আমাদের সৃষ্টি হয়েছে মানবীয় গুণাবলি, জ্ঞান, বিবেক ও বুদ্ধি দিয়ে
১৯ আগস্ট ২০২৩ ১৬:৫২
পৃথিবীর প্রতিটি শিক্ষাভবনে, বাড়িতে, ধর্মাচারণে বাবা-মার প্রতি দায়িত্ববোধের কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এসবের আলোকে নৈতিক শিক্ষার বলয়ে প্রজন্মকে গড়ে তুলতে পারলে বৃদ্ধাশ্রম শব্দটি ভেসে যেতে বাধ্য অনেকের মতে। নৈতিকতার ওপর শিক্ষা নেই বা নৈতিকতাবর্জিত শিক্ষায় গড়ে ওঠা প্রজন্ম এসব দায়বোধ ও কর্তব্যের প্রয়োজনীয়তাকে বুঝে উঠতে পারছে না এমনটিও অনেকে বলবে। অনেকের ধারণা বৃদ্ধ বাবা-মা উপরিবোঝা। সেক্ষেত্রে তাদের চিন্তায় বাব-মার উপযুক্ত স্থান বৃদ্ধাশ্রম। কিন্তু যাদের অর্থনৈতিক সামর্থ্য নেই তাদের বাবা-মা ঠিকই সন্তানের ওপর নির্ভরশীল। এসব শুধু দরিদ্র দেশের বেলায় দেখা যায়। কিন্তু সত্য বুঝতে অক্ষম হলে চলবে না যে তারাও একদিন এভাবেই তাদের সন্তান-সন্ততির দ্বারা বৃদ্ধাশ্রমে নিক্ষিপ্ত হবে। তবে অপ্রিয় সত্য যে বাবা-মা ঠিক একইভাবে তাদের সন্তানকে প্রি-স্কুল বা কিন্ডারগার্টেনে রেখে কর্মজীবন পার করেছেন।
পাশ্চাত্যে শিশুর জীবনের শুরু এবং বৃদ্ধ জীবনের শেষে এমনটি ঘটে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে মা সাধারণত শিশুর পুরো দায়িত্ব নিয়ে থাকে যা বিশ্বের কোনো ধনী দেশে দেখা যায় না। তবে এ এখন হয়ত ইতিহাস হতে চলেছে। যাই হোক পরিবর্তনের যুগে সেন্সিটিভ হলে সংসার চলবে না, সেক্ষেত্রে মানিয়ে নিতে শিখতে হবে।
বস্তুত বৃদ্ধাশ্রম ভোগবাদী সমাজের সন্তানদের দায় এড়ানোর একটা বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা যা পশ্চিমা দুনিয়ার পরিবারকে, পারিবারিক ঐতিহ্যকে মানিয়ে নিতে সাহায্য করেছে যা মুসলিম-গরীব সমাজ নির্বিশেষে বৃদ্ধাশ্রম মানব সভ্যতার একটি কলঙ্ক। এমনটি বলা হয় কারণ মুসলিম সমাজে মা-রাই বাইরে কাজ করেন না তবে এখন এরও পরিবর্তন হতে চলেছে। কিছু অত্যুৎসাহী প্রভাবশালী ক্ষমতাশ্রয়ী তথাকথিত প্রগতিবাদীদের কল্যাণে আমরা ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছি এই কলঙ্ক তিলকের দিকে।
নৈতিকতাবোধসম্পন্ন শিক্ষাকে পাশ কাটিয়ে বস্তুবাদী শিক্ষার পরিণতি এটাই। পরিবার ও সমাজকে ভাঙনের হাত থেকে বাঁচাতে হলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠক্রমে নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধ সম্পর্কে পাঠদান দিতে হবে। জানিনে কাজ হবে কিনা তবে চেষ্টা করলে ক্ষতি কি!
আমার ছাত্রজীবনে সুইডিশ বৃদ্ধাশ্রমে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে। ঘটনাটি আমার সুইডেনে প্রথম বছরে সামার জবের একটি স্মরণীয় ঘটনা, যা হৃদয়ে গেঁথে আছে আজও। সেটি ঘটেছিল সুইডেনের একটি বৃদ্ধাশ্রমে। সাইমোন এবং ছারা অবসরপ্রাপ্ত সুইডিশ নাগরিক, থাকতেন সেই বৃদ্ধাশ্রমে। দুইজনেরই বয়স ৭০ প্লাস। আমার বিশ্ববিদ্যালয় সামারে তিন মাস ছুটি। স্টকহোমে এসেছি সামার জব করতে। বৃদ্ধাশ্রমে কাজ পেয়েছি। এখানে বৃদ্ধদের দৈনন্দিন কাজে সাহায্য করাই ছিল আমার কাজ। হুইলচেয়ারে করে তাদের নিয়ে পার্কে ঘোরাঘুরি করা ছিল কাজের একটি অংশ।
বৃদ্ধদের সাথে নানা বিষয়ের উপর কথা বলা ছিল আমার সুইডিশ ভাষা শেখার একটি ভালো সুযোগ। এদের সামাজিক এবং মানসিক দিকগুলো জানার এক অপূর্ব সুযোগ পেয়েছি তখন। সাইমোন এবং ছারা প্রায় ৫০ বছর এক সঙ্গে বিবাহিত জীবন পার করে আসছে। তাদের এক ছেলে নাম আন্দেস, চাকরি করে স্টকহোমের বাইরে। বাবা-মার সাথে খুব একটা দেখা হয়না। সাইমোন এবং ছারা প্রায়ই তাদের ছেলের ব্যাপারে আমার সঙ্গে আলোচনা করে। সবে বাংলাদেশ থেকে এসেছি, তাই তাদের ছেলের প্রতি দরদ দেখে নিজের পরিবারের কথা মনে পড়ত। প্রতিদিন ঘুমানোর সময় সাইমোন এবং ছারার নানা ধরণের ওষুধ খাওয়ানো ছিল আমার কাজের আরও একটি অংশ।
আমি প্রায়ই লক্ষ্য করেছি তারা আমাকে বলত, রহমান তুমি চলে যাও আমরা পরে ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ব। আমি কখনও তাদের কাজকর্মে কোনোরকম সন্দেহ করিনি, তারপরও আমার বসকে একদিন বিষয়টি বললাম। বস বললেন, ঠিক আছে তারা যদি নিজেরা ওষুধ খেতে ভুলে না যায় তাহলে সমস্যা নেই। কিন্তু তুমি দেখো তারা যদি ভুল করে ওষুধ সেবন না করে তবে অবশ্যই তুমি ওষুধ খাইয়ে তবে বাসায় যাবে।
আমি কখনো দেখিনি তারা ওষুধ খেতে ভুলেছে বা টেবিলে রেখে দেয়া ওষুধ টেবিলেই রয়ে গেছে। সাইমোন এবং ছারাকে সবাই পছন্দ করে। আমি প্রায় দুইমাসের বেশি কাজ করছি। তাই সবার সঙ্গে একটি ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। হঠাৎ একদিন সকালে এসে সাইমোন এবং ছারার রুমে নক করছি কিন্তু তারা দরজা খুলছে না। কী করি? একস্ট্রা চাবি এনে ঘর খুলে দেখি সাইমোন এবং ছারা দুজনে দুজনার হাতে হাত রেখে চিরনিদ্রায় শায়িত। কী ব্যাপার? কী হয়েছে? কেউ কিছু বলতে পারছে না। ডাক্তার এবং পুলিশ এসে তদন্ত শুরু করল, আমাকেও হাজারটা প্রশ্ন করল। আমি যা জানি তাই বললাম। নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার পর জানা গেল ওভারডোজ ওষুধ খেয়ে তারা মারা গেছে। কিন্তু এত ওষুধ পেল কী করে? তদন্তে জানা গেল মাসের পর মাস ওষুধ জমা করে এক সঙ্গে সব ওষুধ খেয়ে তারা মারা গেছে। আমিসহ যারা সাইমোন এবং ছারাকে সাহায্য করি আমাদের কাজ তাদের সেবা করা এবং তাদের আদেশ মেনে চলা। যেহেতু দুজনই সুস্থ্য মস্তিস্কের অধিকারী তাই আমাদের কারও কোনো সন্দেহ ছিল না। তারপরও দুজনের মৃত্যুর কারণে বৃদ্ধাশ্রমে তখন থেকে কিছু নতুন নিয়ম চালু করা হয়। তার মধ্যে একটি হলো ওষুধ সেবনে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সরাসরি সাহায্য করা। হঠাৎ এত বছর পরে সেদিনের সেই ঘটনা আজ মনে পড়ে গেল।
কারণ আজ সুইডিশ টেলিভিশনে একটি খবর তুলে ধরেছে। বিশ্বের অনেক দেশে যদি কেউ কঠিন অসুখে ভোগা অবস্থায় বেঁচে থাকতে না চায়, তবে কিছু পেশাদার ডাক্তার তাদের মরতে সাহায্য করে ওষুধ দিয়ে। সুইজারল্যান্ড তার মধ্যে অন্যতম। গত তিন বছর আগে সুইডেনের একজন এএলএস রুগী মৃত্যুবরণ করতে সুইজারল্যান্ডের একজন ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। সবকিছু ঠিকঠাক এমন সময় কভিড-১৯ এসে সব বানচাল করে দেয়। এএলএস (অ্যামাইটোট্রপিক ল্যাটারাল স্ক্লেরোসিস) লৌ গেহ্রিগ রোগ নামেও পরিচিত। এটি একটি নিউরোলজিক্যাল বা স্নায়ুর রোগ। এটা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খারাপ হয় এবং আরও বেশি কষ্টদায়ক হয়ে ওঠে। এই রোগটি অক্ষমতা সৃষ্টি করে, কারণ এটি নার্ভের কোষগুলিকে ধ্বংস করে দেয়। সামান্য উপসর্গের সাথে রোগটি শুরু হয় যেমন হাঁটা চলা এবং শ্বাস প্রশ্বাসের অক্ষমতার সঙ্গে সঙ্গে এটি বাড়তে থাকে। সুইডিশ এই রুগী ভুগে ভুগে জ্বালা যন্ত্রণার মধ্যে বেঁচে থাকতে চায় না। কিন্তু সুইডেন তাদের মোরাল ও এথিকসের বিষয়টি মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তারা কাউকে মরতে সাহায্য করবে না, যার কারণে সুইডেন থেকে এই এএলএস রুগী দেশের বাইরে গিয়ে মরবে বলে প্লান করেছিল। গত কয়েক মাস আগে সুইডেনের একজন অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তার সুইডিশ নিয়ম ভঙ্গ করে সেই এএলএস রুগীকে মরতে সাহায্য করে। অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তার মনে করেন যদি কেউ স্বেচ্ছায় তার নিজ জীবন নিতে চায় তবে কেন তাকে বাঁধা দিতে হবে? কষ্টে বেঁচে থাকার চেয়ে যদি কেউ মরতে চায় তবে পেশাদার ডাক্তারের সে ব্যাপারে সাহায্য করা উচিত।
বিষয়টি নিয়ে সুইডেনে বেশ তোলপাড় হয়েছে। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত সুইডিশ পার্লামেন্ট কী সিদ্ধান্তে আসে এবং অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তার কী সাজা পায়! ডাক্তারের ডাক্তারি লাইসেন্স বাতিল হবে নাকি জেল-জরিমানা হবে সেটি দেখার বিষয়। অনেক ধর্মপ্রাণ মানুষের চিন্তা সুইডেনও কি তাহলে স্বেচ্ছায় রুগী মরতে আইন পরিবর্তন করবে? ঘটনাটি শেষ দেখার আশায় সবাই। আজ থেকে প্রায় ছত্রিশ বছর আগে সাইমোন এবং ছারা নিজেদের দায়িত্বে সবার অজান্তে মৃত্যুবরণ করে সত্ত্বেও সুইডিশ জাতি আইন চেঞ্জ করেনি, দেখি এবার কী হয়।
মানুষ জাতির মৃত্যুর পেছনে সব সময় একটি কারণ থাকে। এখন যদি কেউ মৃত্যুশয্যায় মরে বেঁচে থাকতে না চায় সেক্ষেত্রে বিষয়টি নতুন করে ভাববার বিষয় হতে পারে। তবে যারা ধর্মে বিশ্বাসী তারা জানে নিজের জান নিজে নেয়া মহাপাপ তারপরও এমনটি ঘটে চলেছে সারা বিশ্বে এমনকি বাংলাদেশেও। গত কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের গণ মাধ্যমে দেখছি এক লোক ফেসবুক লাইফে এসে আত্নহত্যা করেছে। কী কারণে এমন ঘটেছে সেটাও বর্ণনা করেছে। নানা জনের নানা মত, দ্বিমত লক্ষ্য করছি। সব থাকতেও কোথাও কেও নেই। এ ধরনের ঘটনা সুইডেনসহ বিশ্বের অনেক দেশে ঘটে চলছে। যেমন জাপানে সুইসাইডের হার বেশি তুলনা করলে অন্যান্য দেশের সঙ্গে।
বাংলাদেশে প্রতিদিনই এ ধরনের আত্মহত্যা হচ্ছে (গলায় দড়ি, গাড়ির নিচে, বিষ খেয়ে ইত্যাদির মাধ্যমে)। তা সত্ত্বেও ফেসবুক লাইফের মৃত্যুটা সবার বিবেকে বেশ নাড়া দিয়েছিল। জানিনে পরে কি হয়েছে! হতাশার কারণে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে বা ডেপ্রিশনের কারণে সাধারণত এমনটি ঘটে। মানসিক ভারসাম্য বা ডিপ্রেশন মানুষের মধ্যে হঠাৎ সৃষ্টি হয় না কিন্তু দুর্ঘটনা যখন ঘটে সেটা হঠাৎই ঘটে এবং তখন আমরা রিয়াক্ট করি। সুইডিশ ভাষায় আমরা অনেক সময় বলি “tänk före efter” মানে হচ্ছে ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না। এটা যদি শুধু প্রবাদ বাক্য হিসাবেই ব্যবহার করা হয় তাহলে সমস্যার সমাধান হবে না। সেক্ষেত্রে আমাদের উচিত হবে পরিবার, প্রতিবেশী এবং যারা একাকিত্ব জীবনযাপন করছে তাদের খোঁজখবর নেওয়া। কারণ স্রষ্টা আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন মানবীয় গুণাবলি দিয়ে, জ্ঞান, বিবেক ও বুদ্ধি দিয়ে। যে কারণে জীবজগতের মধ্যে আমরাই শ্রেষ্ঠ জীব। কাজেই সেরা হিসেবে আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক বেশি। আমরা কি সে দায়িত্বটুকু সঠিকভাবে পালন করতে পারছি!
লেখক: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
সারাবাংলা/এসবিডিই
আমাদের সৃষ্টি হয়েছে মানবীয় গুণাবলি জ্ঞান বিবেক ও বুদ্ধি দিয়ে মুক্তমত রহমান মৃধা