আর কত বর্ষা হাঁটুজলে হাঁটতে হবে?
৭ আগস্ট ২০২৩ ১৬:১২
ক্যালেন্ডারের হিসেবে এখন আর বর্ষা আসে না। প্রকৃতি এখন তার নিজস্ব নিয়ম অনুসরণ করে। প্রকৃতি এখন আর কাগজ কলমে সীমাবদ্ধ নয়। ক্যালেন্ডারের হিসেবে এখন শ্রাবণের শেষ দিকে। অর্থাৎ বর্ষার শেষ সময়। অথচ বর্ষা সবে শুরু আমাদের শহরে। মজার বিষয় হচ্ছে কাগজ কলমে হিসেবে এদিক-সেদিক হলেও বর্ষা স্বমহিমায় প্রতিবছরেই আসে। আর যখন আসে তখন সবকিছুই বর্ষার পানিতে ভাসে। এতে সাধারণ মানুষ যতটা শান্তি পায় তারচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ে।
প্রতিবছরই বর্ষার পানিতে সড়ক, গলি, ঘর-বাড়ি ডুবে একাকার হয়ে যায়। কিন্তু এর সমাধান কোনো বছরই হয় না। হয় না বললে ভুল হবে, হবে না। জলাবদ্ধতার এই সমস্যা থেকে চট্টগ্রামের জনসাধারণ আদৌ কি মুক্তি পাবে? এই প্রশ্নের উত্তর এখন সাগর-রুনি হত্যা মামলার মতো প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাগর-রুনি হত্যা মামলা যেমন দিনের পর দিন পেছায়, ঠিক তেমনি এই প্রশ্নের উত্তরও দিনের পর দিন পেছায়।
টানা বৃষ্টি হলেই চট্টগ্রামের বেশিরভাগ এলাকা প্লাবিত হয়ে যায়। প্রতিবছরই এই একই সমস্যায় পড়তে হয় চট্টগ্রামবাসীর। এই সমস্যা নিয়ে বিষেশজ্ঞরা বলেন, চট্টগ্রামের সিটি কর্পোরেশন, সিডিএসহ বিভিন্ন দায়িত্বরত প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়হীনতার কারণে চট্টগ্রামবাসী প্রতি বছরই এই সমস্যায় পড়ে।
এটা তো শুধু সিটির ভেতরে সমস্যা। সিটির বাইরের সমস্যাগুলো কে দেখবে? সিটির ভেতরের দায় না হয় সিটিকর্পোরেশন, সিডিএ সহ বিভিন্ন প্রশাসনের উপর চাপিয়ে দিলাম। কিন্তু সিটির বাইরের অংশ নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যাথা নেই। অথচ সিটির বাইরে আরও নাজুক অবস্থা। চট্টগ্রামের সিতাকুণ্ড উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নে এই সমস্যা। অথচ স্থানীয় এমপি, চেয়ারম্যান, মেম্বারসহ কারও কোনো তদারকি নেই।
বর্ষায় চট্টগ্রামের বেশিরভাগ স্থানেই জলাবদ্ধতার ভোগান্তিতে পড়তে হয়। নগরবাসী জলাবদ্ধতার এই যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে প্রতিবছরই হায়-হুতাশ করে যায়, তবে কাজের কাজ কিছুই হয় না। জলাবদ্ধতা এবং বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হলো, অথচ সেটার কোনো সুফল চট্টগ্রামের নাগরিকগণ পেলো না। সেই আগের অবস্থায় আছে চট্টগ্রাম। অল্প বৃষ্টিতেই চট্টগ্রামের রাস্তা সাগরে পরিণত হয়ে যায়।
চট্টগ্রামের এই জলাবদ্ধতার সমস্যা এখন জাতীয় সমস্যায় রূপ নিয়েছে। এটা এই অঞ্চলের জনপদের জন্য গলার কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ এই সমস্যা সমাধান করতে পারছে না দায়িত্বরত কর্তপক্ষ। তাহলে কি তারা অপারগ? এটাও কি দায় নয়? যে কাজ আমি পারবো না, সেই চেয়ারে বসার অধিকার তো আমার নাই। অথচ অযোগ্যদেও হতেই এসব দায়িত্ব পড়ে আছে। যার কারণে প্রতি বছরেই জনসাধারণ এই ভোগান্তিতে পড়ে।
