ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়
১৫ আগস্ট ২০২৩ ১২:১৭
“যতদিন রবে পদ্মা যমুনা গৌরি মেঘনা বহমান
ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।”
একজন পরাধীন জাতির মানুষদের স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করা এবং সঠিক নেতৃত্ব দেওয়া সহজ কাজ নয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তা সহজেই করেছিলেন। তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের সবচেয়ে কঠিন সময়গুলিতেও তার মানুষদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তার ছিল মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার মতো অসাধারণ বজ্রকণ্ঠ। তিনি ছিলেন একজন অনলবর্ষী বক্তা। তার বক্তৃতাগুলি মানুষকে অনুপ্রাণিত করত এবং স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে উৎসাহিত করত।
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। তার মৃত্যুতে বাঙালি জাতি শোকাহত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা ছিল বাঙালি জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে কালো অধ্যায়। ১৫ই আগস্ট জাতির জীবনের এক কলঙ্কময় দিন। এই দিবসটি জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পালন করে বাঙালি জাতি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের জাতির পিতা। তিনি আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। তিনি আমাদের জন্য অনেক কিছু করেছেন। আমরা তার ঋণ কখনই শোধ করতে পারব না। তিনি আমাদের মুক্তির প্রতীক। তিনি আমাদের সকল প্রেরণার উৎস। তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। তিনি আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন। কিন্তু তাকে সেনাবাহিনীর কিছু অফিসার হত্যা করেছে। এটা ছিল একটি দুঃখজনক ঘটনা। আমরা তাকে কখনই ভুলব না। আমরা তার স্মৃতিকে অমর করে রাখব।
১৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কলঙ্কিত দিন। এই দিনটিতে ঘাতকেরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে। এটি ছিল বাঙালি জাতির জন্য একটি বেদনাদায়ক দিন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন মহান নেতা, তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন। তিনি ছিলেন একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান মানুষ, তিনি সবসময় দেশের মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। ঘাতকেরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে বাঙালি জাতির অগ্রগতি থামাতে চেয়েছিল, কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আজও বাঙালি জাতির হৃদয়ে জ্বলজ্বল করছে। আমরা কখনই বঙ্গবন্ধুকে ভুলব না।
বঙ্গবন্ধু দেশ শাসন করেছিলেন অত্যন্ত সুনির্দিষ্ঠার সাথে। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ১১ই জানুয়ারি তারিখ হতে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানের শাসন কার্যকর ছিল। এ সময়ে অর্থাৎ মাত্র ৩ বছর ৮ মাসের মাথায় স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী শেখ মুজিবের একক ও সর্বাত্মক নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ দলীয় সরকারের পতন ঘটে ও নেতত্বের অবসান হয়। নিচে এর জন্য দায়ী কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা হলো।
সেনাবাহিনীর প্রতি উপেক্ষা_
আওয়ামী লীগ সরকার স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতি যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়নি। তারা পাকিস্তান ফেরত সামরিক অফিসারদের প্রতি বৈরী মনোভাব দেখিয়েছিল এবং তাদেরকে পদোন্নতি দেয়নি। তারা প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় কমিয়ে দিয়েছিল এবং রক্ষীবাহিনী তৈরি করেছিল, যার উপর তারা নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। এতে সেনাবাহিনীর মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছিল। মুজিব সরকারের দুর্নীতি এবং জনপ্রিয়তার হ্রাস সেনাবাহিনীর বিদ্রোহের পথকে প্রশস্ত করেছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর কিছু বিপদগামী অফিসার শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে।
রাজনৈতিক কারণ_
১৯৭৫ সালে আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী সংগঠন করে দেশের সমস্ত দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এতে গণতন্ত্রের মূলে কুঠারাঘাত করা হয়। জনসাধারণের মনে এ নিয়ে অসন্তোষ দেখা দেয়। সংশোধনীর পর দেশে স্বৈরশাসন প্রবর্তন করা হয়। চারটি বাদে সব সংবাদপত্র বন্ধ করে দেওয়া হয়। বিচার বিভাগের ক্ষমতা হ্রাস করা হয়। জনগণের মৌলিক অধিকার খর্ব করা হয়। এতে আওয়ামী লীগ সরকার জনসাধারণ হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
সামরিক অভ্যুত্থান_
সেনাবাহিনীর কিছু অফিসার সরকারের সঙ্গে অসন্তুষ্ট ছিল। সরকার তাদের সঙ্গে ভাল আচরণ করছিল না। জনগণও সরকারের সঙ্গে অসন্তুষ্ট ছিল। সরকারের জনপ্রিয়তা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছিল। এই সুযোগে কিছু অসাধু সেনা অফিসার ও স্বাধীনতা বিরোধীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা করে। তারা নির্মমভাবে তাঁকে সপরিবারে হত্যা করে। সামরিক অভ্যুত্থানের ফলে দেশে অস্থিরতা দেখা দেয়। অনেক মানুষ মারা যায়। অনেক মানুষ আহত হয়। অনেক মানুষ ঘরবাড়ি হারায়। সামরিক অভ্যুত্থান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার পরিবারের সাথে হত্যা করে সামরিক অফিসারদের একটি দল। বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা, বড় ছেলে শেখ কামাল, ছোট ছেলে শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী কামাল, ভাই শেখ নাসের, ভগ্নিপতি ও কৃষিমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার স্ত্রী বেবী সেরনিয়াবাত, পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, দৌহিত্র সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবু, ভ্রাতুষ্পুত্র শহদী সেরনিয়াবাত, ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, সামরিক সচিব কর্নেল জামিল আহমেদ এবং ১৪ বছরের কিশোর আবদুল নঈম খান রিনটুসহ ১৬ জনকে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা বিদেশে থাকায় বেঁচে যান।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডটি বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায়। এটি একটি গণতন্ত্র ও শান্তিপূর্ণ সমাজের উপর হামলা ছিল। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশ একটি অস্থিতিশীল সময়ের মধ্য দিয়ে যায়। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দেশে সামরিক শাসন চলতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডটি বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি বেদনাদায়ক ঘটনা। বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন মহান নেতা। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশের অর্থনীতি ও শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডটি বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি অপূরণীয় ক্ষতি।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর থেকে বাংলাদেশের জনগণ তার হত্যাকারীদের বিচারের দাবি করে আসছে। ২০১০ সালে, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের রায় ঘোষণা করে। রায়টিতে ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১৪ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এদের মধ্যে প্রধান আসামী ছিল মেজর জেনারেল রশিদ। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের বিচারটি বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি বড় বিজয়। এটি প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশের জনগণ তাদের অধিকারের জন্য লড়াই করতে ভয় পায় না। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের বিচারটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক।
পরবর্তিতে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি হয়। জনগনের অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মহামানব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শহীদ হবার পর দেশে সামরিক শাসন জারি করা হয়। গণতন্ত্রকে হত্যা করে মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। শুরু হয় হত্যা, ষড়যন্ত্রের রাজনীতি। কেড়ে নেয় জনগণের ভাত ও ভোটের অধিকার। বিশ্বে মানবাধিকার রক্ষর জন্য হত্যাকারীদের বিচারের বিধান। কিন্তু বাংলাদেশে জাতির জনকের আত্মস্বীকৃত খুনীদের বিচারের হাত থেকে রেহাই দেবার জন্য ২৬ শে সেপ্টেম্বর এক সামরিক অধ্যাদেশ (ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স) জারি করা হয়। জেনারেল জিয়াউর রহমান সামরিক শাসনের মাধ্যমে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স নামে এক কুখ্যাত কালো আইন সংবিধানে সংযুক্ত করে সংবিধানের পবিত্রতা নষ্ট করে। খুনিদের বিদেশে অবস্থিত করে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে করে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তার পরিবারের সদস্যদের সাথে হত্যা করা হয়। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর ১৯৯৭ সালে এই হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু হয়। ১৯৯৮ সালে বিচার শেষে ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার একটি দীর্ঘ ও কঠিন প্রক্রিয়া ছিল। অনেক বাধা ও প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও সরকার এই বিচারকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। এই বিচারের মাধ্যমে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের ন্যায় বিচার হয়েছে এবং বাংলাদেশের জনগণ একটি দীর্ঘদিনের অপরাধের জন্য বিচার পেয়েছে।
ধাপে ধাপে ১৫ আগস্টের বিচার কার্য চলমান থাকে। ১৪ নভেম্বর ২০০০ সালে হাইকোর্টে মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলে দুই বিচারক বিচারপতি মোঃ রুহুল আমিন এবং বিচারপতি এ.বি.এম. খায়রুল হক দ্বিমতে বিভক্ত রায় ঘোষণা করেন। এরপর তৃতীয় বিচারপতি মোঃ ফজলুল করিম ১২ জনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেন। এরপর ৫ জন আসামী আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল করে। ২০০২ – ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের সময় মামলাটি কার্যতালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। ২০০৭ সালে শুনানির জন্য বেঞ্চ গঠিত হয়।
২০০৯ সালে ২৯ দিন শুনানির পর ১৯ নভেম্বর প্রধান বিচারপতিসহ পাঁচজন বিচারপতি রায় ঘোষণায় আপিল খারিজ করে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। ২০১০ সালের ২ জানুয়ারি আপিল বিভাগে আসামীদের রিভিউ পিটিশন দাখিল এবং তিন দিন শুনানি শেষে ২৭ জানুয়ারী চার বিচারপতি রিভিউ পিটিশনও খারিজ করেন। এদিনই মধ্যরাতের পর ২৮ জানুয়ারি পাঁচ ঘাতকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। ঘাতকদের একজন বিদেশে পলাতক অবস্থায় মারা গেছে এবং ছয়জন বিদেশে পলাতক রয়েছে। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের দাবি ৩৪ বছর পর বাস্তবায়িত হলো।
১৫ই আগস্ট ঘটনার সঙ্গে যাঁরা জড়িত ছিলেন সেদিন এই ঘৃণিত হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিল কয়েকজন তরুণ। অসাধু সেনা কর্মকর্তা। এদের মধ্যে ১২ জন আসামীকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। এরা হলেন সেনা কর্মকর্তা সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, খন্দকার আবদুর রশিদ, বজলুল হুদা, শরিফুল হক ডালিম, এ এম রাশেদ চৌধুরী, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, এম এইচ এম বি নূর চৌধুরী, আজিজ পাশা (মৃত), মুহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি), রিসালদার মোসলেম উদ্দিন ও আবদুল মাজেদ। এদের মধ্যে পাঁচজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে।
১৫ আগস্ট প্রতিটি মূহুর্ত ছিল অমানবিক নির্যাতন। ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্ট ছিল বাঙালি জাতির জীবনের একটি কালো অধ্যায়। তাই জাতি এই দিনটি পালন করে শোকের মধ্য দিয়ে। কেননা যিনি জাতির জনক তাকেই যদি এভাবে নির্মমভাবে খুন হতে হয় তাহলে এর চেয়ে বড় বেদনার মুহূর্ত ঐ জাতির জন্য আর হয় না। তাই এই দিনটি এ দেশের ১৬ কোটি মানুষ গভীর বেদনার সঙ্গে স্মরণ করে।
লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই