Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী হত্যা ও মানবাধিকার প্রসঙ্গ

তানজিব রহমান
৩০ জুলাই ২০২৩ ১৭:১৫

বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মার্কিন দূতরা যখন মানবাধিকার রপ্তানি কিংবা রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপে ব্যস্ত তখনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একের পর এক বন্দুক সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। খালি হচ্ছে হাজারও মায়ের বুক। হারিয়ে যাচ্ছে তরুণ তাজা প্রাণগুলো। একটি আধুনিক সভ্যদেশে নরহত্যা, বন্দুক সহিংসতা, মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনা বার বার ঘটবে তা কারোরই কাম্য নয়।

বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বিশ বছরের তরুণ মার্কিন নাগরিক সৈয়দ ফয়সাল আরিফ হত্যার ছয় মাস না পেরুতেই আবারও আবুল হাসিম নামে ৪২ বছর বয়সী ও ইয়াজ আহমেদ রমিম নামে ২২ বছর বয়সী আরেক বাংলাদেশী তরুণকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সন্ত্রাসী আক্রমণের শিকার হয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের সেন্ট লুইস শহরের হ্যাম্পটন এভের ১১০০ ব্লকের একটি গ্যাস স্টেশনে কাজ করতেন ইয়াজ আহমেদ রমিম। চলতি বছরের ১৮ জুলাই কাজের সময় বাইরে দাঁড় করানো ইয়াজের গাড়ির কাঁচ ভেঙে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে একদল সন্ত্রাসী। ইয়াজ তাদের বাধা দিলে এক বন্দুকধারী তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। তাতেই প্রাণ যায় ইয়াজের। এর পাঁচ দিনের মাথায় (২৩ জুলাই) যুক্তরাষ্ট্রের আরিজোনা স্টেটে ফিনিক্স সিটির অদূরে কারা গ্রান্দে এলাকায় নিজ গ্রোসারি স্টোরে বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হয়েছেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানাজায় চলতি বছরের প্রথম দিকে ফয়সাল আরিফ হত্যার কোন বিচার এখন পর্যন্ত করতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র যা বিচারপ্রত্যাশী পরিবারগুলোর কাছে আরও বেশি হতাশাজনক।

বিজ্ঞাপন

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম সিএনএনের তথ্যমতে ২০২৩ সালের শুরু থেকে ২৪ জুলাই পর্যন্ত ৪০৭টি বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলার ঘটনা বিগত সময়ের চেয়ে কয়েকগুন বেড়েছে। তাদের এ প্রতিবেদন বলছে যা অতীতের যে কোন সময়ের প্রথম ছয় মাসে (জানুয়ারী- জুলাই) বন্দুক হামলার রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। ২০২১ সালেও প্রথম ছয় মাসে প্রায় ৪০০ বন্দুক সহিংসতার ঘটনা ঘটে যার গতি কেবলই বেড়ে চলেছে। মানবাধিকার নিয়ে অন্যকে পরামর্শ দেওয়া যুক্তরাষ্ট্র নিজ ভূখণ্ডের মানুষের জীবনের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। প্রতিদিনই সেখানে কেউ না কেউ বন্দুক সহিংসতায় প্রাণ হারাচ্ছেন। ওয়াশিংটন ভিত্তিক অলাভ জনক সংস্থা ‘Gun Violence Archive’ এর তথ্য অনুযায়ী এ বছরের শুরু থেকে এ পর্যন্ত বন্দুক সহিংসতায় যুক্তরাষ্ট্রে ২৪ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে হত্যার শিকার হয়েছেন ১০৭৮৭ জন আর বন্দুক ব্যবহার করে আত্মহত্যা করেছেন ১৩৫৯৬ জন। যার মধ্যে ০-১১ বছর বয়সী শিশু ১৬৩ জন, ১২-১৭ বছর বয়সী ৮৫৮জন তরুণ কিশোর হত্যার শিকার হয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক সহিংসতা কতটা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, গান ভায়োলেন্স আর্কাইভের এ পরিসংখ্যান থেকেই তা স্পষ্ট। তবে মৃত্যুর এ বিশাল সংখ্যা শুধু বন্দুক হামলার নয়, বন্দুক দিয়ে আত্মহত্যার ঘটনাও এতে অন্তর্ভুক্ত। গান ভায়োলেন্স আর্কাইভের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, এ সময়ে যে পরিমাণ প্রাণহানি ঘটেছে, তার বেশিরভাগই আত্মহত্যা। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ৫ শতাংশের বাস যুক্তরাষ্ট্রে হলেও সাধারণ মানুষের হাতে থাকা অস্ত্রের ৪৬ শতাংশই রয়েছে মার্কিন নাগরিকদের হাতে। ব্যক্তি মালিকানাধীন অস্ত্র ও ম্যাস শ্যুটিং উভয় ক্ষেত্রে তালিকার শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতেই প্রাণ গেছে প্রায় ১০০০ জনের বেশি মানুষের। আর এসব হামলায় বাদ যাচ্ছে না বাংলাদেশী প্রবাসীরাও। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে পুলিশের গুলিতে মারা যাওয়া বাংলাদেশি তরুন ফয়সালকে হত্যাকারীর বিষয়ে শ্বেতাঙ্গ পুলিশের এখনো তদন্ত শুরু হয়নি বরং সে বহাল তবিয়তে চাকুরীতে নিযুক্ত আছে। আর রমিমকে হত্যাকারী সন্ত্রাসী হাতকড়া পরা অবস্থায় পুলিশের কাছ থেকে পালিয়ে গেছে। এই হচ্ছে বিশ্বকে মানবাধিকারের সবক দেওয়া মোড়লদের দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি।