তবে বলে রাখা ভালো, এই সমস্যার জন্য দায়িত্বশীলদের পাশাপাশি আমাদের রয়েছে বেশকিছু দায়। দায় আমাদেরও আছে এটা আমরা নিজেরাই বুকে হাত দিয়ে অস্বিকার করতে পারি না। অথচ প্রতিবছরই আমরা সিটিকর্পোরেশন, সরকার, সিডিএ এদের উপর সু-কৌশলে চাপিয়ে দিয়ে নিজেরা এড়িয়ে যাই।
আপনার আমার বাড়ির পাশে ড্রেন, খাল, নালায় যে এতো এতো ময়লা, প্লাস্টিক পড়ে আছে এসব কি দায়িত্বশীলরা এসে ফেলেছে? অথচ জলাবদ্ধতার অন্যতম একটা কারণ এটি। এসব ময়লায় জ্যাম হয়ে যায় নালা-নর্দমা-খাল-সুয়ারেজ। নালায় দেখা যায় কাগজ, পলথিন, প্লাস্টিকের বোতল, ডিমের খোসা, ফলমূলের উচ্ছিষ্টসহ বিভিন্ন ধরনের ময়লা। এই-যে আমারা নিজেরা অনৈতিক কাজ করছি আবার সেই দায় আবার অন্যের উপর চাপিয়ে বড় গলায় কথা বলি এটা কতটা যৌক্তিক? আপনার আমার কি উচিত নয় এই স্বভাব থেকে বেরিয়ে আসা?
আমাদের শহরকে প্লাস্টিক মুক্ত করতে আমাদেরকেই সোচ্চার হতে হবে। আমাদের ড্রেন-নালা কিংবা খাল আমাদেরকেই পরিষ্কার করতে হবে। মানলাম আপনি পরিষ্কার করতে পারবেন না, কিন্তু আপনি ময়লা কেন করবেন? কেন নালায় আপনি প্লাস্টিকের বোতল, ঘরের আবর্জনা ফেলবেন? বৃষ্টিতে দেখাযায় রাস্তায় যেসব আবর্জনা আছে সেগুলোও নালায় গিয়ে পড়ে। তাই সড়ক-নালা এসব পরিষ্কার রাখতে হবে আমাদের।
আমি অনেককেই হাসি-তামাশা করতে দেখেছি ‘ইউরোপের রাস্তা’ কথাটি নিয়ে। একজন নায়ক এই কথাটি বলার পর থেকেই আমাদের দেশে প্রতি বর্ষায় ওই নায়ককে নিয়ে ট্রল হয়। সত্যি বলতে আমাদের রাস্তা আসলে ইউরোপের রাস্তার মতো হলেও জলাবদ্ধতা হবে। এর বড় কারণ আমরা। আমাদের মানসিকতা এখনও ইউরোপ আমেরিকার মতো হয়নি।
সাধারণ মানুষের সচেতনতার অভাব থাকার দায় কিছুটা প্রশাসনের উপরেও পড়ে। প্রশাসনের দায়িত্ব জনগণকে সচেতন করা। আমাদের ভেতর যদি সচেতনা তৈরী হয়, আমরা ৩০ শতাংশ মানুষও যদি সু-নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে পারি তাহলে যারা অসচেতন তারাদেরও আমাদের দলে নিয়ে আসতে পারবো। আমরা যদি পরিবেশ নোংরা করলেই প্রতিবাদ করি, সাথে সাথে সেটার বিরোদ্ধে অবস্থান নিই তাহলে অবশ্যই অবশ্যই এর মাত্রা কমে আসবে।
বাস্তবতা হচ্ছে আমরা পরিবেশকে যে পরিমাণ আবর্জনা দিই, এই বর্ষাকালে পরিবেশ সেটা আমাদের ফিরিয়ে দেয় জলাবদ্ধতার রূপ দিয়ে। এবং এই ফিরিয়ে দেওয়ার ধরণটা বেশ মারাত্বক। তাই এই জলাবদ্ধতার দায় শুধুমাত্র প্রশাসনের উপর দেওয়া যায় না। এই দায় আমাদেরও আছে।
সর্বোপরি বলতে চাই, প্রশাসনের সমন্বয় এবং জনসাধারণের সচেতনতা দুটোই জরুরী। তবে জনসাধারণকে সচেতন করাটাও প্রশাসনের দায়িত্বে পড়ে। তাই প্রশাসনকে এসব বিষয়ে আরও কঠোর হতে হবে। জলাবদ্ধতা বিষয়টাকে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। এই ভোগান্তি থেকে সাধারণ মানুষ মুক্তি চায়।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই