সর্বজনীন পেনশন স্কিম: যুগান্তকারী উদ্যোগ
২১ আগস্ট ২০২৩ ১৫:৫৮
সম্প্রতি চালু হয়েছে সবার জন্য পেনশন প্রকল্প। কেবল সরকারি চাকরিজীবী নয়, পেনশন পাবে যেকোনো শ্রেণিপেশার মানুষ। উন্নত দেশে বৃদ্ধ বয়সে নাগরিকদের টিকে থাকার যে সুবিধা দেওয়া হয়, দেরিতে হলেও তার সূচনা হলো বাংলাদেশেও। বয়স ১৮ হলেই এই সুবিধার আওতায় আসতে পারবে যে কেউ।
এই পেনশন স্কিমের আওতায় নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত। অর্থাৎ ১৮ থেকে ৫০ বছর বয়সী কর্মক্ষম সব নাগরিকই সর্বজনীন এই পেনশন ব্যবস্থায় স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করতে পারবেন।
যে বয়সেই টাকা জমানো শুরু করুক না কেন, নিবন্ধনের পর আপনার বয়স ৬০ বছর হওয়া পর্যন্ত মাসিক চাঁদা পরিশোধ করতে হবে। আপনার বয়স ৬০ বছর পার হওয়া মাত্রই প্রতিমাসে আসতে থাকবে পেনশন। বয়স ৭৫ বছর হওয়া পর্যন্ত প্রতি মাসে পেনশনের টাকা পাবেন একজন পেনশনার। নিবন্ধিত পেনশনার বয়স ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে মারা গেলে তার নমিনি মূল জমাকারীর বয়স ৭৫ বছর পর্যন্ত মাসিক পেনশন পাবেন। কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার আগে নিবন্ধিত চাঁদাদানকারী মারা গেলে জমা করা অর্থ মুনাফাসহ তাঁর নমিনিকে ফেরত দেওয়া হবে।
এই পেনশন স্কিমটিতে যতবেশি বছর টাকা বা চাঁদা জমা দেবেন, ততবেশি সুবিধা মিলবে। যেমন–
ক. ১৮ বছর বয়সী কেউ যদি মাসে ২ হাজার টাকা করে জমা দেন। তাহলে ৪২ বছর টাকা জমা করার পর, তিনি মাসে পাবেন প্রায় ৬৯ হাজার টাকা করে।
খ. যদি ২০ বছর থেকে জমানো শুরু করেন, তাহলে ২ বছরের জন্যই এই টাকা কমে হয়ে যাবে ৫৮ হাজার টাকা।
গ. যদি আরও ৫ বছর পরে জমানো শুরু করেন, তাহলে ৩৫ বছর জমানো শেষে প্রতিমাসে টাকা আসবে ৩৮ হাজারের কিছু বেশি। অর্থাৎ যতবেশি দিন টাকা জমা দেওয়া হবে, সুবিধাও ততবেশি পাওয়া যাবে।
ঘ. পেনশনের অর্থ বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য হবে এবং আয়কর মুক্ত থাকবে।
ঙ. এই পেনশন স্কিমে যুক্ত হওয়া শুরুতে ঐচ্ছিক হলেও পরে তা সবার জন্য বাধ্যতামূলক করা হবে।
চ. সরকারি চাকরিজীবীদের পেনশন ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে, দেশের সব নাগরিক আসবে একই ছাতায় এবং একই ধরণের পেনশন স্কিমের আওতায়।
মোট ৪ ধরণের পেনশন স্কিম থাকবে। যথা–
১. যারা দেশের বাইরে থাকেন, তাদের জন্য রয়েছে প্রবাস স্কিম।
প্রবাসীদের টাকা জমা করার সুযোগ বেশি। ফলে তারা রিটার্নও পাবেন বাকিদের প্রায় দ্বিগুণ। এই স্কিমে মাসে সর্বনিম্ন ৫ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত জমা করা যাবে।
২. বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য আছে প্রগতি স্কিম।
এই স্কিমে মাসে সর্বনিম্ন জমা ২ হাজার এবং সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা। চাকরি বদলালেও নেই সমস্যা। পেনশন স্কিম, স্কিমের ধারাবাহিকতায় চলতে থাকবে।
৩. অনানুষ্ঠানিক বা আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিতদের জন্য রয়েছে সুরক্ষা স্কিম।
রিক্সা-চালক, কৃষক, শ্রমিক, কামার, কুমার, জেলে ও তাঁতি ইত্যাদি স্বকর্মে নিয়োজিত নাগরিকরা এই স্কিমের আওতায় পড়বেন। তারা মাসে জমা করতে পারবেন ১, ২, ৩ এবং ৫ হাজার টাকা করে।
৪. নিম্ন-আয়ের মানুষদের স্কিমের নাম রাখা হয়েছে সমতা স্কিম।
এখানে মাসে জমা করা যাবে ১ হাজার টাকা। এরমধ্যে ৫০০ টাকা দেবে সরকার। এই ৫০০ টাকা করে ৪২ বছর জমালে একজন মাসে পাবেন প্রায় সাড়ে ৩৪ হাজার টাকা। এই স্কিমে নিবন্ধিত পেনশনারদের যাদের নিজেদের টাকা পুরোপুরি দেওয়ার সাধ্য নেই, তাদের কিস্তির অর্ধেক দেবে সরকার।
সর্বজনীন পেনশন কর্তৃপক্ষের চালু করা ওয়েবসাইটের ঠিকানা হচ্ছে (www.upension.gov.bd) সর্বজনীন পেনশন স্কিমের অন্তর্ভুক্ত হতে এই ওয়েবসাইটে গিয়ে নিবন্ধন করতে হবে। এরজন্য জাতীয় পরিচয়পত্র বা এনআইডি থাকা আবশ্যক। বাংলাদেশি প্রবাসী– যাদের এনআইডি নেই, তারা পাসপোর্টের ভিত্তিতে নিবন্ধন করতে পারবেন। তবে দ্রুততম সময়ের মধ্যে এনআইডি সংগ্রহ করে পেনশন কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিতে হবে।
পেনশন স্কিমে নিবন্ধনের জন্য যা কিছু প্রয়োজন হবে–
১. মোবাইল নম্বর ও ই-মেইল আইডি।
২. ব্যক্তিগত তথ্য প্রদান করতে হবে। দিতে হবে আয় ও পেশা সংক্রান্ত তথ্য।
৩. নমিনির তথ্য, ব্যাংকের তথ্য প্রদান করে পেশা অনুযায়ী স্কিম ও চাঁদার পরিমাণ নির্ধারণ করতে হবে।
এভাবেই নিজে অনলাইনে ফর্ম পূরণ করে অথবা সরাসরি সোনালী ব্যাংকের যেকোনো শাখায় গিয়ে নিবন্ধন করা যাবে এবং চাঁদা পরিশোধ করা যাবে। শুরুতেই শুধু সোনালী ব্যাংক দিয়ে যাত্রা শুরু হলেও পরে অন্যান্য ব্যাংকগুলোকেও এই কার্যক্রমে যুক্ত করা হবে। নিবন্ধন সম্পন্ন করার পর টাকা জমা করা যাবে মোবাইল ব্যাংকিং, অনলাইনে এমনকি ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডের মাধ্যমেও। কেউ চাইলে কিস্তি জমা করতে পারবেন প্রতি মাসে, চাইলে প্রতি তিন মাসে একবার। আবার চাইলে, বছরেও একবার কিস্তি পরিশোধ করতে পারবেন।
মূলত ২০১৫ সালে প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল-মাল আবদুল মুহিত সর্বজনীন পেনশন প্রকল্পের ব্যাপারে প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ২০১৬ সালে ভারত ঘুরে এসে পেনশন স্কিম সংক্রান্ত ধারণা চিত্র তৈরি করেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি দল। তবে প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল-মাল আবদুল মুহিত কাজটি সম্পন্ন করতে পারেননি।
২০২৩ সালের ৩১শে জানুয়ারি সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা আইন প্রণয়ন করে সরকার। সেই আইনের আওতায় চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির ১২ তারিখে গঠন করা হয় জাতীয় পেনশন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। অতঃপর চলতি বছরের ১৭ আগস্টে প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনা এই পেনশন স্কিম প্রকল্পের উদ্বোধন করেন।
সর্বোপরি– শেষ জীবনে খাওয়া-পরার অনিশ্চয়তা দূর করতে যুগান্তকারী এক উদ্যোগ হচ্ছে পেনশন স্কিম প্রকল্প এবং এই সর্বজনীন পেনশন স্কিম ব্যবস্থাপনা নিঃসন্দেহে একটি প্রশংসনীয় ও সময়োপযোগী উদ্যোগ।
লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম কলেজ
সারাবাংলা/এসবিডিই
এস এম রাহমান জিকু মুক্তমত যুগান্তকারী উদ্যোগ: সর্বজনীন পেনশন স্কিম সর্বজনীন পেনশন স্কিম: যুগান্তকারী উদ্যোগ