Tuesday 26 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

চাঁদ কী পৃথিবীর পরবর্তী মহাদেশ?

আন্না পুনম
২১ আগস্ট ২০২৩ ১৬:৩৪

এই মুহূর্তে চাঁদের কক্ষপথে আছে দুটি স্পেস শিপ। একটির নাম চন্দ্রযান তিন এবং অন্যটি লুনা পঁচিশ। ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা বা ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন সংক্ষেপে ইসরো, চলতি বছর ১৪ জুলাই চন্দ্রযান তিন নামে স্পেসক্রাফটি সতীশ দেওয়ান স্পেস সেন্টার অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে চাঁদের উদ্দেশ্যে পাঠিয়েছে। অন্যদিকে রাশিয়ান মহাকাশ গবেষণা সংস্থা রসকসমস লুনা পঁচিশ নামের স্পেসক্রাফটিকে ১১ আগস্ট চাঁদের দক্ষিণ মেরুর অন্ধকার অংশে অবতরণের জন্য পাঠিয়েছে। তবে কি চন্দ্র জয়ের জন্য ভারত আর রাশিয়া প্রতিযোগিতায় নেমেছে?

বিজ্ঞাপন

এ ধরনের প্রতিযোগিতা আমরা যারা বিজ্ঞানকে ভালবাসি তারা সবাই আগ্রহের সাথে উপভোগ করছি। লুনা পঁচিশ উৎক্ষেপণের পর ভারত রাশিয়াকে অভিনন্দন জানিয়েছে। রাশিয়াও বলেছে দুটি মিশনের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ আলাদা। আর চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অনেক জায়গা রয়েছে তাই চন্দ্রযান তিন ও লুনা পঁচিশ এর সংঘর্ষ হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। চাঁদের দক্ষিণ মেরুর অন্ধকারাচ্ছন্ন পৃষ্ঠে ইতোপূর্বে কোন দেশ ল্যান্ডার পাঠায়নি। রাশিয়ার মহাকাশযান লুনা ৩, ১৯৫৯ সালের অক্টোবরে প্রথম চাঁদের অন্ধকার অংশের ছবি তুলেছিল। ১৯৭৬ সালে প্রথম চাঁদে ল্যান্ডার পাঠায় রাশিয়া। সেই অভিযান সফল হয়েছিল তবে সেটা ছিল চাঁদের আলোকিত অংশে। পৃথিবী থেকে আমরা সব সময় চাঁদের আলোকিত অংশটি দেখি। চাঁদের ঘূর্ণন সময়জনিত কারণে আমরা চাঁদের একটা পৃষ্ঠই সব সময় দেখতে পাই। চাঁদের একদিন আমাদের ২৮ দিন আর চাঁদের ১২ ঘন্টা আমাদের ১৪ দিন। চাঁদের অন্ধকার অংশে ল্যান্ডিং খুব একটা সহজ নয়,ওখানে সূর্যের আলো পৌঁছায় না। পাহাড়-পর্বত,বড় বড় গর্ত, অমসৃণ পৃষ্ঠ আর তাপমাত্রা অত্যন্ত কম মাইনাস ২৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড ; এজন্য চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে এর আগে কোন দেশ চন্দ্র অভিযানে যায়নি। ভারত প্রথম দেশ যে কিনা চাঁদের দক্ষিণ মেরু জয়ের প্রচেষ্টা চালিয়েছে চার বছর আগে। ভারত চন্দ্রযান-২ কে পাঠিয়েছিল চাঁদের দক্ষিণ অংশে কিন্তু চন্দ্রযান-২ সফলভাবে ল্যান্ড করতে পারেনি, ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল চাঁদের খুব কাছাকাছি গিয়ে। এবার ইসরো আশা করছে যে চন্দ্রযান তিন সফলভাবে সফট ল্যান্ডিং করবে। ইতোমধ্যে ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসে চন্দ্রযান তিন চন্দ্রপৃষ্ঠের ছবি তুলে পাঠিয়েছে। এখন চন্দ্রযান তিন চাঁদের পৃষ্ঠের খুব কাছাকাছি আছে। ১৯ আগস্ট ১৫৭ কিলোমিটার এপোজি দূরত্বে চন্দ্রযান ৩ এর অংশ ল্যান্ডার বিক্রম চাঁদকে প্রদক্ষিণ করছে। ধীরে ধীরে তার গতি কমে আসছে এবং আশা করা হচ্ছে যে ২৪ আগস্ট নিরাপদে সে চাঁদের দক্ষিণ মেরুর অন্ধকারাচ্ছন্ন বিপদ সংকুল পৃষ্ঠে সফলভাবে অবতরণ করবে। ভারতের চন্দ্রযান তিন আগে রওনা দিলেও রাশিয়ার লুনা পঁচিশ চন্দ্রপৃষ্ঠে দক্ষিণ মেরুতে আগে অবতরণ করবে। ২২ শে আগস্ট অথবা ২৩ তারিখ লুনা পঁচিশ চাঁদে পৌঁছবে। ইসরোর প্রযুক্তি আর রাশিয়ার প্রযুক্তির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে সেজন্য চন্দ্রাযান তিন এর চাঁদ মিশন সম্পূর্ণ করতে ৪০ দিন সময় লাগছে। যেখানে রাশিয়ার লাগছে মাত্র সাত দিন।

বিজ্ঞাপন

রসকসমস নামের যে রকেটে করে লুনা পঁচিশ কে চাঁদের কক্ষে পৌঁছে দিয়েছে সেটা বেশ শক্তিশালী রকেট। এ ধরনের উন্নত প্রযুক্তির রকেট পৃথিবীর হাতে গোনা কয়েকটি দেশে থাকতে পারে তবে এই মুহূর্তে রাশিয়ার কাছেই একমাত্র আছে। প্রচুর জ্বালানি পুড়িয়ে রকেটটি লুনা পঁচিশ কে নিয়ে পৃথিবীর গ্র্যাভিটি অতিক্রম করে অল্পদিনে চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছে দিয়ে এসেছে। এই রকেটের এস কে ভেলোসিটি অত্যন্ত বেশি আর এস কে ভেলোসিটি যত বেশি হবে পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ শক্তি এড়িয়ে রকেট তত তাড়াতাড়ি মহাকাশ পাড়ি দিতে পারবে। প্রচুর জ্বালানি খরচ করে অনেক অর্থের বিনিময়ে রকেটটি দুর্দান্ত গতিতে মহাকাশ পাড়ি দিয়ে লুনা পঁচিশ কে চাঁদের কাছাকাছি কক্ষপথে পৌঁছে দিয়ে এসেছে।

ভারতের চন্দ্রযান তিন প্রযুক্তিতে ইসরো তিনটি স্পেসক্রাফট অংশ ব্যবহার করেছে। প্রথম অংশ প্রপালসন মডিউল, মধ্যখানে ল্যান্ডার মডিউল ও তৃতীয়টি রোভার মডিউল। চন্দ্রযান তিন প্রথমে পৃথিবীকে পাঁচ বার প্রদক্ষিণ করেছে। তারপর চাঁদের কক্ষপথে ঢুকে চাঁদকে পাঁচবার প্রদক্ষিণ করেছে এবং শেষ স্টেজে প্রপেলার মডিউল থেকে ল্যান্ডার মডিউল পৃথক হয়ে ল্যান্ডারটি তার গতি কমিয়ে চাঁদের পৃষ্ঠে সফট ল্যান্ডিং করবে। ল্যান্ডার বিক্রম এখন চাঁদের খুব কাছাকাছি রয়েছে চাঁদকে প্রদক্ষিণ করছে। ল্যান্ডার বিক্রমের ভেতরে একটি রোবার মডিউল রয়েছে। ল্যান্ডার বিক্রম সফলভাবে চাঁদের পৃষ্ঠা অবতরণ করার পর তার পেট থেকে রোভারটি বের হয়ে যাবে আর চাঁদের অন্ধকার পৃষ্ঠে অনুসন্ধান চালাবে। চন্দ্রযান তিনে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স টেকনোলজি জুড়ে দেওয়া হয়েছে, নিজের বুদ্ধিতেই চাঁদের মাটিতে চলতে পারবে বিক্রম ল্যান্ডার। ইতোমধ্যে চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছে চন্দ্রযান তিন ইসরোকে খবর পাঠিয়েছিল যে সে চাঁদের বলয়ের প্রবেশ করেছে।

ভারত আর রাশিয়া যে প্রতিযোগিতা শুরু করেছে চাঁদের দক্ষিণ মেরু জয়ের জন্য তাতে প্রশ্ন জাগে কেন এই প্রতিযোগিতা, কি আছে চাঁদের মাটিতে আর চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে ল্যান্ডার অবতরণ কেন এত কঠিন?

চাঁদে কোনো বাতাস নেই। যে কোন ল্যান্ডার চাঁদে অবতরণের সময় চাঁদের গ্র্যাভিটি প্রচন্ড গতিতে ল্যান্ডারকে টানে। এদিকে ল্যান্ডারেরও প্রচন্ড একটি গতি থাকে; দুটোর মধ্যে ভারসাম্য না থাকলে ল্যান্ডার ক্রাশ করে যেতে পারে। ল্যান্ডারের তলদেশে থ্রাস্টার লাগানো থাকে যাতে চাঁদের গ্র্যাভিটি আর ল্যান্ডারের নিজের গতির মধ্যে একটা ভারসাম্য রক্ষা করা যায়। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সূর্যের আলো পৌঁছেনা সেজন্য এ অংশের তাপমাত্রা মাইনাস ২৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস। প্রচন্ড ঠান্ডা আর ল্যান্ডার বিক্রমের উত্তপ্ত তাপমাত্রা বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে। তাই ল্যান্ডার বিক্রমের থ্রস্টার তাপমাত্রার ভারসাম্য রক্ষা করতে সাহায্য করবে।

চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে পাহাড় পর্বত আর বড় বড় গর্ত থাকায় ল্যান্ডিং পয়েন্ট পাওয়া কঠিন তবে ল্যান্ডার বিক্রম ল্যান্ডিংয়ের জন্য একটি ভালো জায়গা বেছে নিয়েছে। আশা করা যাচ্ছে যে চন্দ্রযান ২ এর পুনরাবৃত্তি ঘটবে না এবার। ল্যান্ডার বিক্রম ল্যান্ডিং এর সময় ঘর্ষণে প্রচুর ধুলাবালিতে সেন্সর নষ্ট হয়ে যেতে পারে, তাছাড়া আলো নেই বলে ঐ অংশে সোলার সিস্টেম তেমন একটা কাজ করে না। ফলে পৃথিবীর সাথে সব যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকে । এজন্য চন্দ্রযান তিনে ল্যান্ডারের ভিতরে রোভার রাখা হয়েছে এবার। রোভার চাঁদের বুকে অনুসন্ধান চালিয়ে তথ্য পাঠাবে।

এত টাকা খরচ করে ভারত চাঁদের দক্ষিণ মেরু জয় করতে যাচ্ছে, কি লাভ হবে ভারতের? এ প্রশ্নের জবাবে বলা যায় চাঁদ ও পৃথিবী সৃষ্টি রহস্য উদঘাটন করা যাবে যদি রোভার মডিউল ঠিকঠাক মতো অনুসন্ধান চালিয়ে তথ্য পাঠাতে পারে ইসরোর কাছে। দক্ষিণ মেরুর অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গায় বরফ থাকার সম্ভাবনা প্রবল। পানির সন্ধান পেলে ভবিষ্যতে চাঁদ হবে পৃথিবীর উপনিবেশ। ভারত যদি সফট ল্যান্ডিং সফলভাবে করতে পারে চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে সফট ল্যান্ডিংয়ে চতুর্থ দেশ হিসেবে নিজের শক্তি প্রমাণ করতে পারবে। তবে অন্ধকার অংশে সফলভাবে সফট ল্যান্ডিং, কে হবে প্রথম দেশ ভারত নাকি রাশিয়া?

সারা বিশ্বের বিজ্ঞানপ্রেমি মানুষজন চেয়ে আছে চন্দ্রযান তিন আর লুনা পঁচিশ এর দিকে। রসকসমস বলেছে ২৪ তারিখের আগেই লুনা ২৫ চাঁদের অন্ধকার অংশ জয় করে নেবে। ইসরো রয়েছে ইতিহাস গড়ার অপেক্ষায়। আমরা ভারত রাশিয়া উভয়ের সাফল্য কামনা করছি। তবে কি চাঁদ পৃথিবীর নতুন কন্টিনেন্ট বা মহাদেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে? ২০২৪ সালে নাসা চন্দ্র অভিযানের ব্যাপক প্রস্তুতি নিচ্ছে। চীন জাপান কেউই চন্দ্র অভিযানে পিছিয়ে নেই। জাপান প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে চাঁদ মিশনে। জয় হোক বিজ্ঞানের। পৃথিবীর গণ্ডি ছাড়িয়ে মানব বসতি গড়ে উঠুক চন্দ্রপৃষ্ঠে বা মঙ্গল গ্রহে। শুভকামনা চন্দ্রযান তিন ও লুনা পঁচিশের জন্য।

লেখক: ছড়াকার ও কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

আন্না পুনম চাঁদ কী পৃথিবীর পরবর্তী মহাদেশ? মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর