Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সুখরঞ্জনবালি ও জামায়াতের রাজনীতির ভয়ংকর ক্ষত

তানজিব রহমান
২১ আগস্ট ২০২৩ ১৭:৫৭

আন্তর্জাতিক আইনে গণহত্যা এবং যুদ্ধাপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। কাউকে কোনো রাষ্ট্র বা ব্যক্তি এ অপরাধ থেকে ছাড় দিতে পারেনা। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের সঙ্গে তুলনা করলে, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল এগিয়ে থাকবে। যদি রুয়ান্ডা বা যুগোস্লাভিয়ার গণহত্যা ট্রাইব্যুনালের সাথে ও তুলনা করা হয়, তাতেও বাংলাদেশকে এগিয়ে রাখেন আন্তর্জাতিক অপরাধ বিশ্লেষকরা। তার উল্লেখযোগ্য কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের এ রায়কে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ করবার সুযোগ আছে যা পৃথিবীর অন্য কোথাও নেই। তার পরও বাংলাদেশের মানবতা বিরোধী অপরাধীদের বিচার কার্যক্রম ও রায়কে প্রশ্নবিদ্ধ করার নানা অপপ্রয়াস ও ষড়যন্ত্র আমরা বারবার দেখেছি।

বিজ্ঞাপন

একাত্তরের মানবতা বিরোধী অপরাধীদের বিচারকে বিতর্কিত করতে অনেক আজগুবি গল্প মানুষের মুখে মননে মগজে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল। চাঁদে সাঈদী দেখা যায়, সাঈদী ৭১ সালে ১২ বছরের মাসুম বাচ্চা ছিলেন, দেলু সিকদার আর দেইল্লা রাজাকার এক ব্যক্তি নয়, তখন জামায়াতের সাথে তার কোন সম্পর্ক ছিলনা, তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার একথা গুলো যারা বলতেন তারাই এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখছেন- ‘বিদায় হে রাহবার ১৯৪০-২০২৩’! এখন প্রশ্ন হচ্ছে একাত্তর সালে তার বয়স কত ছিল? তিনি মারা যাবার পর পরই পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী তাদের ফেসবুক পেজে উর্দু ভাষায় তার ছবিসহ শোক বার্তার পোস্টারও প্রকাশ করেছে। এতো দিন যারা নানান কথা তুললেন তারা এখন কী বলবেন? বাস্তবতা হচ্ছে সত্য কখনো চাপা থাকে না।

বিজ্ঞাপন

মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয় অর্জনের মাত্র দেড় মাসের মধ্যেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি ‘দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনালস) আদেশ’ জারি করা হয়। দালাল আইনের অধীনে ৩৭ হাজারেরও বেশি ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে বিভিন্ন আদালতে তাদের বিচার শুরু করা হয়। এরপর পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধী এবং তাদের সহযোগীদের বিচারের জন্য ১৯৭৩ সালের ২০ জুলাই ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন’ পাস করা হয়। ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইন বাতিল করা হলে ঐ আইনের অধীনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্তদের বিচার বিষয়ে ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে বাংলাদেশে বিশেষত তরুণ প্রজন্মের মাঝে ব্যাপক জাগরণ সৃষ্টি হয়। ইতিহাসের দায় থেকে আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে এই গণদাবি অন্তর্ভুক্ত করে। ২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশভাবে বিজয় লাভ করার পর পরই নির্বাচিত দল আওয়ামী লীগ কর্তৃক গঠিত সরকার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিচারের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এরপর ২০০৯ সালের ২৯শে জানুয়ারি জাতীয় সংসদে এই বিষয়ে একটি প্রস্তাব পাশ করা হয় যা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনে কার্যকর উদ্যোগ।
একাত্তরের পরাজিত শক্তি বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য রায়ের কপি চুরি করিয়েছিল, দেশী বিদেশী লবিস্ট নিয়োগ করেছিল, সাইবার অপরাধসহ আরো না পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল যার কোন কিছুই ধোপে টেকেনি তাদের সকল অপচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় পাকিস্তানের বিশাল সৈন্য বাহিনী ছিল, তখনও আমেরিকার সাহায্য সহযোগিতা ছিল, চীনের অস্ত্র আর রশদ ছিল, তার পরও ১৯৭১ সালে মুক্তিকামী বাঙালীর সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল বাঙালীদের শোষক পাকিস্তান। ৯৩ হাজার পাকহানাদার বাহিনী বাঙালীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ঐতিহাসিক রেইসকোর্স ময়দানে। যে ইতিহাস পৃথিবীতে বিরল। বাঙালীর গৌরবগাথা এ ইতিহাসকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিতে হবে। নতুবা পরাজিত শক্তির দোসর রাজাকার আলবদরদের উত্তরসূরীরা মিথ্যা আর গুজবে তা ঢেকে দিতে চেষ্টা করবে নানান মিথ আর মনভোলানো গল্পে।

তেমনটিই আমরা দেখলাম একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুর পর। পুরো বাংলাদেশ দেখলো যে তার স্বাভাবিক মৃত্যুকে নিয়ে কেমন অপরাজনীতি করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যাবহার করে ঢাকাকে অস্থির করবার একটি চক্রান্তও লক্ষ্য করা গেছে। জানাজার সময় সুখরঞ্জন বালিকে সামনে এনে আবারো কীভাবে অপপ্রচার চালাচ্ছে জামায়াতপন্থী ইউটিউবাররা। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে তারা আবারো বিতর্কের মুখে ফেলে দিতে চাইছে। যা তাদের বাংলাদেশ বিরোধী মনোভাব যা তাদের পুরনো অভ্যাস। সুখরঞ্জন বালির ভাই ভিসাবালি ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকালে আমৃত্যু সাজাপ্রাপ্ত মানবতা বিরোধী অপরাধী দেলাওয়ার হোসেন সাঈদীর আল বদর বাহিনী কর্তৃক নিহত হন। জামায়াতে ইসলামী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে নানান অপকৌশল হিসেবে সাক্ষীদের ভয়ভীতি ও উপঢৌকন দিয়ে সাক্ষ্যদানে বিরত রাখে। সুখরঞ্জন বালিও কি তাদের ভয় ভীতি আর উপঢৌকনের শিকার হয়েছেন?

সুখরঞ্জন বালি ছাড়াও মামলায় সাঈদীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্যগ্রহণে তদন্ত কর্মকর্তাসহ ২৭ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দান করেন। তাদের মধ্যে ২০ জন ঘটনার বিষয়ে এবং সাতজন জব্দ তালিকার বিষয়ে সাক্ষ্য দান করেন। এ সাক্ষীদেরই একজন গৌরাঙ্গ সাহা ১৩ জুন ২০১৭ দৈনিক প্রথম আলোকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে (সাক্ষীদের দুঃসহ ‘বন্দিজীবন’,) বলেন- ‘সাক্ষ্য না দিতে সাঈদীর ছেলে এক ব্যাগ নিয়া আইছিল। বলছিল, “ভারত চলে যাও।” যাইনি’। রাষ্ট্রপক্ষের আরেক সাক্ষী মোস্তফাকে সিঁদ কেটে ঘরে ঢুকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ২০১৩ সালের অক্টোবরে, প্রধান সাক্ষী মাহাবুবুর রহমানের প্রাণনাশের জন্য বাড়িতে জামায়াত শিবির হামলা চালালে তিনি সৌভাগ্যবশত প্রাণে রক্ষা পান। ২০২১ সালে ৭২ বছর বয়সী বৃদ্ধ সাক্ষী জলিল শেখকে তাঁর দোকানে হামলা করে একজন অপরিচিত ব্যক্তি। জলিল শেখ গুরুতর আহত হলেও তার আশপাশে পুলিশি পাহারা থাকায় দ্রুত উদ্ধার হয়ে প্রাণে বেঁচে যান। এসব কারণেই হয়তো সুখরঞ্জন বালি নিজেকে জামায়াতের শান্তিবাহিনীদের হাতে সোপর্দ করেছেন।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে বিএনপি’র ছত্রছায়ায় বিএনপি’র বহুদলীয় গণতন্ত্রের মোড়কে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে যেভাবে পুনবার্সিত হয়েছিল রাজনীতির সে সুখ যে তাদের কপালে একদিন অসুখ বা বিসুখ হিসেবে ধরা দেবে তা তারা ভুলে গিয়েছিল। সুখরঞ্জন বালিরা যেন জামায়াতের অস্ত্র আর টাকার বলি না হন সে অভয় তাদের দিতে হবে? বিচারের এ পর্যায়ে ভুক্তভোগীরা সন্তোষ প্রকাশ করছেন। কিন্তু সব যুদ্ধাপরাধীর বিচারের শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই কার্যক্রম চলমান রাখার জোরালো দাবি রয়েছে।

লেখক: গবেষক ও কলাম লেখক

সারাবাংলা/এসবিডিই

তানজিব রহমান মুক্তমত সুখরঞ্জনবালি ও জামায়াতের রাজনীতির অসুখ-বিসুখ

বিজ্ঞাপন

সিইসি ও ৪ কমিশনারের শপথ আজ
২৪ নভেম্বর ২০২৪ ০১:৩৩

আরো

সম্পর্কিত খবর