কিংবদন্তি সাংবাদিক আবদুস সালামকে কতটুকু জানি
৩ আগস্ট ২০২৩ ১৪:০৮
প্রখ্যাত সাংবাদিক, দ্য বাংলাদেশ অবজারভারের সাবেক সম্পাদক মরহুম আবদুস সালামের ১১৩তম জন্মবার্ষিকী আজ। ১৯১০ সালের এই দিনে ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার দক্ষিণ ধর্মপুর গ্রামের ঐতিহ্যবাহী মুন্সীবাড়িতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
তুখোড় মেধাবী ছাত্র আবদুস সালাম সম্পর্কে তার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু আবদুর রশিদ লিখেছেন, “আবদুস সালাম শুধু সাহিত্যের পাঠকই ছিলেন না; ছিলেন কোমল মনের অধিকারী, আবেগপ্রবণ একজন সমাজ ও স্বজাতি সচেতন ব্যক্তিত্ব।”
আরেক খ্যাতনামা প্রবীণ সাংবাদিক আবদুল ওহাব লিখেছেন, “এ দেশের ভালো মাথার অধিকারীদের মধ্যে সালাম একজন। আবদুস সালাম ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র থাকার পরও প্রচণ্ড ভালোবাসতেন বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতিকে।”
সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত আবদুস সালাম ভাষা আন্দোলনে প্রথম কারাবরণকারী সম্পাদক ছিলেন। এ ছাড়া তিনি পাকিস্তান সম্পাদক পরিষদের সভাপতি, সাবেক পূর্ব-পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য, বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা মহাপরিচালক ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ১৯৩১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে তিনি প্রথমস্থান অর্জন করে এমএ পাশ করেন।
বাঙালি কর্মকর্তাদের নিপীড়নের প্রতিবাদে ১৯৪৯ সালে সরকারি উচ্চপদস্থ চাকরি ছেড়ে আবদুস সালাম তৎকালীন সবচেয়ে অনিরাপদ পেশা সাংবাদিকতাকে বেছে নেন, যোগ দেন পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় সহকারী সম্পাদক হিসেবে। পরের বছর তিনি পত্রিকাটির সম্পাদকের দায়িত্ব নেন। তখন ভাষা আন্দোলনের টালমাটাল সময়। এ সময়েই তিন মহারথী সম্পাদক আবদুস সালাম, জহুর হোসেন চৌধুরী, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার মধ্যে গভীর সখ্য তৈরি হয়। এ আন্দোলনে অবজারভার ও অবজারভার সম্পাদকের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।লেখালেখির মাধ্যমে পত্রিকাটি তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষা করায় মুসলিম লীগ সরকার ১৯৫২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পত্রিকাটি নিষিদ্ধ করে এবং পরদিন তাকে গ্রেফতার করে। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এলে পত্রিকাটি পুনঃপ্রকাশিত হয়।
১৯৫২ সালে একটি সম্পাদকীয় লেখায় অবজারভার বন্ধ করে দেওয়া হয়। তখন অবজারভারের সম্পাদক আবদুস সালাম। আবদুস সালামকে কারাগারে নেওয়া হয় কিন্তু তিনি তাতে এতটুকু বিচলিত ছিলেন না। ষাটের দশকে ফের কারাগারে যান আইয়ুব সরকারের সমালোচনা করে সম্পাদকীয় লিখে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, স্বাধীন দেশেও সম্পাদকীয় লিখে জেলে যেতে হয়েছে আবদুস সালামকে, যা আমাদের ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়।
যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসাবে ১৯৫৪ সালে আবদুস সালাম পূর্ব-পাকিস্তান আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। পাকিস্তান সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ছিলেন তিনি। সরকারের সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় ১৯৭২ সালে অবজারভার ত্যাগ করতে তিনি বাধ্য হন। ১৯৭৬ সালে তার পরামর্শে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বাংলাদেশ প্রেস ইসস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। প্রেস ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা মহাপরিচালক নিযুক্ত হন আবদুস সালাম। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি এ পদে ছিলেন। ১৯৭৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি আকস্মিক হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৬৬ বছর বয়সে আপসহীন সম্পাদক সাংবাদিকতার বাতিঘর আবদুস সালাম মৃত্যুবরণ করেন। দীর্ঘ ২২ বছর তিনি অবজারভার পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে প্রমাণ করেছেন নিজের যোগ্যতা, সততা আর কী করে সত্য প্রকাশ করতে হয়। তখনকার ভঙ্গুর সাংবাদিকতাকে তিনি নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, তার হাতেগড়া প্রতিষ্ঠানগুলো তাকে মনে রাখেনি। এমনকি তার জন্ম ও মৃত্যুদিবসটুকুও ওভাবে পালিত হয় না।
কিংবদন্তিতুল্য সাংবাদিক আবদুস সালাম ব্যক্তিগত চিন্তা না করে যেভাবে সত্য লিখেছেন জীবনভর, সত্যের প্রশ্নে, জাতির বৃহত্তর স্বার্থে সেভাবে অটল ছিলেন, বর্তমান প্রজন্মের সাংবাদিক ও সম্পাদকরা তা অনুসরণ করে সে পথে চললে বর্তমানে করুণ অবস্থায় থাকা এদেশের গণমাধ্যমজগতে সুদিন ফিরবে। অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়তে যে সাংবাদিকতা আবদুস সালাম করে গেছেন, তা বর্তমান প্রজন্মের কাছে শিক্ষণীয় হয়ে আছে।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
ইমরান ইমন কিংবদন্তি সাংবাদিক আবদুস সালামকে কতটুকু জানি মুক্তমত