নজরুল প্রসঙ্গ: বঙ্গবন্ধুর কূটনীতি
১৫ আগস্ট ২০২৩ ১১:৪৫
কবি নজরুল ইসলাম ক্রমশ অসুস্থ ও নির্বাক হয়ে যান ১৯৪২ সালে। এ সময় কবির চিকিৎসায় ব্যর্থ হয় লুম্বিনী পার্ক ও রাঁচির মানসিক হাসপাতাল। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কবি নির্বাকই ছিলেন। এই সময়ের মধ্যে ঘটে যায় অনেক ঘটনা। ঘটনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কবি ভারত থেকে চিরতরে বাংলাদেশে পাড়ি জমান। আর এর পেছনে ভূমিকা রেখেছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচক্ষণতাসম্পন্ন কূটনীতি।
সেসময় কলকাতার ক্রিস্টোফার রোডে একটি বাসায় থাকতেন কবি নজরুল। সদ্য গঠন হওয়া স্বাধীন বাংলাদেশে কবির জন্মদিন পালন করতে চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এ লক্ষ্যে শুরু হয় যোগাযোগ। স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনে ভারতের অবদান আর একই ভাষা-সংস্কৃতির বিষয়টি কবিকে বাংলাদেশে আনার জন্য ভূমিকা রেখেছিল। এই প্রস্তাবটিই পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপালকে করেছিলেন শেখ মুজিব। রাষ্ট্রনায়ক চেয়েছিলেন কবিকে ঢাকায় নিয়ে যেয়ে মহা ধুমধামে জন্মদিন পালন করতে।
তাৎক্ষণিক বিষয়টি নিয়ে সাড়া পড়লেও এখানে কিছু প্রশাসনিক জট ছিল। কারণ ভারত সরকারের মতামতের ব্যাপার ছিল, কবি পরিবারের ইচ্ছার ব্যাপারটিও ছিল। যখন দুই দেশের ইচ্ছা-অনিচ্ছার প্রশ্ন উঠে আসে তখন এর সমাধান কূটনীতির মাধ্যমেই হতে হবে। এক্ষেত্রে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী অবদান রাখলেন।
কবিকে দেশে নিয়ে চান এমন প্রস্তাব ইন্দিরা গান্ধীকে দেন বঙ্গবন্ধু। ভারতের সরকারপ্রধান ছাড়াও বঙ্গবন্ধু কবি পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। তবে এখানেই কূটনীতির শেষ হয়নি। কবিকে আনার বিষয়টি তখনও ঝুলেই ছিল। বঙ্গবন্ধুর এই ভারত সফর ৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ছিল। কবির জন্মদিন আসতে তখনও ২-৩ মাস বাকি। কবিকে বাংলাদেশে আনার জন্য শুরু হয় চিঠি দেওয়া নেওয়া, নানান চিন্তাভাবনা।
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও আস্থাভাজনের মাধ্যমে কবি পরিবারের অনুমতি সাপেক্ষে বাংলাদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেন। অর্থাৎ শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরোধ রক্ষার মাধ্যমে দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও প্রীতি ও শ্রদ্ধার উদাহরণ সৃষ্টি করেছিল।
স্বাধীনতা যুদ্ধে নজরুলের লেখা, গানে উজ্জীবিত ছিল মুক্তিকামী মানুষেরা। কবি নির্বাক থাকলেও কবির সৃষ্টি নির্বাক ছিল না। এই শ্রদ্ধাবোধ থেকে কবির জন্মদিন পালন করার লক্ষ্যে যে আগমন ঘটে সেখানেও নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হতে চলেছে এটা অবশ্য দুই দেশের কেউ ভাবেননি।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধানের সেই আমন্ত্রণে জ্যেষ্ঠ পুত্রবধূ উমা কাজী ও অন্যান্য আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে পা রাখলেন কবি। ঠিক জন্মদিনের আগের দিনে। মানুষের ভিড় ঠেলে সেদিন কবিকে আনতে হয়েছিল। কবিকে দেখার ব্যাকুল আগ্রহে ছিলেন বাংলাদেশের মানুষ। আবাসস্থল হয় ধানমণ্ডির কবিভবনে। সেখানে রাষ্ট্রীয় সম্মানের সঙ্গে কবিতে রাখা হয়। বাংলাদেশে কবিকে পাঠানোর অবশ্য একটা সময়সীমা ছিল। সেই সময়সীমা ছিল সাত দিন। সাময়িক একটা যাত্রার বিষয়টা ভাবা হলেও কবির ভালোমন্দ কী হচ্ছে এই প্রশ্নও সামনে আসে।
বাংলাদেশে আসার পর কবির সেবাযত্ন খুব ভালোভাবেই চলছিলো। মানুষের ভালোবাসা, শ্রদ্ধা পাচ্ছেন। এমন অবস্থা থেকে কবি পরিবার আস্থা রাখলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের উপর।
কলকাতার ক্রিস্টোফার রোডে থাকার সেই সময়গুলোয় কবি যখন কিছুটা আড়ালে চলে যাচ্ছেন, সেই সময়ের বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই আমন্ত্রণ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে কবি নজরুল স্বীকৃতি পেলেন বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে। এরপর কবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধি পান। কবিকে দেওয়া হয় বাংলাদেশের নাগরিকত্ব। কবি নজরুল ভূষিত হন একুশে পদকেও।
এমন অনেক কবি-লেখকেরা রয়েছেন যারা নিজের দেশ ছেড়েছেন ভয়ে বা অনিরাপত্তায়। কিন্তু কবি নজরুলের দেশ ছেড়ে এই আগমন ছিলেন সম্পূর্ণ আলাদা। কবি নজরুলও দেশান্তরী তবে তাকে অভাবনীয় রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিয়ে রাষ্ট্রনায়ক শেখ মুজিবুর রহমান এবং দেশের মানুষ বরণ করে নিয়েছিল। নির্বাক কবি মৃত্যুবরণ করেন ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট। তবে তার সৃষ্টি আজীবন প্রাসঙ্গিক থেকে গেলো এপার-ওপার বাংলা তথা বিশ্বব্যাপী। কবিকে বাংলাদেশে আনার সময়সীমা নির্ধারিত থাকলেও আমৃত্যু কবি এ দেশেই যথাযোগ্য মর্যাদায় থেকে গেলেন। এটা কেবল বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণতারই ফল।
লেখক: শিক্ষার্থী, নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই
নজরুল প্রসঙ্গ: বঙ্গবন্ধুর কূটনীতি মুক্তমত সিফাত শাহরিয়ার প্রিয়ান