Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মৃত্যুর পর বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধুর মর্যাদা

আদনান কাদির
১৭ আগস্ট ২০২৩ ১৩:৫৫

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-একটি নাম, একটি ইতিহাস, একটি কিংবদন্তি। উপাধিসহ চারটি মাত্র শব্দের একটি নাম হলেও তার কীর্তি এতটাই আকাশস্পর্শী যে সহস্রাধিক শব্দ এক করলেও তার মহিমাকে বর্ণনা করা যাবে না। নিজ কর্মের মহিমাতেই তিনি বিশ্বনন্দিত নেতাদের মাঝে নিজের আসন গেড়েছেন। আর পাঁচজন সাধারণ মানুষের মতো থেকেছেন সাধারণ একটি বাড়িতে সাধারণ মানুষের মাঝে। কিন্তু আজ স্বাধীনতার ৫২ বছরেও একটা আক্ষেপ থেকে যায়। তা হলো, অপপ্রচার আর অতিপ্রচারের বেড়াজালে বঙ্গবন্ধু বন্দি হয়ে আছেন অর্ধশতবছর ধরে।

বিজ্ঞাপন

৭৫ এর ১৫ই আগস্ট খুনি মোশতাকের সামরিক আইন জারির মাধ্যমে দেশে সামরিক শাসনের সূত্রপাত হয়, যার বিস্তৃতি ছিল ১৬ বছর এবং ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত গণতন্ত্রের মোড়কে আরও ৫ বছর মিলিয়ে মোট ২১ বছর। এই হত্যাকে কেন্দ্র করে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ণ হয়। পশ্চিম জার্মানির নোবেলবিজয়ী নেতা উইলি বার্ন্ট বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর খবর শুনে বলেছিলেন, “শেখ মুজিবের হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যাবেনা। যে জাতি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে, সে জাতি আরো অনেক ভয়ঙ্কর কাজ করতে পারে।” তৎকালীন স্নায়ুযুদ্ধের বেড়াজালকে অবজ্ঞা করে এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিমা বিশ্বের আরো অনেক রাষ্ট্রনায়ক উইলি বার্ন্টের সাথে একাত্ম প্রকাশ করেন। তারা মনে করেছিলেন বাংলাদেশ হয়ত পাকিস্তানের রোগেই আক্রান্ত হয়েছে। তাদের ধারণা অবশ্য আংশিকভাবে সত্যই। মুক্তিযুদ্ধের যে আদর্শের জন্য ত্রিশ লাখ তাজা প্রাণ বলি দেওয়া হয়, সেই আদর্শে রচিত সংবিধানকে দুমড়ে মুচড়ে ফেলার অপচেষ্টা করা হয়। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে যে দেশের জন্ম হয়, তার সংবিধানে আনা হয় রাষ্ট্রধর্মের ধারণা এবং ইসলামের মূলনীতি। সামরিক শাসকগণ আসলে বিশাল চতুর ছিলেন। ধর্মভীরু জাতিকে ধর্ম দিয়েই বশে আনা যায়-এটা তারা খুব ভালোই বুঝেছিলেন। কিন্তু সবচেয়ে বড় আঘাত আনা হয় বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রধানতম একটি অংশের উপর। ৭৫ এর পর পাঠ্যবই, গবেষণাপত্র, রেডিও, টেলিভিশন, পত্রপত্রিকাসহ সব জায়গা থেকেই বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে দেওয়ার অপচেষ্টায় মেতে ওঠে সামরিক শাসকরা। সামরিক-বেসামরিক শাসনের এই ২১টি বছর ১০ই জানুয়ারি, ৭ই মার্চ, ২৬শে মার্চ কিংবা ১৫ই আগস্ট-কোনোটাকেই জাতীয় দিবসের মর্যাদা দেওয়া হয়নি। প্রতিবছর ১৫ই আগস্ট আসলে পত্র-পত্রিকায় লেখা হতো- “আজ মরহুম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী।” হায়রে রাজনীতি! শুধুই কি তিনি রাষ্ট্রপতি ছিলেন? সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা তাদের নেই। যদিও ১৯৮০-৮১ সালের দিকে অল্পসংখ্যক পত্রিকা যথাযথভাবে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে স্বীকৃতি দিয়েছে, কিন্তু ২১ বছরের বেশিরভাগ সময়ই তিনি ছিলেন সকল প্রকার স্বীকৃতির নাগালের বাইরে। আর তার আত্মস্বীকৃত খুনিদের দেশে-বিদেশে উচ্চপর্যায়ে চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।

বিজ্ঞাপন

১৯৯১-এ স্বৈরাচার এরশাদের পতন ঘটার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের নামে আর এক শাসন শুরু হয়।সেনাছাউনিতে গড়ে ওঠা ক্ষমতাসীন বিএনপির পৃষ্ঠপোষকতায়ই দেশীয় রাজনীতিতে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পুনর্বাসন করা হয়।বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি কর্নেল ফারুক ‘ফ্রিডম পার্টি’র নামে আবার রাজনীতিতে প্রবেশের দুঃসাহস ও ধৃষ্টতা দেখায়।মানবতাবিরোধী,সংবিধানবিরোধী ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’-কে স্বীকৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রেও বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের অবস্থান ছিল নিন্দনীয় এবং রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্বহীনতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।বিএনপির উল্লেখযোগ্য বহু নেতৃবৃন্দ এই অধ্যাদেশ বাতিলের দাবি নিয়ে বেশ ঠাট্টা-তামাশা করেন।প্রকৃতপক্ষে তথাকথিত ‘গণতন্ত্রের’ নামে তারা সেনাশাসকদেরই উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন।

পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসে।বাতিল করা হয় ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ,শুরু হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার,পাঠ্যপুস্তকে বঙ্গবন্ধুকে আবারও ফিরিয়ে আনা হয়।১৯৯৬ সাল থেকে যথাযোগ্য মর্যাদায় রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হয় ১৫ই আগস্ট,১৭ই মার্চ,১০ই জানুয়ারি,২৬শে মার্চসহ ঐতিহাসিক দিনগুলি।কিন্তু এরপরও বিএনপি ক্ষান্ত হয়নি।১৯৯৬ সাল থেকেই প্রতিবছর ১৫ই আগস্ট বিএনপি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কৃত্রিম জন্মদিন পালন করে আসছে।১৯৯৬ সালের আগ পর্যন্ত এ জন্মদিন ছিল ৫ই সেপ্টেম্বর।রাজনৈতিক কারণেই যে এ জন্মতারিখের পরিবর্তন-তা বুঝতে কারোরই বাকি ছিলনা।বঙ্গবন্ধুর ক্ষেত্রে বিএনপি তার জঘন্য অবস্থানের জানান দেয় স্পষ্টভাবেই ।এ থেকে ধারণা করা যাচ্ছিল যে পরবর্তী সময়ে বিএনপি ক্ষমতায় এলে ১৫ই আগস্টের হত্যাকান্ডের বিচারকার্যের গতি অনেকটা থমকে যাবে।ধারণাটি সঠিকই ছিল।২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এলে হত্যামামলার শুনানি পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়।ক্ষমতাসীন সরকারের মনোভাব তুলে ধরতে তৎকালীন আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমেদ তার ২০০৭ সালের ডায়েরিতে লেখেন,”সারা দেশে উদযাপিত হচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকী।… আমার এ কারণে দুঃখ হয় যে আমার অক্লান্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আমি সরকারের বিরোধিতার কারণে আপিল বিভাগে জমে থাকা সেই জঘন্য হত্যা মামলার শুনানি শুরু করতে পারিনি। আমি এমনও যুক্তি দেখিয়েছি যে মুজিব যখন নিহত হন, তখন বিএনপির জন্মই হয়নি। কাজেই আপিল শুনানি বন্ধ রেখে বিএনপি এর দায়ভার বহন করতে যাবে কেন? কিন্তু প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যদের আমি তা বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি। এ জন্য ব্যক্তিগতভাবে আমি লজ্জিত এবং নিজেকেই আমার কাছে ছোট বলে মনে হয়।”যদিও এত প্রচেষ্টার পরও বিএনপির পরিকল্পনা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়।এতে সাধারণ মানুষের কাছে কেবল বিএনপির ভাবমূর্তিই নষ্ট হয়েছে।২০০৪ সালে বিবিসির জরিপে সাধারণ মানুষ বঙ্গবন্ধুকেই ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ হিসেবে মনোনীত করেন,যা ছিল ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকারকে জনগণের রীতিমতো বুড়োআঙ্গুল প্রদর্শন।

সময় পাল্টেছে।২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারই ক্ষমতায় আছে।গত প্রায় ১৫ বছর ধরেই রাষ্ট্রীয়ভাবে বঙ্গবন্ধুকে তাঁর প্রাপ্য স্বীকৃতি দেওয়া হয়।সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তাঁকে ‘জাতির পিতা’ ঘোষণা করা হয়।শিল্প-সাহিত্য,সংস্কৃতিতেও বঙ্গবন্ধুর বিশেষ অবস্থান প্রতীয়মান।তবে এখন আর এক সমস্যার উদ্ভব হয়েছে।একসময়ের অপপ্রচার এখন অতিপ্রচারে পরিণত হয়েছে,মাঝখানে নেই বস্তুনিষ্ঠ প্রচার।শুনেছি মুজিব বর্ষকে কেন্দ্র করে ৫০০০ বই রচিত হয়েছে।কিন্তু কয়টি বই পাঠ যোগ্য তা বলা দায়।আজ ৫২ বছর পর এসে আক্ষেপ করেই বলতে হয়,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কতটুকু বস্তুনিষ্ঠ গবেষণা করা হয়েছে?বঙ্গবন্ধু ব্যতীত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের বাকিসব জাতীয় নেতাকে যে মর্যাদা দেওয়া হয়,তা আসলে বৃহৎ অর্থে জাতীয় কিংবা ঐতিহাসিক মর্যাদার শামিল-একথা সহজে বলা যায়না।এখনকার প্রেক্ষাপট এমন হয়ে গেছে যে কেবল কোনো বিশেষ দিন আসলেই আমরা তাঁদের কথা মনে করি,কিংবা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অংশ হিসেবে শুধু পড়ার জন্যই তাদের সম্পর্কে বইপুস্তকে পড়ি।কিন্তু এই বইপুস্তকের চেয়েও যে আরো সুবিশাল মর্যাদার মানুষ তাঁরা,মাত্র একদিনের উদযাপনের উপরেও যে তাঁদের একেকজনের জীবন ছিল অজস্র বর্ণিল দিনের সমাহার-জাতি হিসেবে এ সত্যের স্বীকৃতি দিতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি।এজন্য সুযোগ বুঝে কতিপয় সুযোগসন্ধানী ব্যক্তিবর্গও তাঁদেরকে নিয়ে অহেতুক ও নষ্ট বিতর্কের সৃষ্টি করেছেন।

কোনো বিষয় যখন জনসাধারণের কাছে খুব বেশি সহজলভ্য বা সাধারণ হয়ে পড়ে,তখন বাস্তবতার সাথে সেই বিষয়ের সংযোগ বিচ্ছেদের সমূহ সুযোগ থাকে।জানিনা ঠিক না ভুল,কিন্তু মনের মধ্যে এখন একটা ভীতি কাজ করে।তা হলো-বঙ্গবন্ধুর মতো একজন জাতীয় নেতা,যাঁর কিনা সকল দলমতের উর্ধ্বে থাকা উচিত,তাঁকে একজন দলনেতায় পরিণত করা হচ্ছে।আর তাঁর ঘনিষ্ঠ সহচরদরে নিতান্ত পার্শ্বচরিত্রে পরিণত করা হচ্ছে।এই অপপ্রয়াস ‘৭৫ এর পরও ছিল,এখনো আছে।আর দুইক্ষেত্রেই যুক্তির চেয়ে আবেগের প্রাধান্য বেশি দেওয়া হচ্ছে।’৭৫ এর আবেগ ছিল ধর্মসূত্রে গাঁথা এক হারিয়ে যাওয়া রাষ্ট্রের প্রতি,যে রাষ্ট্র ধধর্মপরায়ণতার পরিবর্তে ধর্মান্ধতার পূজারী ছিল।আর ২০২৩ সালের এই আবেগ এক হারানো নেতার প্রতি,যিনি নিজের জীবদ্দশায় কখনোই অতিপ্রচারকে সমর্থন করেননি।এটা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে,বাংলাদেশ স্বাধীন করতে মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে তার আবেগ।স্বৈরাচারের পতন ঘটাতে অনুপ্রাণিত করেছে তার আবেগ।গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ে মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে তার প্রাসঙ্গিক আবেগ।কিন্তু স্বাধীনতার ৫২ বছর পর বর্তমানে যখন মুক্তি নয় বরং জাতীয়,সামাজিক ও ব্যক্তিগত উন্নয়নই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য,সেখানে কি যুক্তির বদলে আবেগের স্থান দেওয়া আসলেই প্রাসঙ্গিক?

লেখক: শিক্ষার্থী, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ

সারাবাংলা/এসবিডিই

আদনান কাদির মুক্তমত মৃত্যুর পর বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধুর মর্যাদা

বিজ্ঞাপন

বরবাদের আইটেম গানে নুসরাত
২৪ নভেম্বর ২০২৪ ১৯:২৬

কলকাতায় অভিষেক হচ্ছে অপূর্ব’র
২৪ নভেম্বর ২০২৪ ১৮:২৮

আরো

সম্পর্কিত খবর