সংঘাতের চেয়ে সংলাপ উত্তম
২২ আগস্ট ২০২৩ ১৮:২২
সংলাপ একটি শব্দ। আকারে ছোট হলেও এই শব্দের প্রতি মানুষের প্রত্যাশা অনেক। কারণ সংলাপ মানেই গণতন্ত্র, শান্তি, মত প্রকাশের অধিকার ও সমঝোতা। আর সমঝোতায় পৌঁছানোর প্রধান মাধ্যম সংলাপ। আমরা দেখেছি, একটি কয়েক মিনিটের সংলাপও কিন্তু একটি ভয়াবহ যুদ্ধ থামিয়ে দিতে পারে। তাই গণতন্ত্র রক্ষায় সংলাপের ভূমিকা অপরিসীম। তাছাড়া যেকোনো বিষয় বা ইস্যু যত কঠিন মনে হোক না কেন, অবশেষে সংলাপের মাধ্যমেই সিদ্ধান্তে আসার চেষ্টা করা হয়। আর জনমতকে দেয়া হয় সর্বোচ্চ গুরুত্ব। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, স্পেনের কাতালোনিয়া এবং স্কটল্যান্ডের স্বাধীনতা কিংবা ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বেরিয়ে যাওয়া সব কিছুই প্রাথমিকভাবে সংলাপ এবং চূড়ান্তভাবে জনগণের সংলাপ বা গণভোটের মাধ্যমেই নির্ধারিত হয়েছে। শক্তি প্রয়োগ সর্বশেষ এবং অনাকাঙ্ক্ষিত পন্থা। শক্তি প্রয়োগের অপর নাম যুদ্ধ। তবে যুদ্ধের শেষ সীমানায় আছে সংলাপ। প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অবসানের ক্ষেত্রেও সংলাপ ছিল অবধারিত।
২০১৪ ও ১৮ সালের নির্বাচনে ভোট ডাকাতির কথা কেবল বিরোধী দলই নয়, সরকার দলীয় অসংখ্য নেতৃবৃন্দ ও সরকারের পরম বন্ধু জাতীয় পার্টির মহাসচিবও এ কথা বার বার বলেছেন। তবে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে শুধু শেখ হাসিনা সরকারই ব্যর্থ এমনটা নয়, ১৯৭৩ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সাধারণ মানুষ নির্বাচনের নানা মডেল দেখতে দেখতে ক্লান্ত। বিনা ভোটে ১৫৪ জন এমপি হয়ে যাওয়ার মডেল মানুষ দেখেছে। আগের রাতে ভোট হয়ে যাওয়ার মডেলও দেখেছে। তাছাড়া এরও আগে হাঁ-না ভোটের মডেল তো আছেই! এক কথায়, বিগত ১১টি জাতীয় নির্বাচনের প্রতিটি নিয়ে কমবেশি বিতর্ক আছে। কিন্তু ৪টি নির্বাচন আপাত সুষ্ঠু হয়েছে বলে মনে করা হয়। যেগুলো হলো- ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচন। একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, এসব নির্বাচন কোনো দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়নি। দলীয় সরকারের অধীনে যতগুলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রতিটি নির্বাচনই বিতর্কিত। যারাই ক্ষমতায় এসেছে তারাই ভোট চুরির মহোৎসবে মেতে উঠেছে। তবে এর মধ্যে ২০১৮ সালের নির্বাচনকেই সবচাইতে বেশি বিতর্কিত হিসেবে ধারণা করা হয়।
কাজেই নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ধারাবাহিক আন্দোলন করে আসছে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো। সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিং, আন্দোলন-সংগ্রাম, বিভাগীয় সমাবেশ, পদযাত্রাসহ নানা কর্মসূচি পালন করছে দলগুলো। অন্যদিকে নির্বাচনকে সামনে রেখে কূটনৈতিক তৎপরতা বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়াসহ বহির্বিশ্বের অনেক দেশ। ইতোমধ্যে সরকারপ্রধান, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বৈঠকও শেষ করেছেন তারা। তাদের দাবি, বিএনপিসহ সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেখতে চান তারা। কিন্তু এক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে৷ এতদিন সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বললেও এবার জাতিসংঘের অধীনে ভোটের কথা তুলেছেন ১৪ মার্কিন কংগ্রেসম্যান। এমনকি নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট। এই নীতি অনুযায়ী, ভোটের অনিয়মের সঙ্গে জড়িত কোনো বাংলাদেশিকে ভিসা দেবে না দেশটি।
সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে তাদের এ ভিসা নীতিকে স্বাগত জানিয়েছিল আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ দেশের আঠারো কোটি জনগণ। এতে অন্য দশজনের জনের মতো আমিও খুশি হয়েছিলাম। কারণ আমরা মনে করেছিলাম, এ ভিসা নীতির ফলে বিরোধীদের আন্দোলনের নামে সহিংসতা ও পুলিশের দায়িত্বের নামে গণগ্রেফতার বন্ধ হবে। কিন্তু সাময়িক তার সুফল পাওয়া গেলেও স্থায়ী সমাধান মিলেনি। সময়ের সাথে সাথে সেই চিরচেনা সহিংস রূপেই ফিরে রাজনৈতিক দলগুলো।
একদিকে কূটনৈতিক তৎপরতা, অন্যদিকে প্রধান দুই দলের মুখোমুখি অবস্থানে
