নতুন নামে সংগঠিত হচ্ছে জঙ্গিরা
১৮ আগস্ট ২০২৩ ১৮:৪১
দেশ থেকে জঙ্গিবাদী অপশক্তি হারিয়ে যায়নি। নানা নামে, নানা পরিচয়ে তারা তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তার করে চলেছে। শক্তি সঞ্চয় করছে। নিজেদের ধ্বংসক্ষমতা বাড়িয়ে চলেছে। এখন সময় ও সুযোগের অপেক্ষায় আছে আবারো দেশব্যাপী অন্তর্ঘাত সৃষ্টির জন্য। বিভিন্ন সময়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর অভিযানে তেমন কিছু আলামতও পাওয়া যাচ্ছে। গত সোমবার মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় ‘ইমাম মাহমুদের কাফেলা’ নামে পরিচিত একটি জঙ্গি সংগঠনের ১৭ সদস্যকে স্থানীয় জনতা আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে। তার আগে উপজেলার কর্মদা ইউনিয়নের পূর্ব টাট্টিওয়ালি গ্রামের একটি বাড়িতে শুক্রবার রাত থেকে অভিযান চালিয়ে ১০ জনকে আটক করেছিল পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। তারা সেখানে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল। তাদের কাছ থেকে প্রচুর বিস্ফোরক উদ্ধার করা হয়েছিল। অভিযানের সময় সেখান থেকে কিছু সদস্য পালিয়ে গিয়েছিল, পরে তাদেরই আটক করে স্থানীয়রা। তারও আগে ঢাকা থেকে তাদের আরো কিছু সদস্যকে আটক করা হয়েছিল। এর আগে পার্বত্য চট্টগ্রামে জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়া নামের আরো একটি নতুন জঙ্গি সংগঠনের অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়। অর্থাৎ নতুন নতুন নামে নতুনভাবে তারা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে জঙ্গিবাদী কর্মকান্ডের শুরু গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শুরুতে আফগানিস্তান থেকে ফিরে আসা জঙ্গিদের হাত ধরে। তারপর তারা সময়ে সময়ে রাজনৈতিক আনুকূল্যও পেয়েছে। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর সারা দেশে জঙ্গিদের ব্যাপক নাশকতা শুরু হয়।
সারা দেশে একযোগে পাঁচ শতাধিক বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। রাজশাহীতে বাংলাভাই কয়েক হাজার জঙ্গি নিয়ে দিনের বেলা পুলিশের সামনেই ট্রাক মিছিল করেছিল। আদালতও তাদের হামলা থেকে রক্ষা পায়নি। বিচারক, আইনজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিকসহ বহু মানুষ নিহত হয় তাদের হামলায়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর সদস্যরাও তাদের হামলার শিকার হয়েছেন। তারা মানুষ মেরে উল্টো করে গাছে ঝুলিয়ে রেখেছে। নানাভাবে তারা তাদের নৃশংসতা প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের মানুষ সেই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে ফিরে যেতে চায় না।
সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ‘জঙ্গি আস্তানা’ শনাক্ত করেছে পুলিশ। সাঁড়াশি অভিযানে জঙ্গি কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। কিন্তু নির্মূল করা কঠিন। তবে নজরদারি অব্যাহত থাকলে কর্মকাণ্ড শুরুর আগেই জঙ্গিদের ধরে ফেলা যায় গেল দশকের মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ করে দেশে বেড়ে যায় জঙ্গি তৎপরতা। এরপর তাদের ধরতে অভিযান শুরু করে পুলিশ, র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। সাঁড়াশি অভিযানে অনেকটাই চুপসে যায় জঙ্গিরা। কিন্তু গত বছর থেকে আবারো গণমাধ্যমের শিরোনাম হচ্ছে নতুন নতুন জঙ্গি সংগঠনের তৎপরতার খবর। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি ‘জঙ্গি আস্তানা’ শনাক্ত করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হয়েছে নারী-পুরুষসহ বেশ কয়েকজনকে। এর মধ্যে মৌলভীবাজার থেকে দুই দফায় আটক করা হয় ২৬ জনকে। প্রশ্ন উঠছে আবারো কী সংগঠিত হচ্ছে জঙ্গিরা, পুলিশ তাদের শনাক্ত করছে কীভাবে?
কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) সূত্রে, সম্প্রতি যশোর, সিরাজগঞ্জ ও জামালপুরসহ বেশ কয়েকটি জেলা থেকে পরিবারসহ অনেক লোক নিখোঁজ হওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছিল। এরমধ্যে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানার ডা. সোহেল তানজীন রানা, যশোর থেকে নটরডেমের শিক্ষার্থী ফাতিম ও জামালপুরের এরশাদুজ্জামান শাহিন নামে তিনজনের ব্যাপারে অনেক তথ্য জানতে পারে।
পুলিশের বক্তব্য, আগে নতুন এসব জঙ্গি সংগঠন সম্পর্কে শোনা যায়নি। দিন কয়েকের ব্যবধানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে দুটি সংগঠনের কথা শোনা যায়। কিন্তু নির্ভরযোগ্য স্বাধীন কোনো সূত্র থেকে তাদের সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়নি। ফলে এটা নিয়ে মন্তব্য করা খুব কঠিন ছিল। একটা জিনিস খুব স্পষ্ট, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গত কয়েক বছরের অভিযানে, মানবাধিকার লঙ্ঘন করে হোক আর যেভাবেই হোক, যে পরিমাণ লোকজনকে আটক হয়েছে, তাতে জঙ্গিদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়েছে। এই চ্যালেঞ্জকে ওভারকাম করে তারা কোনো অপারেশন করার সক্ষমতা অর্জন করেছে বলে মনে হয় না।
কোনো জঙ্গি সংগঠনের অস্তিত্ব পুরোপুরি শেষ হয়ে যায় না। দেখতে হবে তাদের দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা চালানোর মতো সক্ষমতা আছে কি না। জোরালো কোনো অপারেশন চালানোর সক্ষমতা তাদের নিশ্চয়ই আছে।
ঘোষণা দিয়ে নয়, জঙ্গিরা কাজ করে গোপনে। শক্ত অবস্থান ও প্রকাশ্যে তৎপরতা চালানোর আগেই অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করেছে পুলিশ। সাঁড়াশি অভিযানে জঙ্গি কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। কিন্তু নির্মূল করা কঠিন। তবে নজরদারি অব্যাহত থাকলে কর্মকাণ্ড শুরুর আগেই জঙ্গিদের ধরে ফেলা যায়।
সিটিটিসি প্রধানের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সম্প্রতি নজরে এসেছে ইমাম মাহমুদের কাফেলা নামে একটি সংগঠনের। ৭ আগস্ট ঢাকার গাবতলী থেকে ৬ নারী ও ৪ জন পুরুষকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তারা ঝিনাইদহ ও মেহেরপুর থেকে এসেছেন। সঙ্গে ছিল ৭ শিশু। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ জানতে পারে, ইমাম মাহমুদের কাফেলায় যোগ দিতে ‘হিজরত’ করছে তারা। এরপর মিরপুর বাংলা কলেজ এলাকায় অভিযান চালিয়ে আরো একজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী মৌলভীবাজারের কুলাউড়া দুর্গম পাহাড়ে অভিযান চালিয়ে সংগঠনটির বেশ কিছু অনুসারীকে গ্রেপ্তার করে সিটিটিসি। তাদের একজন অনুসারী কুলাউড়ার কর্মধা ইউনিয়নের টাট্টিউলি গ্রামে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপনের জন্য জমিও কিনেছেন।
উল্লেখ্য ২০১৬ সালে রাজধানীর গুলশান-২ এ হোলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলা চালায় জঙ্গিরা। এ ঘটনায় নিহত হন দেশি-বিদেশি বেশ কয়েকেজন নাগরিক। এরপর বড় ধরনের জঙ্গিবিরোধী অভিযান শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আটক করা হয় অনেককে। হতাহতের ঘটনাও ঘটে সেসব অভিযানে। ছয় বছর পর, অর্থাৎ ২০২২ সালে আবারো সামনে আসে জঙ্গি তৎপরতার খবর। সে বছর অক্টোবর মাসে র্যাব জানিয়েছিল, বান্দরবান ও রাঙামাটির দুর্গম এলাকায় কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের প্রশিক্ষণ শিবিরে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ৫০ জনের বেশি জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। তারা ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্কীয়া’ নামের একটি জঙ্গি সংগঠনের সদস্য। এরপর দেশের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয় এই সংগঠনের বেশ কয়েকজন সদস্যকে। একই বছরের ২০ নভেম্বর ঢাকার নিম্ন আদালত এলাকা থেকে পুলিশের চোখে স্প্রে করে প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপনকে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত দুই আসামিকে ছিনিয়ে নেয় জঙ্গিরা। ছিনিয়ে নেওয়া আনসার আল ইসলামের ওই দুই সদস্যকে এখনও আটক করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর অনেক কর্মকর্তা প্রায়ই বলেন, জঙ্গিদের বড় কিছু করার সামর্থ্য নেই। এ ধরনের আত্মতৃপ্তি প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই। মাত্র ৯ মাস আগে গত বছরের নভেম্বর মাসে ঢাকার আদালতপাড়া থেকে তারা সাজাপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। মনে রাখতে হবে, তাদের মদদদান ও পৃষ্ঠপোষকতা করার মতো অনেক মানুষ আছে, রাজনৈতিক শক্তিও আছে। তাই জঙ্গিবাদ দমনে আরো বেশি তৎপর হতে হবে। পাশাপাশি গোয়েন্দা তৎপরতা অনেক বাড়াতে হবে।
লেখক: কবি, সাংবাদিক
সারাবাংলা/এজেডএস