জহির রায়হান সমাচার: কেন তার মৃত্যুরহস্য আজও অমীমাংসিত
১৯ আগস্ট ২০২৩ ১৬:১২
জহির রায়হান বাংলাদেশের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম। কোন ক্ষেত্রে তার পদচারণা ছিল না! তিনি একাধারে সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক, মুক্তিযোদ্ধা, ঔপন্যাসিক এবং সফল চলচ্চিত্রকার। জীবনের সবক্ষেত্রেই সফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন তিনি। যেখানে হাত দিয়েছেন সেখানেই হয়েছেন সফল।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী জাতির এই সূর্যসন্তান ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট ফেনী জেলার সোনাগাজী উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের মজুপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রকৃতনাম ছিল আবু আবদার মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ। ডাকনাম ছিল জাফর। আবু আবদার মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ থেকে আজকের ‘জহির রায়হান’ নামে জগদ্বিখ্যাত হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে এক ইতিহাস। ‘জহির রায়হান’ নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন পূর্ব-পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড মণি সিংহ। ১৯৫৩ সালে উচ্চমাধ্যমিকে ঢাকা কলেজে পড়াকালীন বড়ভাই শহীদুল্লা কায়সারের সুবাদে মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। কমিউনিস্ট পার্টির প্রত্যেক কর্মীর পার্টির দেওয়া একটি আলাদা নাম থাকতো। আবু আবদার মোহাম্মদ জহিরুল্লাহর পার্টি নাম ‘রায়হান’ রেখেছিলেন কমরেড মণি সিংহ। এরপর থেকে আবু আবদার মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ দিনে দিনে পরিচিত হয়ে ওঠলেন এবং অমরত্ব লাভ করলেন ‘জহির রায়হান’ নামেই।
জহির রায়হান এক বিদ্রোহের নাম, অনুপ্রেরণার নাম। অন্যায়, অমানবিকতা, দুঃশাসন, দুর্নীতি, সামাজিক আধিপত্য ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জহির রায়হান সংগ্রামীচেতনার স্বাক্ষর রেখে গেছেন জীবনের প্রতিটি স্তরে। শিল্প-সাহিত্যের প্রতি ছাত্রাবস্থা থেকেই ছিলেন অনুরাগী। ফেনীর সোনাগাজীর আমিরাবাদ বি.সি. লাহা স্কুল অ্যান্ড কলেজে নবম শ্রেণিতে পড়াকালীন ১৪ বছর বয়সে চতুষ্কোণ পত্রিকায় জহির রায়হানের প্রথম কবিতা ‘ওদের জানিয়ে দাও’ প্রকাশিত হয়। সেই কবিতায় নিপীড়িত-নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষের প্রতি জহির রায়হানের গভীর মমত্ববোধের পাশাপাশি ফুটে ওঠে তীব্র প্রতিবাদ।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে এবং জীবনস্পর্শী প্রতিবাদী সাহিত্যধারায় জহির রায়হান এক বিশিষ্ট শিল্পী। চলচ্চিত্র তার প্রতিভার পরবর্তী আশ্রয়স্থল হলেও সাহিত্যে নিজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ করে গেছেন জহির রায়হান। সাহিত্যে তৈরি করতে পেরেছেন ‘নিজস্বতা’। তার রচিত সাহিত্যকর্ম তাকে স্বমহিমায় বাঁচিয়ে রেখেছে মানুষের তরে এবং সেসব যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকবে।
জহির রায়হান বাংলা সাহিত্যে আলাদা একটা জগত তৈরি করে গেছেন। তার সৃষ্টিশৈলী অনন্য অসাধারণ। তার লেখায় আলাদা যে ভাবরস রয়েছে বাংলা সাহিত্যে তা বিরল। তার লেখার মৌলিকত্বকে এখন পর্যন্ত এদেশের কোনও সাহিত্যিক ছুঁতে পারেননি বলে মনে করি। তার ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসের শেষ লাইন “রাত বাড়ছে, হাজার বছরের পুরনো সেই রাত” এবং ‘আরেক ফাল্গুন’ উপন্যাসের “আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হব”—এমন সৃষ্টিতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে জহির রায়হানের নিজস্বতা।
জহির রায়হানের সাহিত্যপরিমন্ডল বিশ্লেষণে দেখা যায়—তিনি মূলত নাগরিকলেখক, নগরজীবনের বাস্তবিক ঘটনাবলী তার উপন্যাসের আলোচ্য বিষয়। তার লেখা মোট সাতটি উপন্যাসের মধ্যে কেবলমাত্র ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসটি ছাড়া অন্যসব উপন্যাসের পটভূমি শহর বা নগর কেন্দ্রিক। একমাত্র ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসটিতে তিনি গ্রামীণজীবনের বাস্তবচিত্র তুলে ধরেছেন। জহির রায়হানের উপন্যাসসমগ্রকে তিনটি পর্বে ভাগ করলে এর বৈশিষ্ট্যগুলো সহজেই পাঠসীমায় অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
• আরেক ফাল্গুন ও আর কতদিন।
• হাজার বছর ধরে।
• শেষ বিকেলের মেয়ে, বরফ গলা নদী, তৃষ্ণা ও কয়েকটি মৃত্যু।
‘আরেক ফাল্গুন ও আর কতদিন’ উপন্যাস দু’টিতে ইতিহাস, রাজনীতি, আন্তর্জাতিকতা, যুদ্ধবিরোধিতা, সংগ্রামীজীবন এবং আগামী দিনে একটি শোষণ-বঞ্চনামুক্ত নতুন পৃথিবী গড়ার অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছে।
‘আরেক ফাল্গুন’ জহির রায়হানের অনবদ্য সৃষ্টি। এ উপন্যাসটি এদেশের ভাষা আন্দোলনভিত্তিক প্রথম উপন্যাস। আজ পর্যন্ত ভাষা আন্দোলন অবলম্বনে যত উপন্যাস লেখা হয়েছে সেসবের মধ্যে জহির রায়হানের ‘আরেক ফাল্গুন’ মহৎ ও সার্থক উপন্যাস।
পৃথিবীর নির্যাতিত, নিগৃহীত মানুষের সরব উচ্চারণের দলিল ‘আর কতদিন’ উপন্যাস। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির শোষণ-নির্যাতন-নিপীড়ন যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর শান্তিকামী মানুষকে করেছে বিপর্যস্ত ও দিশেহারা। ধর্মের নামে, বর্ণের নামে, জাতীয়তার নামে, সংস্কৃতির নামে মানুষকে আত্মাহুতি দিতে হয়েছে বার বার। এই নির্মম আত্মাহুতির বিরুদ্ধে নান্দনিক প্রতিবাদ জানিয়ে সুস্থ মানবতার মধ্যেই বাঁচার বীজমন্ত্র খুঁজেছেন জহির রায়হান। পাশাপাশি প্রশ্ন করেছেন সুস্থ বিবেককে—আর কতদিন চলবে এই অমানবিকতার পুনরাবৃত্তি? ঘোরঅন্ধকার থেকে মানবিকতার আলোতে আসার পথ তৈরি করতে চেয়েছেন জহির রায়হান।
‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসটি জহির রায়হানের সাতটি উপন্যাসের মধ্যে একমাত্র উপন্যাস যেটি গ্রামীণ পটভূমিতে রচিত। এই উপন্যাসে বিশেষ এক এলাকার মানুষের সহজ-সরল জীবনধারার চিত্র ফুটে ওঠেছে। তিনি সেখানে তুলে ধরেছেন পরীর দীঘি ও এর আশপাশের জনপদের চিত্র। সে জনপদ হিসেবে আকারে-ইঙ্গিতে ভাবে-ছন্দে তুলে ধরেছেন তার জন্মস্থান ফেনী জনপদকে।
‘শেষ বিকেলের মেয়ে’ উপন্যাসটি জহির রায়হানের প্রথম উপন্যাস, যাতে নগরপ্রধান মধ্যবিত্তজীবনের প্রেম ও মনোবিকলন স্থান পেয়েছে। জহির রায়হান এই উপন্যাসে মানুষের বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষাকে বেগবান নদীর মতো রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
‘কয়েকটি মৃত্যু’ উপন্যাসে কোনো মৃত্যু নেই, সেখানে কারও মৃত্যু হয় না, কিন্তু মৃত্যুভয় আছে, ভয়টি পাথরের মতো চেপে বসে বুকে। মৃত্যুকে কি এড়ানো যায়, এড়াতে পেরেছে কেউ? এ উপলব্ধি আসে এই উপন্যাসের বয়স্কচরিত্র বাবা আহমদ আলীর মধ্যে।
‘তৃষ্ণা’ শহরকেন্দ্রিক উপন্যাস। এই উপন্যাসে জহির রায়হান নগরজীবনের ব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়েছেন—যে ব্যাখ্যায় তখনকার শহুরে মানুষের জীবনযাপনের নিখুঁতচিত্র ওঠে এসেছে। বিচিত্র সব মানুষের সংগ্রামরত জীবনের ছবি, যা মূলত বেঁচে থাকারই তৃষ্ণা—এ উপন্যাসে ব্যাখ্যার মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন জহির রায়হান।
জীবদ্দশায় জহির রায়হান গল্প লিখেছেন একুশটি। তার গল্পে মধ্যবিত্তের জীবনযাপনের বাস্তবিকচিত্র ফুটে ওঠেছে। গ্রামের সামন্তপ্রভুর খবরদারির গল্পও যেমন ওঠে এসেছে, তেমনই ওঠে এসেছে নাগরিকমধ্যবিত্তের আবেগ-অনুভূতি, ব্যক্ত-অব্যক্ত আনন্দ-বেদনার গল্প। তবে নাগরিকমধ্যবিত্তই লেখনির কেন্দ্রে ছিল। তার ছোটগল্পের দুনিয়া ‘নাগরিকমধ্যবিত্তের স্বপ্ন, সংগ্রাম আর হৃদয়রহস্য নিয়ে গড়ে ওঠেছে’। বিভিন্ন আন্দোলন যেমন—পাকিস্তান আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন তার গল্পের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মাত্র একটা গল্পই লিখতে পেরেছিলেন তিনি, ‘সময়ের প্রয়োজনে’ নামে।
জহির রায়হানের গল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে মধ্যবিত্তের জীবন এবং সে জীবনের আকুতি-মিনতি, অভাব-অভিযোগ। তিনি খুব সার্থকভাবে দেখাতে পেরেছেন যে, মধ্যবিত্তের মানসিক টানাপোড়ন তার আর্থ-সামাজিক টানাপোড়নের মধ্যেই নিহিত। গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন বাংলাদেশের এক বিশেষ সময়ের মধ্যবিত্তের বিচিত্র কর্মকাণ্ড ও নানান চরিত্র। বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনে জহিরের সক্রিয় অংশগ্রহণের কারণেই তার বিভিন্ন গল্পে ঘুরেফিরে এসেছে আন্দোলন-সংগ্রাম। সেই আন্দোলনে মধ্যবিত্তের শুভ-অশুভ, বিদ্রোহী-আপসকামী বিপরীতধর্মী দুই বৈশিষ্ট্যেরই উপস্থিতি রয়েছে।
জহির রায়হান ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারী ১৪৪ ধারা ভঙ্গের মিছিলে প্রথম দশজনের একজন ছিলেন। সে হিসেবে ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’, ‘আরেক ফাল্গুন’, ‘একুশের গল্প’ তার ব্যক্তিগত সংগ্রামমুখর জীবনের অভিজ্ঞতার বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করি। এ প্রসঙ্গে হুমায়ুন আজাদ যথার্থই বলেছেন, “জহির রায়হান সম্ভবত বাংলাদেশের একমাত্র কথাসাহিত্যিক যার উদ্ভবের পেছনে আছে ভাষা আন্দোলন, যদি বায়ান্ন’র একুশ না ঘটতো তবে জহির রায়হান হয়তো কথাশিল্পী হতেন না।”
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বব্যাপী জনমত তৈরি করার ক্ষেত্রে তার নির্মিত চলচ্চিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’ কার্যকর ভূমিকা রেখেছিল। স্টপ জেনোসাইডের মাধ্যমে তিনি শরণার্থী ক্যাম্প, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে মিটিং, সভা-সমাবেশে জনমত গঠন করেছিলেন। কলকাতায় তার নির্মিত চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’র কয়েকটি প্রদর্শনী হয়েছিল। যে প্রদর্শনীতে উপস্থিত ছিলেন—সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, তপন সিনহাদের মতো বিখ্যাত নির্মাতারা। চলচ্চিত্রটি দেখার পর সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, ‘এ এক অনন্য প্রতিভা, চলচ্চিত্রে এক নতুন যাত্রার সূচনা হলো। এক দুর্দান্ত প্রতিভাবান চলচ্চিত্রকারের মাইফলক।’ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে দেশে ও বিদেশে জনমত সৃষ্টির পক্ষে জহির রায়হানের ভূমিকা বলে-লিখে শেষ করা যাবে না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর তার নির্মিত ২০ মিনিট দৈর্ঘ্যের প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ‘স্টপ জেনোসাইড’ বিশ্বইতিহাসে আজও গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক।
নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিসংগ্রামের ভেতরে তেইশ বছরের শোষণ-বঞ্চনার যে ক্ষতগুলো জড়িয়ে ছিলো, রোদ পোহালেই তা শুকিয়ে যায় না—এ কথা কী আমরা জানতে পেরেছিলাম ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারির আগে?
১৯৭১ সালের ১৬-ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী মুক্ত হয়; কিন্তু মিরপুর হানাদারমুক্ত হয় ১৯৭২ সালের ৩১ জানুয়ারি। ১৬ ডিসেম্বরেই দেশে ফিরে এসেছিলেন জহির রায়হান। বড়ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে আল-বদররা ধরে নিয়ে গেছে, এ খবর তিনি দেশে ফেরার আগেই পেয়েছিলেন। দেশে ফিরেই তিনি বুদ্ধিজীবী হত্যা ও গণহত্যার তথ্য অনুসন্ধান ও ঘাতকদের ধরার জন্যে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করেছিলেন।
ভাইকে খোঁজার জন্যে নানা নির্ভর-অনির্ভরযোগ্য সংবাদের ওপর ভিত্তি করেই বেরিয়ে পড়েন জহির রায়হান। ১৯৭২ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলন ঘোষণার পাঁচদিন পর ৩০ জানুয়ারি রোববার সকালে রফিক নামের এক অজ্ঞাত টেলিফোনকল আসে জহির রায়হানের কায়েতটুলির বাসায়। টেলিফোনে জহির রায়হানকে বলা হয়েছিল, আপনার বড়দা শহীদুল্লা কায়সার মিরপুর ১২ নম্বরে বন্দী আছেন। যদি বড়দাকে বাঁচাতে চান তাহলে মিরপুর চলে যান। একমাত্র আপনি গেলেই তাকে বাঁচাতে পারবেন। সেদিন সন্ধ্যায় প্রেসক্লাবে তার চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু টেলিফোন পেয়ে সেদিন ৩০ জানুয়ারি সকালেই জহির রায়হান দুটো গাড়ি নিয়ে মিরপুরে রওনা দিয়েছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন ছোটভাই জাকারিয়া হাবিব, চাচাতোভাই শাহরিয়ার কবির, শ্যালক বাবুলসহ আরও তিনজন। মিরপুর ২ নম্বর সেকশনে পৌঁছানোর পর সেখানে অবস্থানরত ভারতীয় সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা তৎকালীন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও পুলিশের সদস্যরা নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে জহির রায়হানের টয়োটা গাড়িসহ তাকে থাকতে বলে বাকিদের ফেরত পাঠিয়ে দেন। এরপর আর জহির রায়হানকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেদিন মিরপুরে অবাঙালি অধ্যুষিত এলাকায় অবস্থানকারী পলাতক পাকিস্তানি সৈন্য, অবাঙালি রাজাকার ও আল-বদরদের অতর্কিতে হামলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও পুলিশের শতাধিক সদস্য নিহত হয়েছিলেন। এদিনই নিহত হয়েছিলেন জহির রায়হান। কিন্তু তার মৃত্যুরহস্য নিয়ে পরিস্কার জল ঘোলা করেছে পাকিস্তানি দোসররা। নানারকম মিথ্যাচার করেছে দীর্ঘ একটি সময় ধরে। অবশেষে ‘দৈনিক ভোরের কাগজ’-এ সাংবাদিক জুলফিকার আলি মানিকের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয় কীভাবে অবাঙালি, আল-বদর, রাজাকারদের গুলিতে জহির রায়হানকে হত্যা করা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে ওঠে আসে ঘটনার সত্যতা। অবসান হয় মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের ছড়ানো সকল বিভ্রান্তির।
পাশাপাশি মগজে প্রশ্ন জাগে—কেন সেদিন সুপরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছিল, তিনি এমন কী জানতেন, তার কাছে এমন কী তথ্য-উপাত্ত ছিল, তাকে মেরে কাদের লাভ?
আজও যখন কিছু নামধারী প্রত্যাখ্যাত-বিখ্যাত রাজনীতিবিদরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে নানা রকমের বিভ্রান্তি রটানো শুরু করেন, মুক্তিযুদ্ধে শহিদের গাণিতিক সংখ্যার উদ্ভট কুযুক্তি তৈরি করেন—তখন বারবার মনে পড়ে জহির রায়হানের সত্যদর্শী মহতীশিল্পের কথা।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণ তথা দেশের প্রতি একজন শিল্পীর ভালোবাসা বা দেশপ্রেম কেমন হবে—তারুণ্যের তেজে বলীয়ান হয়ে সম্ভাবনাময়জীবন বিসর্জন দিয়ে তা বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন জহির রায়হান। বর্তমান সময়ে যখন দেশজুড়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প, সাম্প্রদায়িক অপশক্তির দৌরাত্ম্য বিরাজমান—তখন জহির রায়হানের অভাব দারুণভাবে অনুভূত হচ্ছে।
এক জহির রায়হানকে হারিয়ে আমরা পিছিয়ে গেছি বহুদূর। মাত্র ৩৭ বছরের কর্মময় জীবনে জহির রায়হান এদেশকে অনেক কিছু দিয়েছেন, লাভ করেছেন অমরত্ব, হয়েছেন প্রেরণার প্রতীক। অকালেই অপমৃত্যু ঘটলো জহির রায়হানের। তার মতো উজ্জ্বল নক্ষত্রের এ দেশকে আরও অনেক কিছু দেওয়ার বাকি ছিল। তিনি বেঁচে থাকলে আমরা আরও প্রগতির পথে অগ্রতির পথে এগিয়ে যেতে পারতাম। স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পেরিয়ে গেছে অথচ তার মৃত্যুরহস্য আজও কেন অমীমাংসিত—সে প্রশ্ন না ওঠে পারে না। জহির রায়হান কালান্তরের প্রেরণার প্রতীক, প্রজন্মের প্রেরণা—তাকে আমরা কোনদিনও ভুলবো না, ভোলা সম্ভবও না।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
ইমরান ইমন জহির রায়হান সমাচার: কেন তার মৃত্যুরহস্য আজও অমীমাংসিত মুক্তমত