বাংলাদেশের মানুষ কবে নাগাদ লোভ নিয়ন্ত্রণ করে বিনিয়োগ করবে?
২৪ আগস্ট ২০২৩ ১৪:৫৪
বাংলাদেশে অনলাইন আর্থিক প্রতারণায় এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে এমটিএফই নামের একটি আলোচিত প্রতিষ্ঠান। যা ভয়ংকর এক ইতিহাস রচনা করেছে। প্রযুক্তির যুগে এসে মানুষ কিভাবে এই ধরণের একটা প্রতিষ্ঠানের উপর আস্থা রাখে?
হাওয়া.. কতো টাকা, কতো কোটি টাকা! এটার সুনির্দিষ্ট পরিমাণটা বলা মুশকিল। সম্প্রতি এক ভিকটিমের গল্পে উঠে আসে, ভুক্তভোগী গরু বিক্রি করে ৬০ হাজার টাকা এখানে বিনিয়োগ করছে। অতঃপর টাকাটা হাওয়া।
যে ভদ্রলোক, উনি খুব সম্ভবত মালিক নন। আবার কেউ কেউ বলছে উনি বাংলাদেশে পরিচালিত এমটিএফই শাখার মালিক। আসলে উনি মালিক না। উনি তো নিজেই বলছেন– তিনি নিজেই যখন শুরু করে দুবাইতে, ৩০ হাজার টাকা পকেটে নিয়ে শুরু করেছিলেন।
এখনো কেউ কেউ আশাবাদী যে, এমটিএফই ফিরে আসবে। কিন্তু অভিজ্ঞতা বলে, ইতিহাস বলে সচারাচর এই ধরণের ফিরে আসার নজির বাংলাদেশে না; পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটেনি। বাংলাদেশে ডেসটিনির মতো ঘটনার পর, ইভ্যালির মতো ঘটনার পর– আপনারা এই ধরণের একটা ভাসমান প্রতিষ্ঠানে যাদেরকে টাকা বিনিয়োগ করেছেন, অথচ বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে তার কোনো হিসাব নেই। আপনি কার কাছে, কোথায় টাকা বিনিয়োগ করতেছেন নিজেই জানেন না।
আপনি যার কাছে– আপনার সমস্ত উপার্জন দিয়ে আসলেন, আপনি তার চেহারা দেখেননি এবং তাকে চিনেনও না। আপনি জানেন না যে, আপনার এই টাকাটা সে কোথায় গিয়ে বিনিয়োগ করবে? আপনাদের এই বিষয়টা দেখলাম এবং খুবই আশ্চর্য হলাম যে– ১ লক্ষ ১০ হাজার টাকা যদি আপনি বিনিয়োগ করেন, তবে আপনাকে ৪৫ হাজার টাকা মাসে ফেরত দেওয়া হবে। এদিকে আপনি জানেনও না যে, কোথা থেকে দেওয়া হবে এতো টাকা। এই ভদ্রলোকের কি ফ্যাক্টরি আছে নাকি টাকা বানানোর মেশিন আছে? সে কি উৎপাদন করে? উৎপাদনই যদি না করে, তাহলে সেটা কিসের বিজনেস? আপনি না জেনে, না বুঝে এনজিও থেকে লোন নিয়ে লোনের টাকাটা এই প্রতারক প্রতিষ্ঠান এমটিএফই-এর মধ্যে বিনিয়োগ করে দিলেন। আহ্! চড়া হারে সুদের টাকাটা, ৪০% থেকে ৫০% সুদ নেয় এনজিও প্রতিষ্ঠান। এই ধরণের ভুক্তভোগী মানুষের সংখ্যা এ-তো বেশি যে, তা খুবই দুঃখজনক। এছাড়াও ভুক্তভোগী শ্রেণি সামনাসামনি ভাবে হেয়-প্রতিপন্নের শিকার হচ্ছেন।
দেখেন কি আশ্চর্য ব্যাপার। প্রথমত কাজটা করছেন, একটা বাইরের কোম্পানি। ধরলাম বাইরের কোম্পানি তারা। নামসর্বস্ব ও অনলাইন ভিত্তিক বা অ্যাপ ভিত্তিক কোম্পানি। অথচ আপনি অ্যাপের কিছুই জানেন না। ক্রিপ্টো এন্ড কারেন্সি কিভাবে হচ্ছে আপনি জানেনই না। ক্রিপ্টো এন্ড কারেন্সির ব্যাপারটা অনেকেই ভালো মতো বুঝেন না। এখনো পর্যন্ত হাওয়ায় কিভাবে এই টাকাগুলো? কিভাবে বিট কয়েন, বিট কয়েন ছাড়া বাকি কয়েনগুলো এখন পর্যন্ত ধরেন এই যে, ক্রিপ্টোকারেন্সি এক ধরনের ট্রেন্ডিং-এর মাধ্যমে আপনাদেরকে টাকা এখানে দিয়ে দিবে এমনটাই বলা হচ্ছিল। সেই টাকাটা সম্পর্কে আসলে আইডিয়া নেই। কিন্তু আমি সেখানে বিনিয়োগ করবো না, যেখানে টাকাটা ফিরে পাওয়ার ধারণা আমার জানা নেই। আমি সেখানেই বিনিয়োগ করবো, আমি যেখানে জানবো যে– এখানে বিনিয়োগ করলে সে এখান মুনাফা অর্জন করবে এবং আমি এখানে যথাযথ মুনাফা পাবো।
আপনি যখন কাউকে টাকা ধার দিচ্ছেন– আপনি সেই মানুষকে টাকা ধার দিবেন না, যে মানুষ আপনার টাকা ফেরত দেওয়ার সামর্থ্য রাখে না। আপনি সেই মানুষকে টাকা ধার দিবেন না, যে মানুষকে আপনি চিনেন না। আপনি সেই মানুষের কাছে আপনার টাকাটা চোখ বন্ধ করে দিয়েন না, যে মানুষ যেকোনো সময় হাওয়া হয়ে যেতে পারেন। সে আপনাকে যত টাকা বেশি মুনাফা যুক্ত মানে যতবেশি মুনাফা আপনাকে ফেরত দিবে– তার কোনো পরিচয় নেই, কোনো ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড নেই। মানে তাকে খুঁজে পাওয়ার কোনো জায়গা নেই। তার কোনো পাসপোর্ট বা কোনো এনআইডি আপনার কাছে নেই, তার কোনো ছবিও নেই। আসলে এটা খুবই হাস্যকর এবং খুবই অবিশ্বাস্য।
কি পরিমাণ টাকা এখনো পর্যন্ত এই প্রতারক প্রতিষ্ঠান এমটিএফই বাংলাদেশ থেকে নিয়ে গেছে, সেটার পরিষ্কার তথ্য কোনো সময়ই সামনে আসবে না। শুধুমাত্র যে ৪০০ সিইও-ও যাদেরকে বানানো হয়েছিলো, তারাই তাদের ৩০ জনকে যদি কেউ একত্রিত করতে পারে অথবা এখানে অনবোর্ড করতে পারে এবং তাকে সিইও বানানো হয়, তার পরিমাণ পড়ে দেড় কোটি টাকার মতো। ৪০০ জনের খোঁজ পাওয়া গেছে এরকম। আরও ৪০০ জন ফাইট লাইনে, ৮০০ জন লোক ফাইট লাইনে। কি পরিমাণ লোক দেখেন?
আমি হিসাব করে দেখলাম– যদি সাড়ে ৩ হাজার ডলার বিনিয়োগ করি, তাহলে মাসে ৪ লক্ষ টাকা পাবো। এজন্য পাগলের মতো বিশ্বাস করবেন না যে, আপনি সাড়ে ৩ হাজার ডলার বিনিয়োগ করে মাসে ৪ লক্ষ টাকা পাবেন। মানে কি চিন্তা করে, কি লোভ করে আপনি এই টাকাটা এখানে বিনিয়োগ করলেন?
বিনিয়োগ যদি করতে হয়, আপনার এই ছোট্ট ছোট্ট সঞ্চয় আপনার চোখের সামনে ভূমিতে বিনিয়োগ করেন। আপনি যদি ভূমিতে বিনিয়োগ করেন, প্রচুর জায়গা বাংলাদেশে আছে এখনো। প্রত্যেকটা মানুষের বেসিক জায়গা হচ্ছে ভূমি। তবে আমি এটা দেখে খুবই আশ্চর্য হয়েছি এবং আমার কাছে মনে হয়েছে যে, এই রকম ভুল আমরা কিভাবে করি? যেটা আমাদের চোখের সামনে। আপনি বলবেন যে, হ্যাঁ এই কোম্পানি যারা শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত ক্রিকেট লীগেও স্পন্সর করছে এবং বিজ্ঞাপন দিয়েছে। যেখানে সাকিব আল হাসান ও লিটন দাশ খেলেছিলো। আমরা দিনের পর দিন দেখছি। জাতীয় দলের জার্সিতে তাদের এটা দিলেই তারা একটা জায়গায় পৌঁছায় যায় না। এটা দিলেই তারা মনে করে যে, কি পরিমাণ সম্পদ আছে আপনার?
আপনার যে পুঁজিটা মার্কেট থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছে তার বিপরীতে কি পরিমাণ সম্পদ আছে? আপনি যে টাকাটা দিছেন, দেখেন বাংলাদেশ থেকে কি পরিমাণ টাকা পাচার হয়ে গেলো। আপনার ব্যক্তিগত সর্বনাশ তো হয়েছে এবং আপনি দেশেরও সর্বনাশ করে ফেলেছেন। আপনার টাকা মানে দেশের টাকা। ওই টাকাটা কনভার্ট হয় ডলারে। ডলারে কনভার্ট করার পরেও নিয়ে গেলো। ধরেন ১০ হাজার কোটি টাকা। কি পরিমাণ ডলার সে বাংলাদেশ থেকে নিয়ে গেছে। আমরা এমনি বাঁচতেছি না যে অবস্থা, তার মধ্যে আপনি এই টাকাটা হারিয়েছেন। আপনি কিন্তু অন্যায়ও করছেন। অন্যায় করছেন কি জানেন? আপনার এই টাকাটা, টাকা পাচারের যে গল্প জানেন না আপনারা। কিভাবে টাকাটা পাচার হয়? এর মাধ্যমে টাকা পাচারও হয়েছে কিন্তু। কেস করলে এই কেসটা দিয়ে কি সমাধান আপনি প্রত্যাশা করবেন এবং সেখানে আপনি কি লিখবেন এটাও কিন্তু আরেকটা ধোঁয়াশা।
আর্থিক বিষয়গুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে সংশ্লিষ্টতা নাই। সেখানে আপনি বিনিয়োগ করছেন এবং সেটা দেশের বাইরে। সেটা আপনি কিভাবে পারেন? এটা তো এক রকমের অর্থ পাচারের আওতাভুক্ত। সুতরাং আপনি ক্লেইমও করতে পারবেন না। এই ধরণের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আপনাকে তো ঝুঁকি নিতেই হবে। তা ঠিক আছে। কিন্তু ঝুঁকিটা একটু বেশি হয়ে গেলো না। তাকে চিনলেন না, জানলেন না। অথচ আপনি টাকাটা দিয়ে আসলেন। কি অদ্ভুত লেনদেন, ১ লক্ষ টাকায় ৫০ হাজার টাকা করে মাসে ফেরত পাবেন।
আসলে কিছুই বলার নেই। আমার ধারণা এরপরও বাংলাদেশে প্রতিনিয়তই এমনটা ঘটবে। এরপরও অনলাইনে জুয়া হবে। জুয়ার পেজে বিভিন্ন সেলিব্রিটিদের ছবি ব্যবহার করে হাজার হাজার মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। আর আপনি ওটা দেখেই বিশ্বাস করে নিবেন যে, ওই রকম ঘটনায় তারাও উৎসাহ দিচ্ছেন। বা সেলিব্রিটিদের কেউ বললে সেটা আপনি বিশ্বাস করে নিবেন।
এই ধরণের মানুষ ঠকানো, পরিষ্কার ভাবে মানুষ ঠকানো। এধরণের স্কিপ, এধরণের এমটিএফই বিজনেস বোধহয় এখনও বাংলাদেশে হয় কিনা জানিনা। কিন্তু এই বিজনেসের উপর আমার কোনোদিনই আস্থা নেই। সে বিজনেস আপনাকে বসে বসে সুদ দিবে। ইসলামে সুদ কেন হারাম করা হয়েছে? আপনি বসে বসে, মনে মনে ব্যাংকে টাকা রেখেছেন। আপনার টাকাটা এখানে দিয়ে যাবে। হ্যাঁ, ব্যাংক এক ধরনের বিজনেস করে। আস্থা আছে। সে এটা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জমা রেখে তারপর আমানত হিসেবে আপনার টাকাটা সে ব্যবসা করছে এবং সে একটা সহনীয় পরিমাণ টাকা আপনাকে দিচ্ছে। যদিও এটা মারাত্মক রকমের ভুল। মারাত্মক রকমের ভুল মানে বিনিয়োগ হিসেবে ভুল।
সর্বোপরি– আপনার এই টাকাটা এভাবে দেওয়া একদমই উচিত হয়নি। যার ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে আপনাকে এবং দেশকে।
লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম কলেজ
সারাবাংলা/এসবিডিই
এস এম রাহমান জিকু বাংলাদেশের মানুষ কবে নাগাদ লোভ নিয়ন্ত্রণ করে বিনিয়োগ করবে? মুক্তমত