৫ দিনে দ্বিতীয় বাংলাদেশি নিহত হওয়ার ঘটনায় আমরা আতঙ্কিত। সর্বশেষ শিকার হলেন আবুল হাশিম। এর আগে নিহত ইজউদ্দিন আহমেদ উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যান। মুক্তিযোদ্ধার ছেলে মুদির দোকানে কাজ করে লেখাপড়ার খরচ মেটাতেন।’
অ্যারিজোনায় বাংলাদেশি কমিউনিটির নেতা ও ফোবানার সাবেক চেয়ারম্যান মাহাবুব রেজা রহিম জানান, রোববার সকাল সাড়ে ৭টায় কাসাগ্রান্ডে সিটির সানল্যান্ড জিন রোড ও ওয়েস্ট কনকর্ডিয়া ড্রাইভে অবস্থিত সানলাইট মার্কেটে কুমিল্লার আবুল হাশিম ঘটনাস্থলেই মারা যান। হাশেমের একটি ৬ বছরের ছেলে ও দুই বছরের একটি মেয়ে রয়েছে। তার অন্য ভাইবোনরাও একই শহরে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী হামলায় এক বাংলাদেশি যুবক নিহত হয়েছেন। মিডিয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, ঘটনাটি মিসৌরির সেন্ট লুইসের হ্যাম্পটন অ্যাভিনিউর ১১০০ ব্লকের বিপি গ্যাস স্টেশনে ঘটে। এর আগে ৪ জানুয়ারি কেমব্রিজের চেস্টনাট স্ট্রিটে ম্যাসাচুসেটস পুলিশের গুলিতে সাঈদ ফয়সাল নামে আরেক তরুণ বাংলাদেশি নিহত হন।
যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশ বা সন্ত্রাসীদের হাতে বাংলাদেশি নিহত হওয়ার ঘটনা নতুন নয়। বাংলাদেশ বা যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদপত্রে প্রায়ই এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের খবর পাওয়া যায়; কিন্তু পরে তাদের তদন্ত বা বিচারের কোনো খবর নেই। ২০১৫ সালে বাংলাদেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১২ থেকে ২০১৫ এই তিন বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন হামলায় ছয় বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। ২০১৫ সালের অক্টোবরে ফ্লোরিডা রাজ্যে সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোশতাক আহমেদ।
একই বছরের আগস্টে আরেক মর্মান্তিক হামলায় নিহত হন ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম। ২০১৩ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুক্তরাষ্ট্র শাখার নেতা নাজমুল ইসলাম নিউইয়র্কের ওজন পার্কে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হন। ২০১২ সালে আওয়ামী লীগের আরেক নেতা বেলাল তরফদার কানেকটিকাটে দুর্বৃত্তদের হামলায় নিহত হন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র পরিচালক এবি মানিকও ২০১৪ সালের আগস্টে নিহত হন। একই সময়ে সন্ত্রাসীদের হাতে কামাল উদ্দিন নামে একজন ক্যাব চালক নিহত হন। তার লাশ পড়ে ছিল রাস্তায়।
২০১৫ সালে, যখন যুক্তরাষ্ট্রে একের পর এক বাংলাদেশি নিহত হচ্ছিল, তখন বাংলাদেশেও দুই বিদেশি নাগরিককে হত্যা করা হয়েছিল। ঢাকায় ইতালীয় নাগরিক সিজার তাভেল্লা এবং রংপুরে জাপানি নাগরিক কুনিও হোশি হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে মার্কিন দূতাবাস বেশ তৎপর ছিল।
আমাদের মিডিয়াও বেশ জোরালোভাবে প্রচার করেছে। কিন্তু এর বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যার বিষয়ে আমরা কোনো জোরালো প্রতিবাদ বা কূটনৈতিক তৎপরতা দেখিনি। এমনকি তখনকার কর্মরত রাষ্ট্রদূত বার্নিকাটকে বিভিন্ন সংবাদ সম্মেলনেও এ বিষয়ে কোনো জোরালো প্রশ্ন করা হয়নি।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড প্রায় প্রতিদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা প্রতিনিয়ত সংবাদপত্রে পড়ি বন্দুকধারীরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের চ্যাম্পিয়ন’-এর গালভরা উপাখ্যান পরে হামলা চালাচ্ছে। নিউজ এজেন্সি এপি, ইউএসএ টুডে এবং বোস্টনের নর্থইস্টার্ন ইউনিভার্সিটির যৌথ গবেষণা-আর্কাইভ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২৮টি বন্দুক হামলা হয়েছে এবং ১৪০ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, প্রায় প্রতি সপ্তাহেই দেশের কোথাও না কোথাও বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেছে। মার্কিন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, ২০১৭ সালে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ২২৪টি, ২০১৯ সালে ২১১টি, ২০২০ সালে ৬১০টি, ২০২১ সালে ৬৯২টি এবং ২০২২ সালে ৬৪৮টি।
কিন্তু এসব হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রশাসনের কোনো উদ্যোগ বা তৎপরতার খবর নেই, কোনো মামলা বা বিচারের খবর নেই। দেশের অবস্থা এতটাই নাজুক যে, তারা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গিয়ে মানবাধিকার রক্ষার নামে সেসব দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে।
বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশে নির্বাচন, শাসনব্যবস্থা ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে গত কয়েক মাসে যতটা ব্যয় করেছে, তার নিজের দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের জন্য খুব বেশি খরচ করেনি। তা না হলে অন্তত ছয় মাসের ব্যবধানে তিন বাংলাদেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হতেন না।
২০২৩ সালের জানুয়ারিতে সৈয়দ ফয়সালকে হত্যাকে ঘিরে বিভিন্ন বিক্ষোভের কথা ইতিমধ্যেই উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে প্রতিবাদ আসার সাথে সাথে বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী বাংলাদেশীরাও প্রতিবাদে যোগ দেয়। এটা নিয়ে লেখালেখি ও আলোচনা শুরু হয়েছে মিডিয়ায়। এরপর হঠাৎ করে ২৪ মে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি জে ব্লিঙ্কেন নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেন। সংখ্যাটি খুব বেশি জটিল হওয়া উচিত নয় যদি আপনি দুটি দুই দ্বারা চারটি মেলে। বিভিন্ন কারণে, অভিবাসনে আগ্রহী বাংলাদেশীরা তাদের পছন্দের তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রকে রাখে। দেশের ভিসা পেতে ঝামেলাও বেশি।
গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও আমরা মনে করি, সাঈদ ফয়সালসহ বিভিন্ন সময়ে নিহত বাংলাদেশিদের নিয়ে রাজপথে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় শুরু হওয়া প্রতিবাদকে দমন করাই ছিল মার্কিন প্রশাসনের মূল উদ্দেশ্য। এর আগে, ১০ ডিসেম্বর, ২০২১-এ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ (রাজস্ব বিভাগ) এবং স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা র্যাবের সাতজন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাকে অনুমোদন দেয়। তাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের এমন একতরফা সংজ্ঞা সত্যিই বিরল।
প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কি এসব বিষয়ে শক্ত অবস্থান নিতে পেরেছে? ‘অসন্তোষ’, ‘ক্ষোভ’ বা ‘বিক্ষোভ’ প্রকাশের মতো মৃদু উদ্যোগ নিয়েও আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় শক্ত কূটনৈতিক অবস্থান নিতে পারেনি। না করার অনেক কারণ আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি। বাংলাদেশের মতো একটি দেশ চাইলেও এমন একটি পরাশক্তির সঙ্গে প্রকাশ্য কূটনৈতিক লড়াইয়ে নামতে পারে না।
তা ছাড়া বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিও ভারসাম্যপূর্ণ পন্থা অনুসরণ করে। ফলে মার্কিন আধিপত্যবাদী কূটনীতির মুখে ‘গো স্লো পলিসি’ গ্রহণ করা ছাড়া বাংলাদেশের জন্য আর কী কার্যকর হতে পারে? কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে যেভাবে বাংলাদেশি নাগরিকদের হত্যা করা হচ্ছে এবং প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনার খালি বাণী দিচ্ছেন, তাতে বাংলাদেশ আর কতদিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের শিকার হবে সেটাই বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
লেখক: আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক, গবেষক
সারাবাংলা/এজেডএস