Thursday 28 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সাইবার অপরাধে এআই এর অপব্যবহার: আগামী প্রজন্মের জন্য অশনিসংকেত

সানজিদা আরমিন মীম
১৮ আগস্ট ২০২৩ ১৩:৪৬

এই একবিংশ শতাব্দীতে যে মাধ্যমটি তথ্য-প্রযুক্তির সর্বোচ্চ বৈপ্লবিক উৎকর্ষ সাধন করেছে সেটি আর কিছু নয়, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (সংক্ষেপে-এআই)। প্রযুক্তির সহজলভ্যতা এবং ইন্টারনেট জগতে এআই এর বিস্তৃত পরিধি বিশ্বের অপার জ্ঞানভান্ডারকে উন্মুক্ত করে অভাবনীয় উন্নয়নের দ্বার উন্মোচন করেছে। এটি হচ্ছে কম্পিউটার বিজ্ঞানের সবচেয়ে উন্নত রূপ যেখানে কম্পিউটারকে মিমিকস কগনেটিভ এককে এনে এটিতে মানব মস্তিষ্কের মতো চিন্তা করা, বোঝা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা বিকাশ করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই এআই নিয়ে আলোচনা হলেও বিগত এক দশকে এই এআই এর সক্ষমতা বেড়েছে বহুগুণ। বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের দেশ হয়েও এই প্রতিযোগিতায় একদমই পিছিয়ে নেই। প্রতিনিয়ত এআই এর চরম উন্নতি আমাদের জীবনযাত্রার মানকে নাটকীয়ভাবে পরিবর্তন করে দিচ্ছে। তবে এই চিত্রের উল্টোপিঠের দৃশ্যটি আঁৎকে ওঠার মতো ভয়াবহ। গত মার্চ মাসে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে এক সম্মেলনে ফিউচার টুডে ইন্সটিটিউটের প্রধান এবং নিউ ইয়র্ক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক অ্যামি ওয়েব আগামী ১০ বছর পরে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর ভবিষ্যত কী হবে এ নিয়ে দুইটি রূপরেখা প্রদান করেন। তিনি প্রথমে একটি আশাবাদী দৃশ্যপট তুলে ধরেন যেখানে এআই ব্যবহৃত হবে মানুষের সার্বিক কল্যাণে তাদের জীবনমানের উন্নতিতে। এরপরই তিনি এআই এর বিপর্যয়কর দৃশ্য-কল্প বর্ণনা করেন যেটি ঘটবে এআই এর অপব্যবহার এর ফলে। তবে হতাশার কথা এই যে, এআই নিয়ে ইতিবাচক যে ধারণা দেওয়া হচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে সেটি ঘটার সম্ভাবনা মাত্র ২০ ভাগ। অর্থাৎ এআই এর অপব্যবহারের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান সাইবার অপরাধের ভয়াবহতা ঠিক কেমন প্রকট রূপ লাভ করতে যাচ্ছে সেটি আর বলার অপেক্ষা রাখেনা।

