মুজিবের বাংলায় সোনার মানুষ কবে হবে?
১৫ আগস্ট ২০২৩ ১৬:১৩
অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান সেই তরুণ বয়স থেকেই। নির্লোভ-নির্মোহ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। দেশভাগের পর বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানের জাতীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন, তখন অনেক সিনিয়র নেতার দুর্নীতি দেখে প্রকাশ্যেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। যুক্তফ্রন্টে যোগ দিয়ে নির্বাচন করার সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু মাওলানা ভাসানীকে বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়লাভ করবে, ভয়ের কোনো কারণ নেই। আর যদি সংখ্যাগুরু না হতে পারে আইনসভায় আওয়ামী লীগই বিরোধী দল হয়ে কাজ করবে। রাজনীতি স্বচ্ছ থাকবে, জগাখিচুড়ি হবে না। আদর্শহীন লোক নিয়ে ক্ষমতায় গেলেও দেশের কাজ হবে না। ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধার হতে পারে।’
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে বঙ্গবন্ধু আরও লিখেছেন, ‘আদর্শহীন অনৈতিক ব্যক্তিদের সমন্বয়ে কোনো দল সংগঠিত হলে সেটি দেশের বা দেশের জনগণের মঙ্গলের পরিবর্তে রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে ব্যক্তি কল্যাণ বা স্বার্থ উদ্ধারে ব্যতিব্যস্ত থাকবে। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনে সেটিই বারবার প্রতীয়মান হয়েছে।’ বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র-সমাজ দর্শনের যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ, তা হলো ধর্মবর্ণ-দলমত নির্বিশেষে রাষ্ট্রের সামগ্রিক আপামর জনগণের কার্যকর মঙ্গল সাধন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘ধর্মপ্রাণ বাঙালি মুসলমানরা তাদের ধর্মকে ভালবাসে, কিন্তু ধর্মের নামে ধোঁকা দিয়ে রাজনৈতিক কার্যসিদ্ধি করতে তারা দেবে না এ ধারণা অনেকেরই হয়েছিল। জনসাধারণ চায় শোষণহীন সমাজ এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি।’
বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী রাষ্ট্র-সমাজ চিন্তা-চেতনা বরাবরই জনগণের সুখ-সমৃদ্ধির লক্ষ্যেই স্থির, যার মূলে ছিল অসাম্প্রদায়িক, সমাজতান্ত্রিক ও মানবিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা। এই জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র-সমাজ ব্যবস্থার টেকসই সমৃদ্ধি নিশ্চিতে দুর্নীতিকেই বঙ্গবন্ধু প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে বিবেচনা করেছেন এবং তা নিধনকল্পে প্রায় প্রতিটি বক্তব্য-ভাষণে জনগণকে এই ব্যাপারে সচেতন করেছেন। রাষ্ট্রযন্ত্রের সকল ক্ষেত্রে দুর্নীতিমুক্ত শাসন পরিচালনায় বঙ্গবন্ধুর অঙ্গীকার ছিল নিখাদ এবং দুর্নীতি নিধনকল্পে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা ছিল অত্যন্ত যৌক্তিক, যুগোপযোগী এবং খোলামেলা। অকপটেই তিনি এসব বিষয়কে জনগণের সম্মুখে প্রকাশ এবং এর প্রতিকারে সহযোগিতার আহ্বান করেছেন।
১৯৭২ সালের ৯ এপ্রিল আওয়ামী লীগের স্বাধীনতা-উত্তর প্রথম কাউন্সিল অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘রাজনৈতিক স্বাধীনতা পাওয়া যেতে পারে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না হলে রাজনৈতিক স্বাধীনতাও ব্যর্থ হয়ে যায়। কেবল আওয়ামী লীগের সরকার হলে চলবে না। সঙ্গে সঙ্গে জনগণেরও সরকার। সাড়ে সাত কোটি মানুষ, মানুষের সরকার। এটা সম্বন্ধে পরিষ্কার থাকা দরকার। আপনাদের কাজ করতে হবে। প্রতিষ্ঠানকে সুশৃঙ্খল করতে হবে। বিরোধীদলে থাকা এক রকমের পন্থা, আর সরকারের পক্ষে রাজনীতি করা অন্যরকম পন্থা এবং সেখানে গঠনমূলক কাজের দিকে মানুষকে এগিয়ে যেতে হবে, অত্যাচার যেন না হয়, জুলুম যেন না হয়, লুটপাট যেন না হয়।’
