Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আদর্শের হয়না মরণ; শোক থেকে হোক জাগরণ

এফ এম শাহীন
১৫ আগস্ট ২০২৩ ১৪:৩৩

কালের প্রতিটি মুহূর্তে মানুষ তার নিকটতম পূর্ববর্তী অতীত অভিজ্ঞতা নিয়ে পুনর্জন্ম গ্রহণ করে। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রসহ পৃথিবীর সকল কিছুই তার জন্মের উপাদান হিসেবে কাজ করে। আগস্ট যেমন বাঙালির শোকের মাস, তেমনি আগস্ট মানে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হারিয়ে আবার ফিরে পাওয়ার সময়। তিনি হয়ে উঠেন শোকে কাতর এক দিকভ্রান্ত জাতির আলোর দিশারী, সকল সঙ্কটে মুক্তির ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত সর্বময়। যার মানবমুক্তির দর্শনে বাঙালি আজ স্বাধীন ও মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে নিজের আত্মপরিচয় নির্মাণ করেছে।

বিজ্ঞাপন

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বাঙালির জাতির পিতা শেখ মুজিবের দেহবিনাশ হলেও প্রতি-দিন-প্রতি-ক্ষণ কোটি কোটি বাঙালি নতুন করে আবিষ্কার করেছে বাঙালির জাগরণের এই মহাজাদুকরকে, পুনর্জন্ম দিয়েছে তাদের অন্তরে, সংগ্রামে, প্রতিবাদে, বঞ্চনায় ও অধিকারের লড়াইয়ে। যে দর্শন পাকিস্তানী মতাদর্শের প্রেতাত্মারা থামিয়ে দিতে চেয়েছিল, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ইতিহাসের কালোরাতে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে। সেদিন ধানমণ্ডির বাসভবনে বঙ্গবন্ধুকে যখন সপরিবারে হত্যা করা হয়, ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি। তাদের হাতে একে একে নির্মমভাবে প্রাণ হারিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল ও ১০ বছরের শিশু শেখ রাসেলসহ পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামালসহ অনেকে। সেদিনের সেই ভয়াল বীভৎসতা স্মৃতিতে আনলে পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্ট খুনিও বোধ হয় আঁতকে উঠবে।

বিজ্ঞাপন

পৃথিবীর ইতিহাসের এক নির্মম হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে যারা ভেবেছিল শেখ মুজিবের দেহের বিনাশের মাধ্যমে মুছে ফেলা যাবে বাঙালির মন ও মনন থেকে। তার ছবিগুলো মুছে ফেললে হারিয়ে যাবে প্রতিকৃতি। হাজার হাজার বানানো মন গড়া শব্দ লিখে গল্প ফাঁদা যাবে ভিন্নরূপে। কিন্তু তারা ভুলে গিয়েছিল ইতিহাস আর সময়কে বাঁধ দিয়ে বেঁধে রাখা যায় না। ইতিহাস তার পথ নির্মাণ করে নেয় আপন গতিতে। ইতিহাস তার মহানায়ককে খুঁজে নেয় আপন মহিমায়। মিথ্যা বানোয়াট তথ্য মানুষ ছুড়ে ফেলে সঠিক সময়ে আবর্জনার স্তূপে। তাই উল্টোপথে হেঁটেও বহু চেষ্টার পরেও শেখের বেটা মুজিবকে বাঙালির অন্তর থেকে মুছে ফেলা যায়নি বরং বারংবার ফিরে এসেছে তাদের স্বপ্নের স্বদেশে মহাকালের এক অবিনশ্বর চরিত্র ধারণ করে।

বাঙালির হৃদয় জয় করে এখনো তার আর্দশ বাঙালির হৃদয়রাজ্যে রাজত্ব করছে। টুঙ্গিপাড়ার সেই খোকা আর কেউ নয়, বাঙালির ইতিহাসের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান, বাঙালি জাগরণের মহান জাদুকর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই জনদরদী মহান নেতা মানুষের মুক্তির জন্য আজীবন লড়াই সংগ্রাম করে গেছেন। (১৭ মার্চ ১৯২০- ১৫ আগস্ট ১৯৭৫) ৫৪ বছর বয়সের জীবনে বঙ্গবন্ধু ৪ হাজার ৬৮২ দিন কারাগারে ছিলেন, যা তার মোট জীবনের সিকিভাগ।

ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রাম দিয়ে শুরু। পরবর্তীতে বাঙালির ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকাও অসীম এবং গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এক অনন্য অবিস্মরণীয় দিন। এই দিনে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সর্বাত্মক সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। এটাই ছিল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে তথা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এ দেশে প্রথম সফল হরতাল। এই হরতালে শেখ মুজিব নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়ে গ্রেফতার হন। বাঙালি জাগরণের এই মহাজাদুকর বাংলাদেশের স্বাধীনতা আনা পর্যন্ত সারাজীবনের এক-চতুর্থাংশ সময় কারাগারেই কাটতে হয়েছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। বাঙালির মুক্তির জন্য এতো বড় আত্মত্যাগ আর কেউ করেনি।

যে মহান নেতা পরিবার পরিজনকে বঞ্চিত করে সারা জীবন বাঙালির অধিকার আদায়ের মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছেন, বাঙালির সকল আন্দোলোন সংগ্রাম-জাগরণের বাতিঘর হয়ে লড়াই করেছেন, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া ছুটে চলেছেন, অকুতোভয়ে হাজার বছরের পরাধীনতার জাল ছিন্ন করতে মহান মুক্তিযুদ্ধের জন্য বাঙালিদের তৈরি করেছেন- তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ছিলেন তার কর্মীদের প্রাণের মুজিব ভাই। সেই ৭ মার্চ ১৯৭১ এর ভাষণ আজ বিশ্ব ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ দলিলে পরিণত হয়েছে। যে ভাষণে ৭ কোটি বাঙালির মুক্তির কথা উঠে এসেছে মহাকাব্যিক ব্যঞ্জনায়। ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম…, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তার আপসহীন সাহসী নেতৃত্বে বাঙালি পেছে স্বাধীনতা। তারই উদাত্ত আহ্বানে মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ বীর বাঙালি জীবন বিলিয়ে দিতে দ্বিধা করেনি।

তবে আজ যখন দেখি চকচকে মলাটে আর রঙ্গিন পর্দার আড়ালে বাহারী বর্ণিল আয়োজনের মধ্যে মানবমুক্তির শোষিতের কণ্ঠস্বরকে আবদ্ধ করা হয়। তার আজীবন লড়াইয়ের ইতিহাসের সহযোদ্ধাদের নিয়ে কটূক্তি করা হয় প্রকাশ্যে। তার আদর্শ থেকে দূরে সরে পুঁজিপতিদের প্রতিনিধিত্ব করে তারই রক্ত ঘামে সংগঠিত সংগঠন। বৈষম্যহীন ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ নির্মাণে যে মানুষটি আমৃত্যু সংগ্রাম করলেন, আত্মত্যাগ করলেন আজ তাদের উত্তরসূরিরা সেই সকল অপশক্তির সাথে আপোষকামিতায় দ্বিধাহীন। তখন তার আদর্শিক সন্তানদের বুকের মাঝে ভীষণ রক্তক্ষরণ হয়। তারা নীরবে-নিভৃতে কেঁদে কেঁদে চোখের জল মুছে। তখন বড় শঙ্কা জাগে মনে ভোগ-উপভোগ- সম্ভোগের রাজনীতির বেড়াজাল ছিন্ন করে ফিরতে পারবে তো ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তে রঞ্জিত প্রাণের স্বদেশ।

মনে পড়ে জাতির পিতার অসাধারণ সংশয়োক্তি। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,”আমার দলে নব্য-ধনীরাও আছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ায় তাদের আরও বড় ধনী হওয়ার সুযোগ বেড়ে গেছে, আমি তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যে’ই দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেছি এবং দেশকে গড়ে তোলার জন্য জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছি। যদি এই ব্যবস্থা সফল করতে ব্যর্থ হই এবং কোনো কারণে আমার মৃত্যু ঘটে, তা হলে দলকে কবজা করে ওরা আরও উন্মত্ত হয়ে উঠতে পারে, এমনকি স্বাধীন বাংলাদেশের মূল মন্ত্রে শত্রু পক্ষের নীতি ও চরিত্র অনুসরণ করে আওয়ামী লীগেরও চরিত্র ও নীতি পাল্টে ফেলতে পারে। যদি তা হয় সেটাই হবে আমার দ্বিতীয় মৃত্যু। সেজন্য আগেই বলেছি আমার দল, আমার অনুসারীদের হাতেই যদি আমার এই দ্বিতীয় মৃত্যু ঘটে, তাহলে দীর্ঘকালের জন্য বিস্মৃতির অন্ধকারে চলে যেতে হবে। কবে ফিরবো তা আমি জানি না।”

আজ এই শোকের মাসে সঙ্গত কারণেই নবীন প্রজন্মকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই- নিজের জীবনের চেয়েও দেশ আর দেশের মানুষকে যিনি ভালোবেসে ছিলেন, ফাঁসি নিশ্চিত জেনেও যিনি পাকিস্তানের কারাগারে বসে আপোস করেননি স্বাধীনতার প্রশ্নে, যিনি বারবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বলেছিলেন, এ দেশের স্বাধীনতা আর জনসাধারণের আর্থ-সামাজিক মুক্তির কথা, এ জাতি তারই উত্তরসূরি।

যিনি ১৫ আগস্ট কালরাতে ঘাতকদের মেশিনগানের মুখেও ছিলেন অকুতোভয়, প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তোরা কী চাস? কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?- বাঙালি জাগরণের এই মহাজাদুকরের দৈহিক বিনাশ ঘটলেও তার আদর্শের মৃত্যু হতে পারে না। মানুষ মরে যায়, আদর্শ মরে না। তাই বঙ্গবন্ধু কোন ব্যক্তিমাত্র নন, অবিনশ্বর এক আদর্শ ও প্রেরণার নাম। সেই প্রেরণাতেই এগিয়ে যাবো আমরা। বাঙালির সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের মানবমুক্তির দর্শনে বলীয়ান হয়ে গড়বো প্রাণের স্বদেশ।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, গৌরব ’৭১, সংগঠক, গণজাগরণ মঞ্চ

সারাবাংলা/এসবিডিই

আদর্শের হয়না মরণ; শোক থেকে হোক জাগরণ এফ এম শাহীন মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

নতুন ইসির শপথ রোববার দুপুরে
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১৪:২৩

আরো

সম্পর্কিত খবর