বিজ্ঞাপন

সময়ের সাথে সাথে এআই এর অন্ধকার দিক এবং এটি ব্যবহার করে ঘটানো যায় এমন সাইবার অপরাধ সম্পর্কে এখন বেশি মানুষ জানছে এবং সচেতন হচ্ছে। বলে রাখি, সাইবার অপরাধ হচ্ছে কম্পিউটার এবং ইন্টারনেট ব্যবহার করে ডিজিটাল পরিসরে সংঘটিত হতে পারে এমন যেকোনো অপরাধ। সাইবার অপরাধের জগত প্রতিনিয়তই আশ্চর্যজনকভাবে সুগঠিত হচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাইবার অপরাধ এবং অপরাধীর সংখ্যা বাড়ছে লাগামহীনভাবে। এসব অপরাধীদের প্রধান আস্তানা ‘ডার্ক ওয়েব’ যেটিকে বলা হয় ইন্টারনেটের অন্ধকার দুনিয়া। এখানে সাইবার অপরাধীরা ছোটো ছোটো দলে ভাগ হয়ে ‘স্টার্টআপ’ গড়ে তুলে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে। এআই এর অভাবনীয় উন্নতির ফলে বিভিন্ন অবৈধ কাজ এখন সাইবার অপরাধীদের জন্য আরো বেশি সহজতর হচ্ছে। এআই এর অপব্যবহার করে সংঘটিত সাইবার অপরাধ গুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিকটি হলো বিভিন্ন ওয়েবসাইটের গোপনীয়তা ভঙ্গ করে বিশাল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর ব্যক্তিগত তথ্য চুরি এবং সেগুলো অবৈধ কাজে ব্যবহার করা। এছাড়াও তারা ব্যাংকের সাইট হ্যাকিং এবং ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির মাধ্যমে গ্রাহকদের কোটি কোটি টাকা অবৈধ পন্থায় তুলে নিতে পারে। বিভিন্ন দেশের হ্যাকার গ্রুপগুলো অন্য দেশের গুরুত্বপূর্ণ ডেটাবেজ হ্যাক করে নিজেদের আয়ত্তে নিতে পারে। এআই এর মাধ্যমে অন্ধকার জগতের হ্যাকাররা দ্রুতই যেকোনো দেশের, যেকোনো প্রতিষ্ঠানের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং গোপনীয় সব ওয়েবসাইট, সফটওয়্যারে সাইবার হামলা চালিয়ে তথ্য চুরি, ওয়েবসাইট অকেজো করে দেওয়া সহ বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি সাধন করতে পারে। এর ফলে গোটা একটি দেশ বা জাতি চরম হুমকির সম্মুখীন হতে পারে। এবছরের জুলাই মাসে বাংলাদেশের সরকারি ওয়েবসাইট থেকে প্রায় ৫ কোটি নাগরিকের সংবেদনশীল ব্যক্তিগত তথ্য ফাঁস হয়ে যায়। এসকল ব্যক্তিগত তথ্য এবং পরিচয় চুরি করে অপরাধীরা বিভিন্ন সাইবার অপরাধ ঘটাতে পারে, যেটি এইসব ব্যক্তি এবং দেশের জন্য অত্যন্ত হুমকিস্বরূপ। এর আগে ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারিতে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সাইবার অপরাধগুলির একটি ঘটে যখন হ্যাকাররা সুইফট সিস্টেমের ৪০টি ভুয়া পরিশোধ অর্ডার পাঠিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১০১ মিলয়ন মার্কিন ডলার চুরি করে নেয়।

