পুলিশের মৃত্যুতে ‘আলহামদুলিল্লাহ’: মনুষ্যত্বের সংকট না অন্যকিছু?
২৯ আগস্ট ২০২৩ ১৪:৪১
সম্প্রতি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলায় ট্রেনের ধাক্কায় তিন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। দুর্ঘটনায় গুরতর আহত হয়েছেন আরও দুই পুলিশ সদস্য। পুলিশের মৃত্যুর এই ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে “আলহামদুলিল্লাহ—আমিন” লেখার হিড়িক পড়েছে।
গণমাধ্যমের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর পেইজে এই ঘটনার সংবাদ প্রকাশিত হলে সেখানে হা-হা রিয়েক্ট এবং কমেন্টবক্সে “আলহামদুলিল্লাহ—আমিন” শব্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে। অনেকে সেই ঘটনার ফটোকার্ড বা লিঙ্ক শেয়ার দিয়ে ক্যাপশনে লিখছেন “আলহামদুলিল্লাহ” এবং “আমিন”। এমন দৃশ্য বলে দেয় আমরা কী করুণ সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, জাতি হিসেবে আমরা কী পরিমাণ অসভ্য, বর্বর—কেমন দুর্ভিক্ষের মধ্যে নিমজ্জিত আমাদের গোটা সমাজব্যবস্থা।
সবকিছুর ঊর্ধ্বে যে ‘মানুষ’ হতে হয় সে বোধ আমাদের মধ্যে তৈরি হয়নি। হলে আমরা কারও মৃত্যুসংবাদে এভাবে আনন্দ-উল্লাসে ফেটে পড়তাম না। হা-হা রিয়েকশন, আলহামদুলিল্লাহ আর আমিন লিখে সামাজিকদূষণ ছড়াতাম না। পুলিশের মৃত্যুতে যারা হা-হা রিয়েকশন, আলহামদুলিল্লাহ আর আমিন লিখেছেন তারা পুলিশকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করতে পারেননি। সেটা পারলে এভাবে আনন্দ-উল্লাসে ফেটে পড়তেন না, নির্দিষ্ট একটা ধর্মের ইতিবাচক শব্দগুলোর অপব্যবহার করতেন না।
তারা ঠিক কী কারণে পুলিশের মৃত্যুসংবাদে এমন প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সেটা ঠিক পরিস্কার না হলেও ধারণা করা যায়—পুলিশের কর্মকাণ্ড নিয়ে। কিন্তু সব পুলিশ অফিসার সেই অর্থে খারাপ নন। আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেক পুলিশ অফিসারকে চিনি-জানি, যারা পেশাগত জীবনে খুবই সৎ ও মানবিক। পেশাগত পরিচয় বাদ দিয়ে পুলিশও তো রক্তেমাংসে গড়া আমার আপনার মতো একজন মানুষ। আর কারও মৃত্যু হয়ে গেলে তার ‘মানুষ’ পরিচয় ছাড়া আর কিছু থাকে না।
পুলিশের মৃত্যুসংবাদে যারা হা-হা রিয়েক্ট, আলহামদুলিল্লাহ আর আমিন লিখেছেন তারা মানুষরূপী ‘অমানুষ’ হিসেবেই নিজেদের পরিচয় পরিস্কার করেছেন, পাশাপাশি কলুষিত করেছেন একটা নির্দিষ্ট ধর্মকে—ধর্মীয় সেসব শব্দের অপব্যবহার করে। তারা যে ধর্মের ধর্মীয় শব্দের অপব্যবহার করেছেন সে ধর্ম কখনও এমন নিষ্ঠুরতা, অমানবিকতাকে সমর্থন করে না। সে ধর্ম কারও মৃত্যুকে আনন্দ-উল্লাসে ফেটে পড়ার—আলহামদুলিল্লাহ, আমিন লিখার শিক্ষা দেয় না, করে না সমর্থন। পৃথিবীর কোনও ধর্মই কারও মৃত্যুসংবাদে আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠার সমর্থন দেয় না।
বহুমাত্রিক সংকটে জর্জরিত আমাদের সমাজব্যবস্থা। যে অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজব্যবস্থা গড়ার স্বপ্ন নিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল সে দেশ এখনও সাম্প্রদায়িকতা আর অমানবিকতার বিষবাষ্পে জর্জরিত। এখানে এখনও মানুষকে ধর্ম-বর্ণের পরিচয়ে বাঁচতে হয়, করা হয় মূল্যায়নও। এখনও মানুষ হিসেবে আমরা ‘মানুষ’ হয়ে ওঠতে পারিনি। আর যতদিন পর্যন্ত সেটা হয়ে ওঠা সম্ভব হবে না, ততদিন পর্যন্ত আমাদের সার্বিক সংকট নিরসন হবে না। ঘটবে না আমাদের ‘কাঙ্ক্ষিত মুক্তি’।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
ইমরান ইমন পুলিশের মৃত্যুতে ‘আলহামদুলিল্লাহ’: মনুষ্যত্বের সংকট না অন্যকিছু? মুক্তমত