মার্টিন লুথার কিং এর আজীবনের লালিত স্বপ্ন ছিল বর্ণবৈষম্যহীন একটি দেশ হবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যার জন্য তিনি জীবনভর লড়াই সংগ্রামও করেছেন। বলা হয়ে থাকে, জর্জ ওয়াশিংটন আমেরিকাকে স্বাধীনতা এনেদিয়েছিলেন, আব্রাহাম লিংকন দিয়েছিলেন গণতন্ত্র, তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সভ্য করেছেন মার্টিন লুথার কিং। তার নেতৃত্বে কালো মানুষ পেয়েছে সাদা মানুষের সমান অধিকার, আর সাদা নাগরিকরা পেয়েছে বর্ণবাদের অভিশাপ থেকে মুক্তি! আসলেই কি মুক্তি মিলেছে? তবে কেন প্রতিবছর বর্ণবাদের কারণে বন্দুক সহিংসতায় হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারায়? স্কুল, সুপার মার্কেট, পেট্রোল পাম্প, রেস্তুরা, পার্ক কিংবা উপাসনালয়ে কেন বন্দুক সহিংসতার মতো ঘটনা গুলো অনবরত ঘটে যাচ্ছে। খালি হচ্ছে ফয়সাল বা রমিমদের মায়ের বুক। যুক্তরাষ্ট্রের পথে পথে ‘স্টপ পুলিশ ব্রুটালিটি’ স্লোগানে কেন মানুষ রাস্তায় নামে? কেন মানুষ বারবার বর্ণবাদী আচরণে পুলিশকে অভিযুক্ত করছে? কেন মানবাধিকার শুধু সাদা আর কালোর দেয়ালে দ্বৈতরূপ পরিগ্রহ করে? এ প্রশ্ন এখন সবার মনে থাকলেও নয়া সাম্রাজ্যবাদের নেশায় উন্মত্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যস্ত আছে অন্য দেশে মানবাধিকারের ঠিকাদারি নিয়ে। কোন দেশে আরব বসন্ত হবে কোন দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ দখল করার নতুন ফাঁদ পাতা যাবে ব্যার্থ আফগান যুদ্ধ শেষে কবে আবার রাশিয়া ইউক্রেনে নিজেদের অস্ত্র গোলা বারুদের সফল দোকান খুলতে পারবে। কিন্তু নিজেদের দেশে যে হাজার হাজার মানুষ বিচার বহির্ভূত হত্যার শিকার হচ্ছে তা কে বোঝাবে!

বলার অপেক্ষা রাখে না বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিশ্চয়ই তাদের থেকে অনেক ভালো। মানবাধিকার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলার যৌক্তিক কারণ রয়েছে। ইরাকের কাছে গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র আছে —এই অজুহাত দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণ করেছিল। তাতে লাখ লাখ বেসামরিক মানুষ মারা যায়। আমেরিকার ব্রাউন ইউনিভার্সিটি এক হিসাবে বলা হয়, অন্তত ১ লাখ ৮৪ হাজার থেকে ২ লাখ ৭ হাজার বেসামরিক মানুষ আমেরিকার হামলার কারণে মারা গেছে। যুক্তরাষ্ট্র পরে স্বীকার করেছে যে ইরাকের কাছে কোনো গণবিধ্বংসী অস্ত্র ছিল না। মার্কিন ব্রাউন ইউনিভার্সিটির ‘যুদ্ধের মূল্য’ শীর্ষক গবেষণা থেকে জানা যায়, ১ লাখ ৭৪ হাজার মানুষ সরাসরি আফগান যুদ্ধে নিহত হয়। তাদের মধ্যে ৪৭ হাজার বেসামরিক মানুষ। খোদ যুক্তরাষ্ট্রে কালো মানুষদের পুলিশ যেভাবে বিনা বিচারে গুলি করে হত্যা করে, গলায় বুট ঠেসে ধরে শ্বাসরোধ করে মারে, তাতে মানবাধিকারই চিৎকার করে ওঠে, ‘উই ক্যান নট ব্রিদ’। আমেরিকার হাতভরা রক্ত আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দাগ পারস্যের সব সুগন্ধি ঢেলেও সেই হাতের গন্ধ দূর করা যাবে না। তাই দেশে দেশে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সুরক্ষার মানবাধিকার বুলি পরিহার করে নিজ দেশে শিশু কিশোর ও বিদেশী নাগরিকদের মানবাধিকার রক্ষায় অধিক নজর দেওয়া সময়ের দাবি।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

তানজিব রহমান মুক্তমত যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশী হত্যা ও মানবাধিকার প্রসঙ্গ

বিজ্ঞাপন

সিইসি ও ৪ কমিশনারের শপথ আজ
২৪ নভেম্বর ২০২৪ ০১:৩৩

আরো

সম্পর্কিত খবর