Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

আমি দুর্যোধন, তুমি কর্ণ

ডাল্টন সৌভাত হীরা
১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৮:১৪

খুবই অজনপ্রিয় এক বিষয় নিয়ে লিখতে বসেছি। কোনো কারণবশত সকল অপমানের কণ্টকাঘাত প্রেরিত কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনকে নিয়ে লিখতে যাওয়াটা ঝুঁকিবহুল; পপুলিস্ট ভাবধারার হাততালি কিংবা নান্দীপাঠ কোনটাই তাতে খুব একটা জোটে না। কিন্তু আমার লিখতে হচ্ছে। কেননা গত এক দশকে সফল মিডিয়া ট্রায়ালের বিপরীতে প্রকৃত বাস্তবতা যতটুকু অনুধাবন করেছি সেটুকু অন্তত লিখতে চাই, বলতে চাই।

আমার লেখার বিষয়বস্তু ছাত্রলীগ ও এর রাজনীতি। হ্যাঁ, ভ্রু কুঁচকানোর আগে এটুকু পরিষ্কার করি- একসময় ছাত্রলীগের রাজনৈতিক কর্মী ছিলাম, সময়টাও খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১/১১ পরবর্তী বিরূপ রাজনৈতিক বাতায়ন, পরবর্তীতে শাহবাগ আন্দোলনের সময়কাল ছিল সেটি। রাজনৈতিক মত ও আদর্শ প্রকাশ নিয়ে সবসময়ই নিঃসংকোচ ছিলাম, মনে হয়েছিল ‘ভীরু কাপুরুষের উপমা’ হব না আমি, মিছিলে হেঁটে যাই। মিছিলে যে একবার হাঁটে সে ফেরে না সাধারণত, রাজপথেই জড়িয়ে যায়। আমি ফিরেছি, বিগত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে রাজনীতিতে আমার সংশ্লিষ্টতা নেই বলা যায়। বরং আওয়ামী সুসময় ও তার সমালোচনায় কখনও কখনও আমি মুখর হয়েছি, এটা বিদিত। কাজেই একেবারেই নির্মোহভাবে বর্তমান ছাত্ররাজনীতি, বর্তমান ছাত্রলীগের রাজনীতিকে বিশ্লেষণের উপযুক্ততা অনুভব করতে পারি নিশ্চিন্তে।

বিজ্ঞাপন

প্রথমত ছাত্র রাজনীতিতে ছাত্রলীগ যে রাজনীতির প্রতিনিধিত্ব করে সেটা আদর্শিক ধারা। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র বাংলাদেশের সংবিধানের বিলুপ্ত মূলনীতি এখনও কাগজেকলমে হলেও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও এর ভাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের মূলনীতি। আমাদের ১৯৭১ সালের মহান স্বাধিকার আন্দোলনের ভিত্তিও ছিল এ কয়টি। স্বাধীনতা যুদ্ধ, তদপূর্ব স্বাধীকারের ভিত্তি আন্দোলনগুলোতে ছাত্রলীগের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা নিষ্প্রোজন। এইটুকু বলা যেতে পারে স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ‘ছাত্র নিউক্লিয়াসের’ মত ভিত্তিস্তম্ভ থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ নাদের- প্রতিটি অংশেই কোনও না কোনওভাবে ছাত্রলীগ জড়িত। বঙ্গবন্ধু হত্যাপরবর্তী যে প্রতিরোধ যুদ্ধ সেটার সূতিকাগৃহও ছাত্রলীগ। অথবা বঙ্গবন্ধুকন্যার বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের পর থেকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের তীব্র ভ্যানগার্ড, কত কত শাহদান, পঙ্গুত্ব সেগুলোর পেছনে যে অপরাজেয় মানুষেরা ছিলেন, তাদের ব্যাকগ্রাউন্ডও তো ছাত্রলীগই ছিল। বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্রলীগ এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে এর ইতিহাসের দিকনির্ণয়কাল থেকে এর ব্যবচ্ছেদ এক অর্থে বাতুলতাই।

বিজ্ঞাপন

তবে আমাদের সময়ের ছাত্রলীগের প্রতিরোধ যুদ্ধের যায়গাটা ভিন্ন। ’৯০ পরবর্তী প্রতিরোধ যুদ্ধের বড় অংশ জুড়ে ছিল স্বাধীনতাবিরোধী এক অপশক্তি। যাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ যোদ্ধা ছাত্রলীগ। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের গণআদালত প্রশ্নে ছাত্র শিবিরের ভয়ংকর ক্যাডার বাহিনীকে প্রতিহত করার সম্মুখযুদ্ধে দেখেছি এ ছাত্রলীগকেই। ২০০১ পরবর্তী সহিংসতা, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন সব গণআন্দোলনেই এগিয়ে ছিল ছাত্রলীগ।

কিন্তু আমার চোখে ছাত্রলীগসংক্রান্ত নেতিবাচক মনস্তত্ব তৈরি করার সময়টা ২০১০ এর পরবর্তী সময়। এ সময়টা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রবল উত্থানের যুগ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই প্রাথমিক যুগে একটা গোষ্ঠীর প্রবল উত্থান ঘটেছিল। এরাই ব্লগ যুগের প্রথমার্ধে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল। এরাই অনুমিতভাবে ছাত্রলীগকে বিভিন্নভাবে বিতর্কিত করার কাজটি করে। ফলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের হাতে নিহত ছাত্রলীগের ফারুককে কোনো কোনো গনমাধ্যমে দুর্বৃত্ত হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। বিপজ্জানক গোষ্ঠীটির ধারাবাহিকতা এখনও চলমান।

এরমধ্যে আসে শাহবাগ আন্দোলন। যুদ্ধপরাধীদের ফাঁসির দাবি ও পরবর্তীতে সারা বাংলাদেশে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির যে তান্ডবলীলা ছিল, সেখানে ছাত্রলীগের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের শাহদান ভুলি কিভাবে। কিভাবে ভুলি ধর্মীয় এই অপশক্তির বিরুদ্ধে অবস্থানের কারনে বুয়েট ছাত্রলীগ নেতা আরিফ রায়হান দীপের শাহদান।

এইসময়েই তথাকথিত আরেকটি গোষ্ঠী একটি ইস্যুকে জনপ্রিয় আলোচনায় নিয়ে আসে। ছাত্রলীগ কি ধোয়া তুলসি পাতা? ছাত্রলীগ মোটেই তা নয়। দক্ষিন এশিয়ার সর্ববৃহৎ ছাত্রসংগঠন এটি। প্রায় ১ কোটি সদস্যের পরিবারে বিচ্যুতি অবশ্যই থাকবে। ছাত্রনেতাদের আদর্শিক বিচ্যুতি, আদর্শনির্ভর ছাত্রলীগের ছাত্রনেতাদের ব্যক্তিস্বার্থে সংগঠনকে ব্যবহারও যে দেখিনি এমনটা তো নয়। নানা কারনে, বিভিন্নজনের ভ্রন্তিতে সেটি হয়েছে। এমনকি ছাত্রলীগের নেতৃত্ব নির্বাচন সবসময় যে যোগ্য ও আদর্শিক হাতে গেছে তা-ও নয়। আর বিগত দেড় দশকের আওয়ামী শাসনের বিপরীত চেতনা ও আদর্শের নেতৃত্বেরও যে অনুপ্রবেশ ঘটেনি, সেটাও তো অস্বীকার করতে পারি না। এ ধরনের ব্যাত্যয় এমনকি বাম ছাত্র আন্দোলনেও ঘটেছে। প্রগতিশীল বামপন্থী দলে বিপরীত আদর্শগত নেতৃত্বও এসেছে। স্বাধীনতাবিরোধী পরিবারের সন্তানেরাও এসেছেন। চারিত্রিক ও আদর্শিক বিচ্যুতি সকল দলেই ঘটেছে। কিন্তু এতকিছুর পরেও ছাত্র অধিকারসংশ্লিষ্ট সকল আন্দোলনেই ছিল ছাত্রলীগ। এমনকি ছাত্র আন্দোলন অপশক্তি মারফত ছিনতাই হতে গেলে, সেটির প্রতিরোধও করেছে ছাত্রলীগ। কখনও কখনও ছাত্রলীগের নেতৃত্ব প্রতারণা করলেও, প্রতারণা করেনি ছাত্রলীগের সাধারণ কর্মীরা।

আমার অভিজ্ঞতা বলে, ছাত্রলীগের ব্যাকগ্রাউন্ড যে পরবর্তীতে আওয়ামীলীগে রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্য খুব সুযোগ তৈরি করেছে, এমনটি নয়। বরং সুসময়ের আওয়ামীলীগে বঞ্চিত যোগ্যতাসম্পন্ন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীর তালিকাই দীর্ঘ। তবে ছাত্রলীগের কর্মীরাই যে চোখ বন্ধ করে ভরসার অন্য নাম সেটি সবাই স্বীকার করেন।

সম্ভবত ছাত্রলীগ এক জারের কসাক শ্রেণি। তীব্র কৃষিশ্রম যাদের জীব্য, কিন্তু কৃষিজমিতে অধিকার নাই। নানাভাবে সুশীল ঘৃণাজীবীটির যেকোনও বিপদে ছাত্রলীগের কর্মীকেই ছুটে আসতে দেখেছি। এর উদাহরণও প্রচুর। আওয়ামী লীগের হয়ে রাজপথ দখলে রাখা ছাত্রলীগকে বারবার উপেক্ষিত হতে দেখেছি, আওয়ামী রাজনীতিতেই বর্তমানে ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর কাছে, কখনও অভিজাততন্ত্রের কাছে।

তবুও হেরে যাওয়া কর্ণের পাশে হাঁটে দুর্যোধন। কুতুক্ষেত্র সমরে। ছাত্রলীগ আমার কাছে বাংলাদেশ ছাত্ররাজনীতির কর্ণ। যাদের বাদ দিয়ে অসম্ভব ও অসম্পূর্ণ বাংলাদেশ রাজনীতির প্রতিটা অধ্যায়। ছাত্রলীগের প্রত্যেক কর্মী আমার কাছে দুর্যোধন। অসম্ভাবী অপবাদেও সে তার বন্ধুর কাছে থাকে।

এ কর্ণ আর দুর্যোধনদের প্রতি আমার অক্ষম ভালবাসা সবসময়।

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক

সারাবাংলা/এজেডএস

আমি দুর্যোধন ডাল্টন সৌভাত হীরা তুমি কর্ণ

বিজ্ঞাপন

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস আজ
২৫ নভেম্বর ২০২৪ ১০:৫০

আরো

সম্পর্কিত খবর