বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বামদের সংকীর্ণতায় ক্ষুদ্ধ ছিলেন সন্তোষ গুপ্ত
৬ আগস্ট ২০২৩ ১৫:১৭
একাধারে তিনি প্রথিতযশা সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কলাম লেখক। অন্য দিকে রাজনীতিকও বলা যায়। আমৃত্যু সত্য ও সুন্দরের পক্ষে লড়ে যাওয়া এই অসাম্প্রদায়িক শুভবোধ সম্পন্ন আলোকিত মানুষটিকে আমরা অনেকটা ভুলেই গেছি।
দেশ বরেণ্য সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত আজীবন ছিলেন প্রগতিশীল চিন্তাকে ধারণ করেছেন। আশির দশকের শেষের দিকে বিশ্বে সমাজতন্ত্রের পতনের সেই সময়ে মানুষের বিশ্বাসের জগত যখন ভেঙে পড়েছিল সন্তোষ গুপ্ত তখনও দাঁড়িয়ে ছিলেন মানবতাবাদ, গণতন্ত্রের পক্ষে।
এই প্রজন্মের অনেকের কাছেই নামটি অজানা। এমনকি তরুণ প্রজন্মের সাংবাদিকদের কাছেও। দেশমাতৃকার এই কৃতিসন্তান সন্তোষ গুপ্ত সাংবাদিকতা ও সাহিত্যে অবদান রাখায় বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার স্বাধীনতা পদকসহ (মরণোত্তর) একুশে পদক, শেরেবাংলা পদক, বঙ্গবন্ধু পদক, মাওলানা তর্কবাগীশ পদক, জহুর হোসেন স্মৃতি পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার, পদক ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন।
সব সময়ই স্রোতের বিরূদ্ধে অবস্থান নিতেন সন্তোষ গুপ্ত। ১৯২৫ সালের ৯ জানুয়ারি ঝালকাঠি জেলার কীর্ত্তিপাশার রুনসী গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ছেলেবেলায় বাবা-কাকাকে হারান মাত্র ১৫ দিনের ব্যবধানে। তার মা কিরণবালা তাকে অনেক কষ্টে মানুষ করেন। হিন্দু বিধবাদের আচার-আচরণ মানলেও তিনি ছিলেন প্রগতিশীল। স্বামীহারা হবার পর থেকে কিরণবালাকে দীর্ঘকাল একবেলা আহার করতে হয়েছে। হিন্দু বিধবা হিসেবে বিকেলে খই বা রুটি খাওয়ার অবস্থাও তার ছিল না। ১৯৪৪ সালে সন্তোষ গুপ্ত চাকরি পাওয়ার পর তিনি রুটি ও ফল-মূল খাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। ছেলেবেলায় বইপড়ার প্রচণ্ড নেশা ছিল সন্তোষ গুপ্তের। একবার একনাগাড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৪৪টা কবিতা মুখস্থ বলে তিনি তার শিক্ষক মহেন্দ্রবাবুকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। তখন তিনি তাকে ‘সঞ্চয়িতা’ ও ‘চয়নিকা’ উপহার দিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথের পাশাপাশি তিনি ম্যাক্সিম গোর্কি, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, স্বামী বিবেকানন্দ ও কাজী নজরুল ইসলামের বই পড়েছিলেন। ছয় বছর বয়সে রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদি পড়তে শুরু করেন। সেই সময় ওই অজপাড়াগাঁয়ে মাত্র একটা ইংরেজি টু ইংরেজি অভিধান আর দু’টো ঘড়ি থাকলেও এবং এলাকায় সংবাদপত্র আসলেও কারো তেমন পড়ার আগ্রহ ছিল না। এ অবস্থায় সন্তোষ গুপ্তের লেখাপড়ার তীব্র স্পৃহা সত্যিই বিস্ময়কর ছিল।
সন্তোষ গুপ্ত কর্মজীবন শুরু করেন কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিংয়ে আইজি প্রিজন অফিসে ১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে। ১৯৪৫ সালে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর দেশভাগের সময় সন্তোষ গুপ্ত অপশন দিলেন পূর্ববঙ্গকে। কারণ তার দেশের বাড়ি ছিল বরিশাল। কলকাতায় থাকতেই সম্পর্ক ছিল কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে। ঢাকায় এসেও প্রথম সুযোগেই যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন। কারা বিভাগের আইজির অফিসে সন্তোষ গুপ্তের পোস্টিং হয়েছিল।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক বছরের মধ্যেই দমননীতি নেমে আসে কমিউনিস্ট পার্টির ওপর এবং গ্রেফতার হন সরদার ফজলুল করিম, রেলশ্রমিক মো. আবদুল বারী, সন্তোষ গুপ্ত এবং তার মা। পার্টির মধ্যে অনুপ্রবেশকারী পুলিশি চরের বিশ্বাসঘাতকতায় সন্তোষ গুপ্তের বাড়ি (যা ছিল ঢাকা জেলার হেড কোয়ার্টার) শেষ হয়ে যায়। জেলখানায় তাকে দেখে আইজি প্রিজন ভীষণ অবাক হয়ে বলেন, ‘তোমাকে ভুল করে ধরে এনেছে। আমি তোমার রিলিজের ব্যবস্থা করছি।’ সন্তোষ গুপ্ত বলেন, ‘ভুল হয়নি। পুলিশ ঠিক লোককেই ধরেছে।’ এরপর তিনি তিনবার জেল খাটেন। জেল থেকে বের হওয়ার পর ১৯৫৭ সালে ‘দৈনিক সংবাদে’ যোগদান করেন। তিনি ‘দৈনিক আজাদে’ও কাজ করেছেন। ১৯৫৮ সালে আইয়ুবের সামরিক শাসনের শুরুতেই তাকে আবার গ্রফতার করা হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কলকাতায় ন্যাপের মুখপত্র ‘নতুন বাংলা’র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালে সন্তোষ গুপ্ত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য বিভাগে কর্মরত ছিলেন। এমনকী জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি দৈনিক সংবাদের ‘সিনিয়র সহকারী সম্পাদক’ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০০৪ সালের ৬ আগস্ট মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে মারা যান তিনি।
বরেণ্য ব্যক্তিদের ভৌগোলিক সীমারেখায় আটকে রাখা যায় না। তারা দেশ ও জাতির সম্পদ। তারপরেও একই জেলায় জন্মগ্রহণ করায় শ্রদ্ধাভাজন সন্তোষ গুপ্তকে নিয়ে আমার গর্বের মাত্রাটা একটু বেশি । ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় হিন্দুরা পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি জমান, আর মুসলমানরা পশ্চিমবঙ্গ থেকে পূর্ববঙ্গে আসেন। কিন্তু সন্তোষ গুপ্ত কলকাতা থেকে জন্মভূমি বাংলাদেশে ফিরে আসেন। মাতৃভূমির প্রতি তার এই টান আর দেশপ্রেম এই প্রজন্মের কাছে নিঃসন্দেহে অনুকরণীয়।
সন্তোষ গুপ্ত ছিলেন একাধারে কবি, লেখক, সাংবাদিক, সমালোচক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার। দীর্ঘ প্রায় পাঁচ দশকের সাংবাদিকতা জীবনে বিভিন্ন পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। কবিতা, শিল্পকলা, চিত্রকলা, রাজনীতি, সাহিত্য, সাংবাদিকতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে তার ১৮টি গ্রন্থ রয়েছে। সম্পাদনা করেছেন বহু গ্রন্থ। তার ‘অনিরুদ্ধের কলাম’-এ দীর্ঘ দুই যুগে (১৯৭৮-২০০২) সহস্রাধিক কলাম লিখেছিলেন। এর বাইরেও তার লেখা সম্পাদকীয় ও অন্যান্য প্রবন্ধ-নিবন্ধের সংখ্যা ছিল অসংখ্য।
সাংবাদিকতা পেশায় আসার আগে বামধারার রাজনীতির সংগে যুক্ত ছিলেন সন্তোষ গুপ্ত। রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কারণে অনেক প্রতিকূল অবস্থায় পড়তে হয়েছে কর্মজীবনে। এমনকি হারাতে হয় চাকরিও। রাজনৈতিক কারণে তাকে একাধিকবার জেলেও যেতে হয়েছে। ১৯৭১ সালে তিনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য বিভাগে কর্মরত ছিলেন।
১৯৫৭ সালে সাংবাদিকতায় এসে তিনি প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে যুক্ত ছিলেন এই গণমাধ্যম জগতে। কর্মজীবনে সততা, দায়িত্ববোধ আর দক্ষতার যে নিদর্শন রেখে গেছেন, তা আমাদের চলার পাথেয়। সন্তোষ গুপ্ত সবসময় সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার অসংগতি, দুর্বলতা এবং রাজনীতিতে ডান আর বামের বিচ্যুতি নিয়ে খুবই অসন্তষ্ট ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা এবং ৩ নভেম্বর জেলের অভ্যন্তরে জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর অসাম্প্রদায়িকতা ও গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নেন সন্তোষ গুপ্ত। এ সময়ে বামদের সংকীর্ণতায় ক্ষুব্ধ ছিলেন তিনি। তথাপিও বিচ্যুত হন যৌবনের বিশ্বাস আর চেতনার বাম রাজনীতি থেকে। সেই অসন্তোষের প্রকাশ ঘটতো তার বিভিন্ন লেখনীতে।
সাম্প্রদায়িকতা আর অসত্যের বিরূদ্ধে আমৃত্যু রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন তিনি। তার দেশপ্রেম, সততা আর অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধ আমাদের অনুপ্রাণিত করুক আগামী দিনে চলার পথে। বিনম্র শ্রদ্ধা দেশ বরেণ্য এই গুণীজন সন্তোষ গুপ্তের স্মৃতির প্রতি।
লেখক: ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ সভাপতি ও বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যনির্বাহী সদস্য
সারাবাংলা/এসবিডিই
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বামদের সংকীর্ণতায় ক্ষুদ্ধ ছিলেন সন্তোষ গুপ্ত মানিক লাল ঘোষ মুক্তমত