আমাদের শহীদ তারুণ্য: আমাদের প্রজন্ম, আমাদের প্রেরণা
৩০ আগস্ট ২০২৩ ১৬:২৮
বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে স্মার্ট আর স্যাভেজ জেনারেশনের স্বাক্ষ্য বহন করে আছে একাত্তরে শহীদ হওয়া রুমী-আজাদ-আলতাফ-জুয়েল-বদি’র মতো তরুণরা। ১৯৭১-এর আজকের এই রাতে একজন একজন করে তাদেরকে ধরে ফেলা হয়েছিল। ২৯ আগস্ট আর ৩০ আগস্ট ঢাকা শহর তছনছ করে, পাকড়াও করা হয়েছিল বিচ্ছুদের—আমাদের ক্র্যাক প্লাটুনকে।
এই দলের একজন শহীদ সাফী ইমাম রুমী। আমেরিকায় স্কলারশিপ পেয়েও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে যাননি তিনি। যেতে চেয়েছিলেন রণক্ষেত্রে, দেশকে স্বাধীন করতে।
তার মা, আমাদের শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ছেলের অদম্য ইচ্ছার কাছে হার মেনে অবশেষে বলেছিলেন—’যা তোকে দেশের জন্য কুরবানী দিলাম’। তারপর সারাজীবন আফসোস করেছিলেন কেন আমি ‘কুরবানী’ শব্দটা উচ্চারণ করলাম!
এই দলের একজন শহীদ আজাদ।
ঢাকা শহরের সবচেয়ে বড়লোক পরিবারের একমাত্র ছেলে ছিলেন আজাদ। শুকনো রুটি খেয়ে যুদ্ধে থ্রি নট থ্রি চালিয়েছিলেন তিনি। আজকের রাতে ধরা পড়ার পর একদিন মায়ের কাছে ভাত খেতে চেয়েছিলেন। টর্চার সেলে বসে বলেছিলেন—’মা ওরা খুব মারে!’
মা বলে এসেছিলেন—’তুমি মুখ খুলবে না বাবা। কোনো সহযোদ্ধার নাম বলবে না। খুব মারলেও।’
তারপর সেই মা ভাত রাঁধলেন। জেলের ভেতর সেই ভাত নিয়ে গিয়ে দেখলেন তার ছেলেটাকে মেরে ফেলেছে হায়েনারা। সেই মা আরও ১৪ বছর ভাত খাননি জীবিত অবস্থায়, এমনকি ভাত ছুঁয়েও দেখেননি।
এই দিনে চলে গিয়েছিলেন শহীদ আলতাফ মাহমুদ। আমাদের সুরসম্রাট শহীদ। মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং নেবার রুট আর অস্ত্রের মজুদ জানার জন্য যার হাড়গুলো সব একটা একটা করে ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছিল, প্লায়ারস দিয়ে তুলে নেওয়া হয়েছিল সবগুলো নখ।
এই দলের একজন শহীদ জুয়েল। দেশের হয়ে ওপেনিং ব্যাটিং করার স্বপ্ন ছিল যার। মেলাঘরের বৃষ্টিমাখা ক্যাম্পে বসে যিনি এঁকেছিলেন স্বাধীন বাংলা ক্রিকেট দলের স্বপ্ন।
একদিন দেশ স্বাধীন হবে। তাকে আর পাকিস্তানের হয়ে খেলতে হবে না। নিজের একটা দেশ, নিজের পতাকা, নিজেদের ক্রিকেট টিম। সেই স্বপ্ন অধরাই রয়ে গিয়েছিল।
নারায়নগঞ্জে পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দিতে গিয়ে যার পা উড়ে গিয়েছিল।
আজকের রাতেই হাসপাতাল থেকে তাকে রাজাকারদের সহায়তায় গ্রেফতার করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। একদিন পরে ভোরে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল তাকে। মৃত্যুর আগে যিনি উচ্চারণ করেছিলেন ‘জয় বাংলা’।
এই দলের একজন বদি।
হুমায়ূন আহমেদ এর ‘আগুনের পরশমনির’ বদি। মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত যিনি অসম্ভব গাম্ভীর্যে নিতান্তই অবহেলার দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন পাকিস্তানি হায়েনাদের দিকে—ভাটার মতো জ্বলতে থাকা চোখ দুটোতে ছিল কেবল অসম্ভব ঘৃণা…
পুরো ঢাকা শহর কাঁপানো বিচ্ছুদের বেশিরভাগ আজকের এই দিনেই ধরা পড়েছিলেন। আমাদের ক্র্যাক প্লাটুন—আমাদের জন্মমুহূর্তের নায়ক হুঁশিয়ার বীরযোদ্ধারা। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে স্মার্ট আর স্যাভেজ জেনারেশন। বিনম্র শ্রদ্ধা শহীদ তারুণ্যের প্রতি।
তথ্যসূত্র: দৈনিক বাংলা, জানুয়ারি ৮-১১, ১৯৭২ সংখ্যা
আনিসুল হকের ‘মা’ উপন্যাস।
হুমায়ূন আহমেদের ‘আগুনের পরশমণি’ উপন্যাস।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই
আমাদের শহীদ তারুণ্য: আমাদের প্রজন্ম আমাদের প্রেরণা ইমরান ইমন মুক্তমত