Tuesday 26 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সালাহ্ উদ্দীন লাপাত্তা, তার সহযোগীরা?

জগলুল পাশা রুশো
২৫ আগস্ট ২০২৩ ১৭:২৩

১৮ ডিসেম্বর ২০০৫ সালে ময়মনসিংহ নগরীর আকুয়া উত্তরপাড়ার অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক খোরশেদ উদ্দীন আকন্দের বাসায় অভিযান চালায় র‌্যাব। “নোঙর” নামের সেই বাসায় আসাদুজ্জামান পনির ও শহীদ নামে দু’জন ভাড়া থাকতো। তাদের সাথে শিশু কন্যাসহ এক নারীও থাকতো তাদের বোন পরিচয়ে। যদিও পরে জানা যায় এটি মিথ্যা তথ্য ছিল।

সেই অভিযানে বিপুল পরিমান বোমা ও গোলাবারুদ উদ্ধার হয়েছিল। ঐ দিন রাতে পার্শ্ববর্তী আকুয়া মোড়লপাড়া এলাকায় আরেকটি অভিযান চালায় র‌্যাব। নূরউদ্দিন মাস্টার এর বাড়ি “নূর মহল” এর সেই অভিযানেও বিপুল সংখ্যক বোমা, বিস্ফোরক সরঞ্জামাদি উদ্ধার হয়। পরে বাড়িটির নাম পাল্টে রাখা হয় “স্মৃতি নিবাস”। সেই অভিযানে মোস্ট ওয়ান্টেড আসামী সালাহ্ উদ্দীন বোমা ফাটিয়ে পালিয়ে গেলেও ১২ জনকে গ্রেফতার করেছিল র‌্যাব। এসবই সংবাদমাধ্যমে বহুল প্রচারিত তথ্য।

বিজ্ঞাপন

সংবাদমাধ্যমগুলোই জানায়, সালাহ্ উদ্দীন সেদিন পালিয়ে গেলেও পরের বছরই সে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী থেকে ধরা পড়ে। ২০০৫ সালে সারাদেশে সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত সে। জামায়াতের অঙ্গ সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের নেতা ছিলেন সালাহ উদ্দিন। তবে সেই ১২ জনের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এমনকি থানা এবং আদালতেও সেই মামলার কোন নথি রক্ষিত নেই। তবে তাদের সেই মামলাটি ২০০৯ সালে ঢাকায় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৪ এ ন্যস্ত হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন ময়মনসিংহের কোর্ট ইন্সপেক্টর ঝুটন চন্দ্র বর্মণ। মো. সালেহীন ওরফে সালাহ উদ্দীন ও কামরুজ্জামান মতিন ওরফে আব্দুল মতিন জাকির তারা সহোদর ভাই। বয়সের ব্যবধান ৭ বছর। মেধাবী ছাত্র হয়েও তারা ভয়ঙ্কর জঙ্গী নেতা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। পরিবারের সদস্যরা বুঝে উঠতে পারেনি লেখাপড়ার আড়ালে কখন তারা জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়।

বিজ্ঞাপন

সালাহ উদ্দীন ও মতিনের বাবা রফিকুল ইসলাম নারায়ণগঞ্জ শহরের জনতা ব্যাংকের কালীর বাজার শাখায় টাইপিষ্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৯৮ সালের বন্যার পর রফিকুল ইসলাম বন্দর এলাকার ৫৮ এইচ. এম. সেন রোডে বাড়ী করে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।

ময়মনসিংহ সদরে ৪টি মামলা ছাড়াও ভালুকায় ২টি, ত্রিশাল ও মুক্তাগাছায় ১টি করে জেলায় মোট ৮টি মামলা ছাড়াও সুনামগঞ্জে ৬টি, হবিগঞ্জে ৪টি, নেত্রকোণা সদরে ২টি এবং শেরপুর সদরে ১টি মামলা রয়েছে তার নামে। ভৌগলিকভাবে বিবেচনা করলে ৫টি জেলাই পাশাপাশি অবস্থিত এবং এক জেলা থেকে অন্য জেলায় গ্রামীণ সড়ক ধরে যোগাযোগ ব্যবস্থা তুলনামূলক সহজ।

ধারণা করা হচ্ছে, হবিগঞ্জ বাদে অন্য ৪টি জেলা ভারত সীমান্তবর্তী পাহাড়বেষ্টিত এলাকা এবং নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ হাওড়বেষ্টিত দুর্গম এলাকা হওয়ায় সালাহ উদ্দীন এই অঞ্চলটি জঙ্গি তৎপরতার জন্য বেছে নিয়ে থাকতে পারে।

সংবাদমাধ্যমের কাছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্রগুলো জানায়, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সারাদেশে সিরিজ বোমা হামলা মামলায় ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত সালাহ উদ্দীন আগে জেএমবির শুরা সদস্য ছিলেন। তার বিরুদ্ধে ৪০টি মামলা আছে, যার মধ্যে ১৩টি মামলায় সাজা হয়। তিনটি মামলায় তার মৃত্যুদন্ডের রায় দেন আদালত। রায়ের সময় কারাগারেই ছিলেন সালাহ উদ্দীন।

২০১০ সালের ১০ আগষ্ট বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় জেএমবি নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইয়ের স্ত্রী ফাহিমা, শূরা সদস্য সালাহ উদ্দীন ওরফে সালেহীন ও আসাদুজ্জামান পনিরকে ২০ বছর করে কারাদন্ড দিয়েছিল আদালত। রায়ে উল্লেখ করা হয়, এই তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় প্রত্যেককে ২০ বছর করে কারাদন্ড দেওয়া হলো। একই সঙ্গে, আদালত প্রত্যেককে ২৫ হাজার টাকা করে জরিমানা করেন।

মামলার বিবরণে জানা যায়, জেএমবির সামরিক শাখার প্রধান আতাউর রহমান সানির দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ২০০৫ সালের ১৮ ডিসেম্বর ময়মনসিংহ নগরীর আকুয়া এলাকায় খোরশেদ উদ্দিন এবং নূর উদ্দীনের বাড়িতে অভিযান চালায় র‌্যাব-৯। সেসময় আসাদুজ্জামান পনির গ্রেপ্তার হয়। ওই বাড়ি ‍দুটি থেকে বিপুল পরিমাণ বোমা তৈরির সরঞ্জাম ও বিস্ফোরক দ্রব্য উদ্ধার করে র‌্যাব। সেই ঘটনায় র‌্যাব-৯ এর সদস্য এনায়েত হোসেন বাদী হয়ে ময়মনসিংহ কোতোয়ালি থানায় মামলা করেছিলেন।

২০০৬ সালের ১৬ জুন জেএমবি নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই, আতাউর রহমান সানি, বাংলা ভাইয়ের স্ত্রী ফাহিমা, আসাদুজ্জামান পনির ও সালাহ উদ্দীন ওরফে সালেহিন, এই পাঁচজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। ২০০৭ সালের ৩০ মার্চ ঝালকাঠিতে দুই বিচারক (সোহেল আহম্মেদ ও জগন্নাথ পাঁড়) হত্যা মামলায় বাংলা ভাই ও সানির মৃত্যুদন্ড কার্যকর হওয়ায় মামলা থেকে তাদের নাম বাদ দেওয়া হয়। বাকি তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আদালতের বিচারক রেজাউল করিম তাদের সাজা দেন।

তারও আগে ২০০৪ সালে জামালপুরের সরিষাবাড়িতে হৃদয় রায়কে (গণি গোমেজ) খ্রীষ্ট ধর্ম প্রচারের অভিযোগে হত্যার অভিযোগ ছিল সালেহীনের বিরুদ্ধে। পরে সে মামলায় তাকে ফাঁসির রায় দিয়েছিল আদালত। ২০০৪ সালে জামালপুরে গণি গোমেজকে হত্যা করেন জেএমবির জঙ্গিরা। ওই মামলায় ২০০৬ সালে সালেহীন ও রাকিবকে গ্রেফতার দেখানো হয়। সেই মামলায় ওই বছরই ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ তাদের মৃত্যুদন্ড দেন। পরে ফাঁসির আদেশ বহাল রাখে হাইকোর্ট।

আরেকটি মামলায় ২০১৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সালাহ্ উদ্দীন ছাড়াও জেএমবির সামরিক কমান্ডার জাহিদুল ইসলাম ওরফে বোমারু মিজান এবং রাকিবুল হাসান ওরফে হাফেজ মাহমুদকে গাজিপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে ময়মনসিংহের আদালতে হাজির করা হয়েছিল। ২০০৬ সালে মুক্তাগাছা থানায় বোমা হামলা সংক্রান্ত একটি মামলায় শুনানীর জন্য এজাহারভুক্ত এই তিন আসামীকে আদালতে হাজির করা হয়েছিল।

একই দিনে ময়মনসিংহ থেকে গাজিপুরে ফেরার পথে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ত্রিশালের সাইনবোর্ড এলাকায় নজিরবিহীনভাবে পুলিশের প্রিজন ভ্যানে বোমা ফাটিয়ে হামলা চালায় ও গুলি বর্ষণ করে। এ ঘটনায় সারাদেশে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছিল।

এ সময় সালাহ্ উদ্দীনসহ তিন জঙ্গীকে ছিনিয়ে নিয়ে যায় হামলাকারীরা। এদের মধ্যে মিজান যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত এবং সালাহ্ উদ্দীন ও রাকিবুল মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত ছিলেন। সেদিনের ঘটনায় পুলিশ কনস্টেবল আতিকুল ইসলাম নিহত এবং হাবিবুর রহমান, সোহেল রানা এবং সবুজ-এই ৩ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছিলেন। সালাহ উদ্দীনকে ধরতে সারাদেশে রেড এলার্ট জারির পাশাপাশি পুলিশ সেদিন ১০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল। কারাগারগুলোতেও অতিরিক্ত নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছিল।

পরদিন টাঙ্গাইলে গ্রেপ্তার হবার পর পুলিশের সাথে বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয় রাকিবুল এবং জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় ব্যবহৃত কালো মাইক্রোবাসটির চালক চাঁপাইনবাবগঞ্জের জাকারিয়া ওরফে মিলন অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ গ্রেপ্তার হয়। সে অপর একটি মামলায় জামিনে ছিল। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে টঙ্গী থেকে তার স্ত্রী স্বপ্নাকেও আটক করেছিল পুলিশ।

আর শায়খ আব্দুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী বোমারু মিজান সে পরে ২০১৮ সালে ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে স্থানীয় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। জামালপুর সদরের শেখের ভিটা এলাকার বাসিন্দা মিজানের বিরুদ্ধে সর্বমোট ১৯টি মামলা রয়েছে।

অপরদিকে সালাহ্ উদ্দীনও ত্রিশাল থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। এসময় সে হাফিজুর রহমান শেখ ওরফে মাহিন ছদ্মনাম ব্যবহার করে বলে জানিয়েছিল ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনআইএ।

গত বছর সেপ্টেম্বরে বেঙ্গালুরুতে সে অল্পের জন্য কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দাদের হাত ফস্কে পালায় বলে জানিয়েছিল বাংলাদেশ ও ভারতের সংবাদমাধ্যমগুলো। তার পর থেকে আর সালাহ উদ্দিনের হদিস পাচ্ছেন না গোয়েন্দারা। ভারতের জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)-র একটি সূত্রের দাবি, সালাহ উদ্দীন এখন দক্ষিণ ভারতে। কিন্তু কোথায়, সেটা তারা নির্দিষ্টভাবে জানাতে পারছেন না।

জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে গঠিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষায়িত ইউনিটের কর্মকর্তারা বলছেন, অনেক আগে থেকেই জেএমবি ভারতেও তাদের কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল। তবে প্রিজন ভ্যান থেকে পালিয়ে যাওয়া বোমা মিজান ও সালাহ উদ্দীন সালেহীন ভারতে গিয়ে আত্মগোপনে থেকে সেখানে তাদের সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধি করে। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে পশ্চিমবঙ্গের খাগড়াগড় ও বিহারের বুদ্ধগয়াতে বিস্ফোরণে জঙ্গি আস্তানায় বিস্ফোরণের পর তাদের জেএমবির সাংগঠনিক তৎপরতার বিষয়টি আলোচনায় আসে। খাগড়াগড় বিস্ফোরণ মামলাতেও সালেহীন অভিযুক্ত ছিল।

জেএমবি’র ৬ সদস্য গত বছর সেপ্টেম্বরে কলকাতা পুলিশের এসটিএফের হাতে ধরা পড়ে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদে সালাউদ্দিনের বেঙ্গালুরুর একটি আস্তানার সন্ধান পাওয়া যায়। তবে গোয়েন্দারা সেখানে পৌঁছনোর ঠিক আগে সালাহ উদ্দীন পালিয়ে যায়। এনআইএ’র দাবি, সালাউদ্দিনের সঙ্গে রয়েছে খাগড়াগড় বিস্ফোরণ মামলার আর এক অভিযুক্ত, বীরভূমের নানুর এলাকার যুবক মুস্তাফিজুর রহমান ওরফে তুহিন এবং সে-ই সালাউদ্দিনের লুকিয়ে থাকার বন্দোবস্ত করে দিচ্ছে বলে খবর প্রচারিত হয় ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকায়।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ভারতে অবস্থান করে বোমা মিজান ও সালাহ উদ্দীন সালেহীন জেএমবিকে আন্তর্জাতিক সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করে। এর দুটি শাখা হিসেবে জেএমবিকে বাংলাদেশের শাখা হিসেবে এবং জেএমআইকে ভারতীয় শাখা হিসেবে রূপান্তরিত করে। জেএমআইয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বোমা মিজানকে। আর সালাহ উদ্দীন সালেহীন নিজে জামাআতুল মুজাহিদীনের মূল অংশের আমির হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

সূত্র জানায়, পুরোনো জেএমবি বা জামাআতুল মুজাহিদীন কিছুটা কোণঠাসা থাকলেও ভেতরে ভেতরে তারা সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। শুরু থেকেই জেএমবি বিভিন্ন বিদেশি এনজিওসহ ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের বাসায় ডাকাতি করে অর্থ সংগ্রহ করত। গত বছরও ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা এমন একটি ডাকাত দলকে শনাক্ত করে যাদের অন্যতম দলনেতা আনোয়ারুল ইসলাম হৃদয় পুরোনো জেএমবির সক্রিয় সদস্য। জেলে বসে শীর্ষ জঙ্গিদের নির্দেশনায় তারা ডাকাতি করে সংগঠনের জন্য তহবিল সংগ্রহ করছিল। জেএমবির সাংগঠনিক এসব তৎপরতার মূলহোতা পলাতক সালেহীন।

জেএমবির প্রতিষ্ঠাকালীন শূরা সদস্য ছিলেন সালেহীন। তাকে ধরিয়ে দিতে পাঁচ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে রেখেছে বাংলাদেশ পুলিশ। ভারতের জাতীয় তদন্ত সংস্থা এনআইএ এর ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ তালিকায়ও রয়েছে সে। বিহারের বুদ্ধ গয়া এবং পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানে বোমা বিস্ফোরণের মামলার আসামি বোমা মিজান গত ৬ আগস্ট বেঙ্গালুরুতে এনআইএ’র এক অভিযানে ধরা পড়েন। কিন্তু ভারতীয় গোয়েন্দারাও এখনো সালেহীনের সন্ধান পাননি।

এছাড়াও ২০১৬ সালের ২৭ ডিসেম্বর রাতে রাজধানীর দারুস সালাম থানা এলাকা থেকে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরকসহ জেএমবির পাঁচ সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট। সেসময়কার সিটিটিসি প্রধান মনিরুল ইসলাম জানান, ইংরেজি নববর্ষ ঘিরে নাশকতার উদ্দেশ্যে পুরনো জেএমবির এ দলটি একটি বাসায় বিস্ফোরক জড়ো করছিল। এছাড়া বোমা বানিয়ে ডাকাতি করে দলের জন্য অর্থ সংগ্রহের পরিকল্পনাও ছিল তাদের।

সেই অভিযানে মো. রিয়াজ ওরফে ইঞ্জিনিয়ার ওরফে রাকিব, মো. আবু বিন সাইম ওরফে বাপ্পি ওরফে অপু, কাজী আবদুল্লাহ আল ওসমান ওরফে আহসান, মো. সোহাগ ওরফে চেয়ারম্যান ও মো. মামুন ওরফে হিমেল গ্রেপ্তার হয়। এই পাঁচ জঙ্গি দলের নেতৃত্বে ছিল রিয়াজ। গ্রেপ্তারের আগে সে ভারত গিয়ে সালাহ উদ্দীন সালেহীনের সঙ্গে দেখা করে সেখান থেকে নির্দেশনা নিয়ে ঢাকায় এসেছিল বলে জানায় সিটিটিসি।

এরপর ২০২১ সালের এপ্রিলে জেএমবির বাংলাদেশ শাখার দায়িত্বপ্রাপ্ত আমির রেজাউল হক রেজা ওরফে তানভীর মাহমুদ শিহাবকে গ্রেপ্তার করে সিটিটিসি। সেসময় জিজ্ঞাসাবাদে শিহাব জানিয়েছিল, সালেহীনের নির্দেশে সে জেএমবিকে সংগঠিত করার চেষ্টা করছিল। তার মূল কাজ ছিল দাওয়াহ শাখার মাধ্যমে সদস্য সংগ্রহ ও অর্থ তহবিল গঠন করা। সাংগঠনিকভাবে নতুন করে হামলা না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল তারা।

তবে গত বছরে সিটিটিসি প্রধান ও পুলিশের ডিআইজি আসাদুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, সালেহীন, জিয়া, জনসহ যেসব মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গি পলাতক রয়েছে তাদের আইনের আওতায় আনতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চলছে। হলি আর্টিজান হামলার পর থেকে এ পর্যন্ত শতাধিক জঙ্গিবিরোধী অভিযান চালিয়েছে সিটিটিসি। এসব অভিযানে ৬১৪ জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

গ্রেপ্তার জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ১৯২টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ১০৭টিতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে আদালতে। চার্জশিটে ৪৪৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে সিটিটিসির কাছে ৮৫টি জঙ্গি মামলা তদন্তাধীন আছে। সিটিটিসি যেসব মামলায় চার্জশিট দিয়েছে সেগুলোর মধ্যে তিনটি মামলায় ১৮ জনের মৃত্যুদন্ড এবং একজনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়েছে। চার্জশিট দেওয়া অন্য মামলাগুলোর বিচারিক কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

একই সাথে এন্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ) প্রধান ও পুলিশের অতিরিক্ত আইজি কামরুল আহসান গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, ২০১৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত এটিইউ ১০২টি অভিযানে ১৭৩ জঙ্গিকে আইনের আওতায় এনেছে। ২০২২ সালের জুলাই পর্যন্ত ১৯ অভিযানে ২৭টি, ২০২১ সালের ৩৫টি অভিযানে ৫৬ জন, ২০২০ সালে ৪১টি অভিযানে ৬৩ জন এবং ২০১৯ সালে ১৩টি অভিযানে ২৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

অপরদিকে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানিয়েছিলেন, হলি আর্টিজান হামলার পর থেকে গত গত বছরের ৩১ মে পর্যন্ত এক হাজার ৬৭৮ জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। এদের মধ্যে ৮৬৪ জন জেএমবি ও ৪০৬ জন আনসার আল ইসলামের সদস্য। এ সময়ে র‌্যাব ৭৭৯ টি জঙ্গিবিরোধী অভিযান চালিয়েছে এবং ৫৪টি জঙ্গি আস্তানা গুঁড়িয়ে দিয়েছে।

র‌্যাবের কাছে এ পর্যন্ত ১৬ জন জঙ্গি আত্মসমর্পণ করেছে। জঙ্গিদের কাছ থেকে র‌্যাব ৬৫টি দেশি-বিদেশি অস্ত্র, ২৬২ রাউন্ড গোলাবারুদ, ১০২টি গ্রেনেড-বোমা, সাড়ে ১৬ কেজি বিস্ফোরক এবং বিপুল পরিমাণ অন্যান্য জঙ্গি সরঞ্জামাদি জব্দ করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, র‌্যাব প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের দুই হাজার ৮০৯ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে জেএমবির সদস্য এক হাজার ৪৩০ জন।

সর্বশেষ গত বছরের ২০ নভেম্বর ঢাকার আদালত এলাকায় ‘পুলিশের মুখে স্প্রে মেরে’ ছিনতাই করা হয় জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন এবং লেখক অভিজিৎ রায় হত্যায় মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি মইনুল হাসান শামীম ওরফে সামির ওরফে ইমরান এবং আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাকে। ধারণা করা হচ্ছে এ ঘটনার পেছনেও সালাহ্ উদ্দীনের যোগসূত্র রয়েছে। সে লাপাত্তা তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, তার সহযোগীরা এখন কোথায়?

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী

সারাবাংলা/এজেডএস

জগলুল পাশা রুশো সালাহ্ উদ্দীন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর