ডিজিটাল বন্ধুত্বের ফাঁদে প্রকৃত বন্ধুত্ব
৬ আগস্ট ২০২৩ ১৪:৫৬
প্রযুক্তির এই যুগে বন্ধুর সংখ্যা বাড়ে লাফিয়ে লাফিয়ে। কারও এক হাজার, কারও দুই হাজার আবার কারও তার চেয়েও বেশি। কেউ আবার কিছুদিন পরপরই বন্ধুর তালিকা থেকে কাউকে মুছে দিচ্ছে। এই তো হালের ডিজিটাল বন্ধুত্ব। এই বন্ধুত্ব হতে যেমন সময় লাগে না আবার ভাঙতেও সময় লাগে না। এখানে বন্ধুত্ব হয় স্বার্থে! অথচ একজন প্রকৃত বন্ধু পেতে যেমন সময় লাগার কথা, বন্ধুত্ব ভাঙতেও সময় লাগার কথা। বন্ধু কখনো বন্ধুকে ছেড়ে যায় না। আর তাই ডিজিটাল মাধ্যমে পরিচিতজনের তালিকায় থাকা কে বন্ধু আর কে অবন্ধু তা নির্ণয় করার কোনো উপায় নেই। কারণ এসব বন্ধুত্ব যেমন হয় মোবাইলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সেভাবেই আবার বন্ধুত্ব বাতিলও করা যায়! আবার বন্ধুর ছদ্মবেশে আসলে কে আমার পাশে আছে সেটাও প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়। অথচ একজন প্রকৃত বন্ধু একটি জীবনকে পরিবর্তন করতে পারে। আর বন্ধু শত শত বা হাজার হাজার হওয়ার কোনো দরকার নেই। দু’চারজন হলেই তা যথেষ্ট। এখন প্রশ্ন হলো কে বন্ধু হতে পারে? এর উত্তর হলো- মা,বাবা,ভাই বা বোন থেকে শুরু করে শিক্ষক বা অন্য যে কেউ বন্ধু হতে পারে। একজন মা তার সন্তানের সবচেয়ে ভালো বন্ধু হতে পারে। আজকাল তো সেই পরামর্শই দেওয়া হয়। আর বাইরের যারা বন্ধু হয় তাদের কতজন শেষপর্যন্ত মনে রাখে তা তো আমরা জানি। আবার বন্ধুর নাম ধরে বন্ধুর বুকে ছুরি মারার ঘটনাও ঘটছে অহরহ। তাই বলা যায়, আজকাল অনেক বন্ধু হলেও সত্যিকারের বন্ধুত্বের আকালই চলছে। বন্ধু নাম ধরে আমরা যাদের চিনছি বা জানছি তারা কেউ বন্ধু নয়। কারণ এদের বেশিরভাগই প্রয়োজনের সময় পিছটান দেয়। আপনি হয়তো যাকে বন্ধু ভাবছেন দেখা যায় সেই আপনার ক্ষতি করার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। আবার বন্ধুর জন্য জীবন উৎসর্গ করার ঘটনাও সেই প্রাচীন ইতিহাস থেকে আজ পর্যন্ত চলে আসছে। প্রাচীন সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকেই মূলত বন্ধুত্বের সম্পর্কের শুরু হয়েছে। আমরা তাকেই বন্ধু বলি যে আমার পাশে থেকে আমাকে উৎসাহ,অনুপ্রেরণা,ভুল ধরিয়ে দেওয়া এবং বিপদে এগিয়ে আসে। যদিও এতকিছু আজকাল তেমন কেউ করে না। তারপরও তাকেই বন্ধুত্ব বলা যায়, নচেৎ নয়। পরিচিত মাত্রই আমরা তাকে বন্ধুত্ব বলতে পারি না। একক্লাসে পড়ালেখা করলেও সে বন্ধু হয় না, ক্লাসমেট হয়। আর বন্ধু হতে হলে এক ক্লাসে পড়ার দরকার নেই, এক পাড়ায় থাকার দরকার নেই। দরকার কেবল অন্তরের আকুলতা। যাকে ভালোবাসাও বলা যায়। প্রকৃত বন্ধুত্ব ভালোবাসতে শেখায়, ঘৃণা করতে নয়। এই যে আজ আমাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে হাজার হাজার বন্ধু, আমি একটি পোষ্ট দিলেই শত শত লাইক কমেন্টেসে ভরে উঠছে। শুভকামনা দেওয়ার হিড়িক পরছে। এসবকেই বন্ধুত্ব ভাবছেন? তাহলে আপনি বোকার স্বর্গে আছেন। বন্ধুত্ব এত সহজও নয়। আপনার শূণ্যতা কারও অনুভূত হচ্ছে কি না, কেউ আপনাকে ভাবছে কি না বা আপনার অনুপস্থিতি কারও মনে দাগ কাটছে কি না সেটা বিবেচনা করতে হবে। বুঝবেন সেই আপনাকে বুঝতে পারে অর্থাৎ বন্ধু হতে পারে। সবাই বন্ধু হতে পারে না। শত্রু হওয়া যতটা সহজ ব্যাপার বন্ধুত্ব ততটাই কঠিন। বন্ধু হতে তার যোগ্যতা প্রমাণ করতে হয়।
বন্ধুত্ব বা বন্ধু নিয়ে এত কথা লিখতাম না। কিন্তু আগষ্ট মাসের প্রথম রবিবার বন্ধু দিবস হিসেবে সারা বিশ্ব পালন করে থাকে। এই দিনে বন্ধুরা একে অপরকে উপহার দেয়, সবাই মিলে পার করে কিছুটা বাড়তি সময়। কবে কোথায় প্রথম এর সূচনা হয়েছিল তা নিয়ে একাধিক মত প্রচলিত আছে। তবে বেশ কিছু ইতিহাস থেকে ধারণা করা হয় ঊনবিংশ শতাব্দির ত্রিশ থেকে চল্লিশ দশকের মধ্যবর্তী সময়ে বন্ধ দিবস পালন করার রীতি আরম্ভ হয়। প্রথম দিকে কিছু কার্ড তৈরিকারী প্রতিষ্ঠান বন্ধু দিবসের পালন শুরু করে। বন্ধুরা একে অপরকে কার্ড ও অন্যান্য গিফট উপহার দিয়ে এদিনটি পালন করতো। ধারণা করা হয় ১৯৩৫ সালের দিকে আমেরিকাতে প্রথম বন্ধু দিবস পালন শুর হয়। পরে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে তা ছড়িয়ে যায়। আবার একই সাথে প্যারাগুয়ের নামও শোনা যায়। ১৯৫৮ সালে সর্বপ্রথম ৩০ শে জুলাই বন্ধুত্ব দিবস পালনের প্রস্তাব করা হয়। তবে ২৭ এপ্রিল ২০১১ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ৩০ জুলাই অফিসিয়ালি আন্তর্জাতিক বন্ধু দিবস ঘোষণা করে। কিন্তু ভারতসহ অনেক দেশই আগষ্ট মাসের প্রথম রবিবার বন্ধু দিবস পালন করে আসছে। আত্মার সাথে সম্পর্ক থাকলে হয় আত্মীয় আর বন্ধু। বন্ধুর অবস্থান তো আত্মা, অস্থি মজ্জায় মিশে একাকার হয়ে থাকা। তবে কিনা আজকাল বন্ধুর অভাব নেই। ফেসবুক, স্কাইপে এরকম অনেক ভার্চুয়াল বন্ধুত্বের কি আর অভাব আছে। এসব বন্ধুর কোনটা যে আসল আর কোনটা নকল তাও কি ধরার ক্ষমতা আছে। বন্ধুত্বের এই অবাধ প্রাপ্যতার যুগে নিজের প্রোফাইলে থাকা মা, বাবা, ভাই, বোন সবাই বন্ধু। শুধু প্রোফাইলে ভারী ভারী সব পদবী দিলেই তা আসল ভেবে বন্ধু বানিয়ে নেই। যাচাই করার এত সময়ও নেই সুযোগও নেই। তাই বন্ধুর বেশে প্রতারণার হারও ক্রমেই বাড়ছে। বন্ধুর উপর বিশ্বাসে চিড় ধরছে। এত এত বন্ধুর ভিড়ে আসল বন্ধুটিকে চিনে নেওয়ার কাজটি একটু কঠিনই বটে। বন্ধু দিবস শুধু একটি দিনে বন্ধুকে পেট পুরে খাইয়ে বা দামী উপহার দিয়ে একদিনেই শেষ হওয়ার মত কোন সম্পর্ক নয় বরং বছরের প্রতিটি দিন একে অপরের পাশে থাকার নামই বন্ধুত্ব।
বন্ধু হবারও যোগ্যতা থাকা দরকার। এই যোগ্যতা কোন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া সার্টিফিকেটের যোগ্যতা নয়। এই যোগ্যতা কাছে আসার যোগ্যতা, অন্যকে বোঝার যোগ্যতা, ভালোবাসার যোগ্যতা এবং সর্বোপরি বন্ধুর জন্য ত্যাগ স্বীকার ও বিশ্বাস করার যোগ্যতা। এত এত যোগ্যতা আজ আর ক’জনের মধ্যেই বা আছে। তাই অল্পতেই আজকাল বন্ধুত্ব ভেঙে যায়। বিশ্বাসের অবনমন ঘটে। অথচ এই বিশ্বাসের ওপরই বন্ধুত্বের বাঁধন শক্ত হয়। যার বন্ধুর ওপর বিশ্বাস যত বেশি তারা তত ভালো বন্ধু। আমাদের কজনেরই বা আজ সে যোগ্যতা রয়েছে। আমরা তো কেবল স্বার্থ নিয়েই ব্যাস্ত থাকি। স্বার্থ ফুরালে চম্পট দেই। বন্ধুত্বের সুযোগে আঘাত করি। কিন্তু এই সমাজকে বাঁচাতে আজ নিঃস্বার্থ বন্ধুত্বের খুব দরকার। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে বন্ধুর প্রয়োজন হয় সবচেয়ে বেশি। তখন মানুষ হয় নিঃসঙ্গ। কিন্তু জীবনের বিভিন্ন সময় সাহচর্য পাওয়া বন্ধুরা তখন কে কোথায় থাকে তা জানাও যায় না। অন্তর দিয়ে কেবল সে সময়ের স্মৃতি হাতরানো ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। মনের কোণে সেই গান গুণ গুণ করে বাজে, ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই, কোথায় হারিয়ে গেলো সোনালি বিকেলগুলো সেই’।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
অলোক আচার্য ডিজিটাল বন্ধুত্বের ফাঁদে প্রকৃত বন্ধুত্ব মুক্তমত