বাংলাদেশের রাজনীতি এখন উত্তপ্ত, ঘটনাবহুল ও টালমাটাল। রাজধানীতে একই দিনে প্রধান দুই, রাজনৈতিক দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি যখন পাল্টাপাল্টি এক দফা ঘোষণা করলেন; তখন বলে ছিলাম, ‘দেশ সংঘাতের দিকে যাচ্ছে। দুই দলের এক দফা বাস্তবায়ন কখনোই সম্ভব নয়। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির দাবি, বর্তমান সরকারের পদত্যাগ। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের এক দফা-বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। বিএনপি কর্মসূচি দিলে আওয়ামী লীগ শান্তি সমাবেশ ডাকে। বিএনপি সমাবেশ প্রত্যাহার করলে আওয়ামী লীগও প্রত্যাহার। একই দিনে আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশের নামে অশান্তি সমাবেশ সংঘাতকে উসকে দিচ্ছে।’
যেমনটা বলেছিলাম, পরের দিন তাই হলো। ১৮ জুলাই এক দফা দাবিতে বিএনপির প্রথম পদযাত্রা আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও পুলিশের সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। লক্ষ্মীপুরে পুলিশের গুলিতে এক যুবদল কর্মী নিহতসহ আহত হয়েছে দুই শতাধিক (১৯ জুলাই, নয়া দিগন্ত)। একই দিনে খাগড়াছড়ি, কিশোরগঞ্জ, বগুড়া ও ময়মনসিংহে সাংবাদিক সহ আহত হয়েছে আরও ৩০০ জন। এই যে পদযাত্রা দিয়ে সংঘাতের শুরু হলো তা এখনো চলছে। গত ২৯ জুলাই বিএনপির অবস্থান কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে ঢাকার প্রবেশপথগুলো পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। কোথাও বিএনপি-আওয়ামী লীগ, কোথাও বিএনপি-পুলিশ আবার কোনো এলাকায় আওয়ামী লীগ-পুলিশ ও বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। ধাওয়া-পালটাধাওয়া, ইটপাটকেল, বাসে আগুন ভাঙচুর, টিয়ার শেল, রাবার বুলেট নিক্ষেপে এসব এলাকা যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। সর্বশেষ শনিবার হবিগঞ্জ জেলা বিএনপির পদযাত্রায় যে আপত্তিকর ঘটনা ঘটেছে এতে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, সংঘাত ও সহিংসতা তথা অবস্থার অবনতির বিষয়টিকেই উসকে দেয়।
রাজনীতিতে বিতর্ক থাকবে, মতপার্থক্য থাকবে। এটাই নাকি গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। এই সৌন্দর্য এখন নির্বাসিত তাই রাজনীতিতে আশঙ্কার মেঘ ঘনীভূত হচ্ছে। এমন কোন দিন নেই ঢাকায় মারামারি-সংঘর্ষ ও রাজনৈতিক খুনের খবর পাওয়া যায় না। প্রতিদিনই মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। রাজনৈতিক নেতার পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন সাধারণ পথচারীও। থেকে নেই সংঘর্ষ, থেমে নেই অগ্নিকাণ্ড, থেমে নেই গ্রেফতার। বিএনপির সহিংসতায় প্রচার পায় আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের নাশকতায় প্রচার পায় বিএনপি। সংঘর্ষে জড়ায় দু’দল আর মামলা খায় মৃত ব্যক্তি। এ যেন সংঘাতময় রক্তের শহর! সকাল বেলা কর্মস্থলে বের হলে সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার নিশ্চয়তা নেই।
এক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে, বাইরের চাপের কারণে নয়, সংকট নিরসনে স্ব-উদ্যোগেই সংলাপের আয়োজন করতে হবে।আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বড় দল দুটি যে অবস্থান নিয়েছে, তা পরিস্থিতিকে আরও সংঘাতময় করবে। অতীতে বিভিন্ন কারণে এবং ক্ষমতার পালাবদলের প্রেক্ষাপটে দেশে সহিংস রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। মাসের পর মাস হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি পালনকালে সহিংসতায় বহু প্রাণহানি হয়েছে।
সেসময় দেশজুড়ে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে যে ব্যাপক ব্যক্তিগত ও রাষ্ট্রীয় সম্পদহানি হয়েছিল, তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল অর্থনীতিতে। মনে রাখতে হবে, দেশের অর্থনীতি বর্তমানে নানা সংকটে রয়েছে। রাজনৈতিক সহিংসতা এ সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। রাজনৈতিক সংকট দূর করার জন্য প্রয়োজন একটি জরুরি সংলাপের।
আমি পূর্বেই আলোচনা করেছি, সমঝোতায় পৌঁছানোর প্রধান মাধ্যম সংলাপ। সংলাপের মাধ্যমেই সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে হবে। মতপার্থক্য, বিরোধ, সংঘর্ষ ও যুদ্ধ- তারপর কী? সহজ উত্তর সংলাপ। অন্যদিকে শক্তি প্রয়োগের অপর নাম যুদ্ধ। যুদ্ধে দুটি পক্ষের ক্ষতি ছাড়া লাভ নেই। যুদ্ধ সবকিছুই ছারখার করে দেয়। শেষ পর্যন্ত ফলাফল শূন্য। তাই প্রতিটি দেশের শান্তি রক্ষায় যুদ্ধের চেয়ে সংলাপ উত্তম।
কাজেই দেশ ও জনগণের স্বার্থে সরকার ও বিরোধী দুপক্ষই একদফার অবস্থান থেকে বেরিয়ে সংলাপের টেবিলে বসবে-এটাই প্রত্যাশা। মনে রাখতে হবে, স্বার্থপরতার রাজনীতি স্বৈরাচার করে আর জনগণের রাজনীতি জনবান্ধ করে।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই