নালায় পড়ে মৃত্যু, দায় কার?
২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৭:০২
জলাবদ্ধতা চট্টগ্রাম নগরীরর জন্য এক অভিশাপ। বছরের পর বছর এই অভিশাপ মাথায় নিয়ে চট্টগ্রামের মানুষ জীবন যাপন করছেন। দীর্ঘদিন এই জলাবদ্ধতার সাথে বসবাস করতে করতে এই অঞ্চলের মানুষের কাছে এটা নতুন কিছু মনে হয় না। সামান্য বৃষ্টি হলেই শহরের প্রধান প্রধান সড়ক জলাবদ্ধতায় রূপ নিবে এটা একদম মুখস্থ বিষয়। এটাকে সঙ্গে নিয়েই এই অঞ্চলের মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতার চাইতেও বড় ভয়ংকর হয়ে উঠছে ড্রেন অর্থাৎ নালা। ছোট-বড় এসব নালা অনেক সময় জলাবদ্ধতার কারণে দেখা যায় না, আবার অনেক সময় অসাবধানতার কারণেও এই ড্রেনগুলোতে সাধারণ মানুষ পড়ে যায়। আর তখনই সৃষ্টি হয় দুর্ঘটনা। নিভে যায় জীবনের প্রদীপ। জলাব্ধতার কারণে এখন রাস্তার পাশে খাল-নালাগুলোই হয়ে উঠে একমাত্র মৃত্যুফাঁদ। আমরা যেভাবেই রাস্তা দিয়ে যাই না কেন অন্যান্য দুর্ঘটনার পাশাপাশি এখন এই ড্রেনে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও বিরাট ভয়ের কারণ হয়ে উঠেছে।
গত ২৭ আগস্ট এটার অন্যতম উদারণ সারাদেশের মানুষ দেখেছে। শিশু আরাফাতের মৃত্যু কাঁদিয়েছে সকলকে। একটা ছোট্ট শিশুও বাঁচতে পারেনি। এই মৃত্যু থেকে শিশু, বৃদ্ধ, পুরুশ-নারী, কর্মজীবি, শিক্ষার্থী কারও রেহাই নাই। সবাই এই ভয়ংকর মৃত্যুকূপে আটকে যাচ্ছে।
গত কয়েক বছরে চট্টগ্রামে নালায় পড়ে শিক্ষার্থীসহ বেশ কয়েকটি মৃত্যুর পরও টনক নড়েনি সেবা সংস্থাগুলোর। দেয়া হয়নি স্ল্যাব কিংবা নিরাপত্তা বেষ্টনী। তাদের অব্যবস্থাপনার খেসারত দিচ্ছেন নগরবাসী। চট্টগ্রাম শহরটাকে অনিরাপদ হিসেবে বারবার প্রমাণিত করছে দায়িত্বশীলরা। প্রকৃতপক্ষে এর দায় সিটি করপোরেশন কিংবা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ কেউই এড়াতে পারে না। অথচ এক পক্ষ অন্য পক্ষকে দায় চাপিয়ে দিব্যি নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে প্রতিবছর। এভাবে আসলে একটা শহর পরিচালনা হয় না। অথচ গত পাঁচ বছর যাবৎ এমনটাই হয়ে আসছে। এই একটা বিষয়ে যেন সবাই এসে আটকে যায়। মেয়র পরিবর্তন হয়, সিডিএ চেয়ারম্যনও পরিবর্তন হয় শুধু পরিবর্তন হয় না এই জলাব্ধতা আর নালায় পড়ে মৃত্যুও করুণ দৃশ্য।
গত বছরের ৬ ডিসেম্বর বোতল কুড়াতে গিয়ে নালায় নিখোঁজ হয় কামাল নামে ১২ বছরের এক শিশু। তলিয়ে যাওয়ার তিন দিন পর মির্জা খালে তার মরদেহ পাওয়া যায়। ২০২১ সালের ২৫ আগস্ট জলাবদ্ধতার সময় রাস্তা পার হতে গিয়ে মুরাদপুর এলাকায় নালায় পড়ে নিখোঁজ হন সালেহ আহমেদ নামে একজন সবজি বিক্রেতা। এখন পর্যন্ত তার মরদেহের সন্ধান মেলেনি। এর কয়েকদিন পর ৩০ সেপ্টেম্বর আগ্রাবাদ এলাকায় নালায় পড়ে মারা যান কলেজশিক্ষার্থী সেহরীন মাহমুদ সাদিয়া। ৯ জুন নগরীর আমিন জুট মিল এলাকায় নালায় পড়ে মারা যায় আল আমীন নামে এক শিশু। একই বছরের ৩০ জুন ষোলোশহর চশমা হিল এলাকায় খালে রিকশা পড়ে মারা যান চালক সুলতান ও যাত্রী খাদিজা বেগম।
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের তথ্যমতে, চট্টগ্রামে নালা-নর্দমায় ঝুঁকিপূর্ণ স্থান রয়েছে পাঁচ হাজারের বেশি। যার সর্বশেষ বলি হয়েছেন শিশু আরাফাত। তবে নিয়মিত এসব নালায় পড়ে আহত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
এত এত প্রাণহানি ও আহত হওয়ার পরও এই বিষয়টা নিয়ে তেমন কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। উন্মুক্ত নালাগুলো এখনও অরক্ষিত। কোনো ধরনের স্ল্যাব কিংবা নিরাপত্তা বেষ্টনী দেয়া হয়নি। নেই কোনো পরিকল্পনা। চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ এতে ক্ষুব্ধ। এ অঞ্চলের মানুষের গলার কাঁটা হয়ে আছে এই সমস্যাটি। অথচ বছরের পর বছর এই একটা সমস্যার সমাধান করে দিবে বলে চট্টগ্রামের মানুষের সাথে ছলনা করে যাচ্ছে প্রশাসন। স্থানীয় প্রশাসনের কাছে এটা শুধুমাত্র বর্ষার সময় একটা আলোচনার বিষয় হয়ে উঠে মাত্র। বাকী সারাবছর এই বিষয়টা নিয়ে আর কারও কোনো মাথাব্যাথা নাই। বর্ষা আসলেই শুধু এই বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়, টকশো হয়, মানুষের মৃত্যু হয়।
কিন্তু এভাবে আর কতদিন? আর কতদিন শব্দটাও আসলে ভুল, আর কতকাল বলতে হয়। এতো এতো বছর যাবৎ এই এক সমস্যা নিয়ে এই অঞ্চলের মানুষ বসবাস করছে কি পরিমাণ যন্ত্রণা নিয়ে একবার ভেবে দেখুন। সীমাহীন এই কষ্ট থেকে চট্টগ্রামের মানুষ বাঁচতে চায়, মুক্তি চায়। তবুও প্রশ্ন থেকেই যায়, কবে মিলবে এই দুর্ভোগ থেকে মুক্তি?
লেখক: প্রাবন্ধিক এবং কলাম লেখক
সারাবাংলা/এজেডএস