দেশের উন্নয়নে তৃতীয় লিঙ্গের অংশগ্রহণ জরুরি
২৪ আগস্ট ২০২৩ ১৬:৪৬
আমরা যখন স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে ধাবিত হচ্ছি ঠিক তখনো তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়া শব্দটি শোনার সাথে সাথে আমাদের মাথায় আসে খুবই অস্বস্তিকর ও বিব্রতকর কিছু দৃশ্য। রাস্তা-ঘাটে, বাসে-ট্রেনে, হাট-বাজারে অস্বস্তিকর ভঙ্গিতে হাততালি দেওয়া, হয়রানিমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে চাঁদা তোলার ঘটনা সচরাচর আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়। তাদের প্রতি বিরক্ত হয়ে দুটি কটুকথা বলতেও আমরা ছাড় দেইনা। কিন্তু আমরা কি তাদের অন্ধকারাচ্ছন্ন ও হতাশাগ্রস্ত জীবনের গল্প জানি? যে বয়সে একটি শিশু মায়ের হাতে ছাড়া ভাত খায় না, মায়ের মুখে রূপকথার রাক্ষসের গল্প না শুনে ঘুমায় না সেই বয়সে তাকে হতে হয় পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন, খুঁজতে হয় বেঁচে থাকার স্থান এবং রুটি-রুজির পথ। অথচ তারা যদি সাধারণ শিশুদের মতো সুযোগ সুবিধা পেতো তাহলে নিঃসন্দেহে তারাও আমাদের অর্থনীতি, রাজনীতি, চিকিৎসা, স্বাস্থ্য ও আইন অঙ্গন সহ সর্বত্র অভাবনীয় অবদান রাখতে পারতো।
আমরা সবাই জানি, বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ঝিনাইদহের ত্রিলোচনপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হয়েছেন তৃতীয় লিঙ্গের নজরুল ইসলাম ঋতু। বাংলাদেশের প্রথম ট্রান্সজেন্ডার সংবাদ পাঠিকা তাসনুভা আনান শিশির। ভারতের প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের চিকিৎসক হলেন ডাঃ ভি এস প্রিয়া। আসলে লিঙ্গ কখনো একজন ব্যক্তির যোগ্যতা ও সক্ষমতার মানদণ্ড হতে পারেনা। অনুকূল পরিবেশ এবং পর্যাপ্ত সুযোগ পেলে যেকোনো লিঙ্গের মানুষই নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে।
২০১৯ সালে ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যাসেম্বলি ইন্টার- ন্যাশনাল ক্লাসিফিকেশন অব ডিজিজেস (আইসিভি -১১) এর একাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে মানসিক ও আচরনগত ব্যাধিগুলোর অধ্যায় থেকে ট্রান্সজেন্ডার সম্পর্কিত বিভাগগুলো বাতিল করা হয়। এই সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে যে, ট্রান্সজেন্ডার বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা যেমন মানসিকভাবে সুস্থ তেমনি তাদের শারীরিক বৈশিষ্ট্যও প্রাকৃতিকভাবে স্বাভাবিক। ষষ্ঠ জনশুমারি ও গৃহগণনা, ২০২২ এর তথ্যানুসারে বর্তমানে বাংলাদেশে তৃতীয় লিঙ্গ তথা হিজড়া জনগোষ্ঠী রয়েছে ১২ হাজার ৬২৯ জন। যদিও আমাদের ছোট আয়তনের দেশে এই সংখ্যাটা নেহাতই কম নয় তবুও তৃতীয় লিঙ্গের কথা শুনলেই আমাদের মাঝে নাক সিঁটকানো ভাব দেখা যায়। তাদের প্রতি আমাদের এমন বিরূপ ধারনা এবং বৈষম্য রাষ্ট্রের অগ্রগতির অন্তরায় তাই তাদেরকে রাষ্ট্রীয় মূল ধারায় ফেরাতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রথমত, আমাদের মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তন আনতে হবে অর্থাৎ মননে ও মগজে ঢুকাতে হবে যে তারাও মানুষ তারাও সবার মতো সবকিছু করতে সক্ষম। আমাদের সংবিধানের ২৭ নং অনুচ্ছেদে আইনের দৃষ্টিতে সকলের সমতার কথা বলা হয়েছে। এছাড়াও, ২৮(১) নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী ও লিঙ্গভেদে নাগরিকদের মধ্যে কোন বৈষম্য করা যাবে না। সে দৃষ্টিকোণ থেকে, রাষ্ট্রকে অবশ্যই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে সাংবিধানিক অধিকার বুঝিয়ে দিতে হবে এবং এটা রাষ্ট্রের পবিত্র দায়িত্ব। দ্বিতীয়ত, তৃতীয় লিঙ্গের শিশুর পরিবারকে যথাযথ কাউন্সেলিং করতে হবে। যদি পরিবারের সদস্যদের মাথা থেকে তাদেরকে নিয়ে থাকা ভুল ধারনার ভূত সরানো যায় তাহলে তৃতীয় লিঙ্গের শিশুদের অনিশ্চিত ভবিষ্যত নিশ্চয়তায় রূপান্তরিত হবে।
তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজড়া যাই বলি না কেন, নিজ পরিবার থেকেই তাদের নিগ্রহের সূচনা হয়। তাই পরিবারকে বুঝাতে হবে তৃতীয় লিঙ্গের শিশু তাদের বোঝা নয় বরং বাকি দশটা ছেলেমেয়ের মতো সেও স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার উদ্যোগে সচেতনতামূলক কর্মশালা পরিচালনা করতে হবে।
তৃতীয়ত, তাদের জীবনমান পরিবর্তন করতে অব্যর্থ মাধ্যম হচ্ছে তাদেরকে শিক্ষার আওতায় আনতে হবে। তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জীবন এলোমেলো হওয়ার পিছনে মূল কারণ হচ্ছে তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। যদি তারা শিক্ষিত হয় তাহলে তাদের আচরণগত পরিবর্তন আসবে এবং তারা নিজ পরিচয়ে চাকরিজীবী বা উদ্যোক্তা হয়ে স্বাবলম্বী হতে পারবে। তাই তাদের যথাযথ শিক্ষার উদ্দেশ্যে সরকারি, বেসরকারি উদ্যোগে বিশেষায়িত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করতে হবে অথবা সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের পড়ার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে তাদের জন্য বিশেষ কোটার ব্যবস্থা করা যেতে পারে এতে তাদের জন্য উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার পথ মসৃণ হবে।
সর্বশেষ, চাকরির ক্ষেত্রেও তাদেরকে অন্যান্য প্রার্থীদের মতো মূল্যায়ণ করতে হবে। তবে চাকরির প্রতিযোগিতায় তাদেরকে অগ্রাধিকার দিলে সবচেয়ে ভালো হয় কারণ এটা তাদের মনের শক্তি বৃদ্ধি করবে। ফলে সহজেই রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বত্র তাদের সফলতম বিচরণ দেখা যাবে। অন্যদিকে, বয়স্ক তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের জন্য কারিগরি শিক্ষা এবং বিভিন্ন হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা খুবই কার্যকর উপায় হতে পারে। সর্বোপরি, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের অবহেলা করে দূরে ঠেলে না দিয়ে তাদেরকে ভালোবাসা, অনুপ্রেরণা ও সহায়তা করতে হবে। এতে হতাশাগ্রস্ত তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী নিজ জীবনে আশার প্রদীপ জ্বালাবে এবং দেশের উন্নয়নে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করতে সক্ষম হবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই
দেশের উন্নয়নে তৃতীয় লিঙ্গের অংশগ্রহণ জরুরি নুসরাত জাহান নিশু মুক্তমত