বঙ্গবন্ধু আরও বলেছেন, ‘দেশের মানুষকে সেবা করে মন জয় করতে হবে। তোমাদের কাছে আমার নির্দেশ, তোমাদের কাছে আমার আবেদন, তোমাদের প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে, আমাদের কাছে রাতের আরাম, দিনের বিশ্রাম হারাম, আমাদের কাজ করতে হবে। দুঃখী মুখে হাসি ফোটাতে হবে। ক্ষমতার জন্য আওয়ামী লীগ জন্মগ্রহণ করেনি। বাংলাদেশে শোষণহীন সমাজ গঠন করার জন্যই আওয়ামী লীগ জন্মগ্রহণ করেছে। শোষণহীন সমাজ গড়ে তুলতে হবে। লোভের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে। লোভ যেখানে ধ্বংস সেখানে। একবার যদি কেউ লোভী হয়ে যায়, সে জীবনে আর মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। শুধু আপনার মুখে কালি দেবেন না, কালি দেবেন সেই সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুখে। যেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সাড়ে ৭ কোটি মানুষ সব স্বাধীন হয়েছে।’
১৯৭২ সালে মহান মে দিবসে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘গুটিকয়েক সুবিধাবাদী ব্যক্তি-গোষ্ঠী জাতীয় সম্পদ ও শ্রমজীবী মানুষের উৎপাদন নিজেদের কুক্ষিগত করে রেখেছিল। দেশ আজ স্বাধীন। সম্পদের মালিক জনগণ। তাই কোনো শ্রেণিবিশেষের ভোগ লালসার জন্য এবং লোভ চরিতার্থ করার নিমিত্ত এই সম্পদকে অপচয় করতে দেয়া হবে না।’
১৯৭২ সালের ৯মে রাজশাহী মাদ্রাসা ময়দানে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আপনারা জানেন, জীবনে আমি কোনদিন মিথ্যা ওয়াদা করিনি। আমি জীবনে প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী হওয়ার জন্য রাজনীতি করিনি। একদিকে ছিল আমার প্রধানমন্ত্রীর সিংহাসন আর একদিকে ছিল আমার ফাঁসির ঘর। আমি বাংলার জনগণকে মাথা নত করতে দিতে পারি না বলেই ফাঁসিকাষ্ঠ বেছে নিয়েছিলাম। সমাজতন্ত্র ছাড়া বাংলার দুঃখী মানুষ বাঁচতে পারে না। সেজন্য সমাজতন্ত্র কায়েম করার প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছি।’
ঘুষ-সুদখোর, মজুতদার, চোরাকারবারি, চোরাচালানি, অন্যের জমি-বাড়ি দখলদারদের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু কঠোর ভাষায় শুধু সাবধান করেননি, তাদের আইনের আওতায় আনার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন বহুবার। ১৯৭২ সাল, ঐতিহাসিক ৭ জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘তাদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলতে চাই, যারা শহরে সরকারি বাড়ি, গাড়ি দখল করে আছো, যারা দোকান বা অন্যের জমি দখল করে আছো, যারা মজুদ করছ, জিনিসপত্র বিক্রি করছ না, জিনিসের দাম বাড়াবার চেষ্টা করছ, তাদের রেহাই নেই। আমি ভিক্ষা করে দুনিয়ার নানা দেশ থেকে জিনিসপত্র আনছি আমার গরিব-দুঃখীদের জন্য। সেই জিনিস যারা লুটপাট করে খাচ্ছো, তাদেরও রক্ষা নেই।’
সোনার বাংলা বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধু স্বভাবসুলভ সাবলীল ভঙ্গিতে সোনার মানুষ সন্ধানে অবিচল এবং প্রায়শ এই দেশের নির্লোভ, নির্মোহ ও ত্যাগী ব্যক্তিদের উজ্জীবিত করার নিরন্তর প্রয়াস অব্যাহত রেখেছিলেন। ১৯৭২, ৪ জুলাই বঙ্গবন্ধু কুমিল্লায় এক জনসভায় বলেন, ‘সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ পয়দা করতে হবে। এই চাটার অভ্যাস ত্যাগ করো। চাটার গোষ্ঠীর জ্বালায় আমি তিতে হয়ে গেলাম। এই চাটার গোষ্ঠীকে আমি বার বার ওয়ার্নিং দিচ্ছি। চাটার গোষ্ঠী আমার দলেই হোক, অন্য দলেই হোক, অন্য জায়গারই হও, তোমাদের আমি ক্ষমা করতে পারব না। আল্লাহও ক্ষমা করবে না।’
দুর্নীতি দমন এবং প্রতিকারের ব্যবস্থা গ্রহণে অনেক ক্ষেত্রে অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করে নিরপরাধ, নিরীহ, সৎ ব্যক্তিদের হয়রানি ও মিডিয়ার মাধ্যমে ফাঁসিয়ে দেওয়ার কুৎসিত প্রচেষ্টা সম্পর্কে ১৯৭২ সালের ১৬ জুলাই জাতীয় প্রেস ক্লাবে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের বার্ষিক অধিবেশনে কথা বলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি বলেছিলেন, ‘কোনো সাপ্তাহিক বা সান্ধ্য দৈনিকে কারও বিরুদ্ধে মিথ্যা কথা লিখে তাকে বলা হতো- টাকা দাও, নইলে আবার তোমার বিরুদ্ধে লেখা হবে। তখন সত্যি সত্যিই টাকা দিয়ে সে কাগজের মুখ বন্ধ করা হতো। আমি লক্ষ্য করছি এখানেও এই ধরনের একটা প্রবণতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। আরও দেখা যাচ্ছে, যার আয়ের কোনো প্রকাশ্য উৎস নেই, সেও দৈনিক কাগজ বের করছে। রাতারাতি কাগজটা বের হয় কোথা থেকে? পয়সা দেয় কে?’
১৮ আগস্ট, ১৯৭৪ সাল, বন্যাকবলিত জাতির উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘দেশবাসী ভাই ও বোনেরা, একটা কথা আজ আমি পরিষ্কার ভাষায় বলতে চাই, জনগণের দুর্দশাকে মূলধন করে যারা মুনাফা লুটে সেই ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ, চোরাকারবার, মজুদদার ব্যবসায়ীদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে হবে। রিলিফ বণ্টন নিয়ে কোনো ছিনিমিনি খেলা বরদাশত করা হবে না। ক্ষুধার্ত মানুষের গ্রাস যারা কেড়ে নেয় তারা মানুষ নয়, মানুষরূপী পশু। আপনারা আমার ওপর আস্থা রাখতে পারেন। আমি এই পশুদের বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে চাই। কিন্তু জনগণের সাহায্য ছাড়া এ সম্ভবপর নয়। তাই জনগণের সাহায্য আমি কামনা করি।’
১৯৭৫ সালের ১৫ জানুয়ারি রাজারবাগ পুলিশ লাইনের প্রথম পুলিশ সপ্তাহ উপলক্ষে উদ্বোধনী ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘জীবন অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। এই কথা মনে রাখতে হবে। আমি আর আপনি মৃত্যুর পর সামান্য কয়েক গজ কাপড় ছাড়া সঙ্গে আর কিছুই নিয়ে যাব না। তবে কেন আপনারা মানুষকে শোষণ করবেন, মানুষের উপর অত্যাচার করবেন? গরিবের উপর অত্যাচার করলে আল্লাহর কাছে তার জবাব দিতে হবে। তাই শুধু আপনারা নয়, সমস্ত সরকারী কর্মচারীকেই আমি অনুরোধ করি, যাদের অর্থে আমাদের সংসার চলে, তাদের সেবা করুন। যাদের জন্য, যাদের অর্থে আজকে আমরা চলছি, তাদের যাতে কষ্ট না হয়, তার দিকে খেয়াল রাখুন। যারা অন্যায় করবে, আপনারা অবশ্যই তাদের কঠোর হস্তে দমন করবেন। কিন্তু সাবধান, একটাও নিরপরাধ লোকের উপর যেন অত্যাচার না হয়। তাতে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠবে। আপনারা সেই দিকে খেয়াল রাখবেন।’
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ-রাষ্ট্র গঠনের জন্যই বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে। মাঝে দীর্ঘ একটা সময় শকুনিদের থাবায় ক্ষত-বিক্ষত হতে হয়েছে। তবে সব বাধা পেরিয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে উঠছে একটা নতুন প্রজন্ম। মুজিবময় এই বাংলায় একদিন প্রতিটি মানুষই হয়তো হয়ে উঠবে সোনার মানুষ।
লেখক: চিকিৎসক
সারাবাংলা/এসবিডিই