বিজ্ঞাপন

বর্তমানে এআই এর যে অপব্যবহার নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে তা হলো, “ডিপফেইক প্রযুক্তি”। কারো সম্মানহানি বা ক্ষতির উদ্দেশ্যে ডিপফেইক অ্যালগরিদম এর সাহায্যে আপত্তিকর বাস্তবধর্মী ভিডিও বা অডিও তৈরি করা, ভুয়া সংবাদ তৈরি করে উস্কানিমূলক গুজব ছড়ানোর কাজে এই অ্যালগরিদম এতটাই নিখুঁতভাবে ব্যবহার করা যায় যে, অনেক সময় সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। ইন্টারনেট এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে মুহুর্তেই লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় এসব অডিও বা ভিডিও। ফলে সেই টার্গেটেড ব্যক্তির ব্যক্তিগত এবং সামাজিক জীবনে নেমে আসে ঘোর অন্ধকার। এই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নগ্ন ছবি তৈরি করে বা কণ্ঠস্বর ক্লোন করে ফোনকলের মাধ্যমেও অর্থ নেওয়া সহ বিভিন্ন প্রতারণা করছে সাইবার অপরাধীরা। গত কিছুদিন আগে একজন জনপ্রিয় ব্যক্তির একটি আপত্তিকর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে আলোচনার ঝড় তোলে। পরবর্তীতে জানা যায়, ভিডিওতে থাকা ব্যক্তিটি আসলে তিনি নন, বরং এআই এর ডিপফেইক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কেউ একজন সেই ভিডিওটি বানিয়েছিলো। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসব সাইবার অপরাধের সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী নারীরাই। জাতিসংঘের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইন্টারনেট ব্যবহারকারী নারীদের মধ্যে তিন-চতুর্থাংশ নারী সাইবার বুলিং এর শিকার হয়ে থাকেন। অনলাইনে হয়রানির শিকার ব্যক্তিদের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগই নারী যাদের সবচেয়ে বড় অংশটি হলো কিশোরী এবং তরুনীরা। প্রযুক্তির অপব্যবহার করে সাইবার-দুর্বৃত্তদের হয়রানি রীতিমতো ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে। সাইবার বুলিং ছাড়াও ইতিপূর্বে বাংলাদেশের জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে আত্মহত্যার সরাসরি সম্প্রচার, প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে পর্ণো ছবি বা ভিডিও প্রকাশ, সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টির কাজ করা হয়েছে। এর ফলে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে, হতাশা, দুশ্চিন্তাসহ আত্মহত্যার প্রবণতার গ্রাফ প্রতি বছরই উদ্বেগজনক হারে ঊর্ধ্বগামী হচ্ছে। তাছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে প্রবেশের ক্ষেত্রে যথেষ্ট নিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকায়, যেকোনো হ্যাকার সহজেই অন্যের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে অনধিকার প্রবেশ করে তার ক্ষতি সাধন করতে পারে। এআই এর উত্তরোত্তর উন্নতির ফলে এই চর্চা ভবিষ্যতে আরো বৃদ্ধি পাবে যেটি আগামী প্রজন্মকে বড় ধরনের হুমকির মুখে ফেলবে।

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের কারণ হলো এটি নিজেই নিজেকে সমৃদ্ধ করতে পারে মানুষের সহায়তা ছাড়াই। যার প্রমাণ আমরা পাচ্ছি ওপেন এআই এর চ্যাটবট “চ্যাটজিপিটি” এর সক্ষমতার মাধ্যমে। চ্যাটজিপিটি কার্যকরভাবে ম্যালওয়্যার লেখার প্রক্রিয়াটিকে স্বয়ংক্রিয় করতে পারে। প্রযুক্তিগত অভিজ্ঞতা বেশি নেই এমন নতুন সাইবার অপরাধীদের জন্য এটি দরজা খুলে দেয়। অপরাধীরা বিভিন্ন অবৈধ কাজের জন্য এই চ্যাটবট ব্যবহার করে সংকেত বা কোড তৈরি করে সেগুলো দিয়ে ক্ষতিকর ওয়েবসাইট এবং ম্যালওয়্যার তৈরি করছে। এআই ব্যবহার করে অবৈধ কার্যসিদ্ধির মাধ্যমে সাইবার অপরাধীদের দৌরাত্ম প্রতিনিয়ত বাড়ছে। নতুন যেসব এআই তৈরি হচ্ছে এগুলো অদূর ভবিষ্যতে ফেসবুক, ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারে। এর ফলে এসব মাধ্যম পরিণত হবে টগবগ করে ফুটতে থাকা ভুল তথ্য আর মিথ্যাচারের এক সমুদ্রে। সাইবার অপরাধের শিকার হবে কোটি কোটি মানুষ। যা আমাদের আগাামী প্রজন্মের জন্য অশনি সংকেত। পৃথিবীর ক্ষমতাশীল দেশ এবং বড়ো প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো এআই এর অপব্যবহারের মাধ্যমে সাইবার অপরাধের বিরুদ্ধে এখনই জোরালো নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার পদক্ষেপ গ্রহণ না করলে আগামী কিছু বছরের মধ্যেই পৃথিবী প্রত্যক্ষ করবে নিয়ন্ত্রণহীন এআই এর ধ্বংসলীলা।

লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ

সারাবাংলা/এজেডএস

সাইবার অপরাধে এআই এর অপব্যবহার সানজিদা আরমিন মীম