Tuesday 26 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মার্কসবাদী তাত্ত্বিক কমরেড হায়দার আকবর খান রনো

সৈয়দ আমিরুজ্জামান
৩১ আগস্ট ২০২৩ ১৮:৩৯

কমিউনিস্ট আন্দোলনের কিংবদন্তি ও মার্কসবাদী তাত্ত্বিক কমরেড হায়দার আকবর খান রনো, কাজী জাফর আহমদ ও কমরেড রাশেদ খান মেনন রাজনীতির ত্রিরত্ন। কমরেড রাশেদ খান মেনন ও কমরেড হায়দার আকবর খান রনো বাম প্রগতিশীল রাজনৈতিক জুটি হিসেবে খ্যাতি ছিল দীর্ঘদিন। উভয়ের সাথে আমার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। এ বিষয়ে অন্য কোন নিবন্ধে আলোচনা করার ইচ্ছা রইলো।

কমরেড রনোর রাজনৈতিক জীবন বৈচিত্রে ভরপুর। বারবার কারাবরণ, রাজনৈতিক কারনে আত্মগোপন, ষাটের দশক থেকে এই পর্যন্ত সকল গণতান্ত্রিক সংগ্রামের অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব প্রদান, সামরিক শাসনবিরোধী ৬২-এর ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান, শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলা, ৬৯-এর গণ-অভ্যূত্থানে সংগঠকের ভূমিকা পালন, ৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানের রূপকার এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিভিন্ন বাক মোড়ে দিক নির্দেশকের ভূমিকা পালন তার বৈচিত্রময় জীবনের কয়েকটি দিকমাত্র। তিনি আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গেও ঘনিষ্টভাবে সম্পৃক্ত। পাশাপাশি মার্কসবাদী তাত্বিক রচনা সহ অসংখ্য প্রবন্ধ ও গ্রন্থ রচনা করেছেন, যার কিছু কিছু বিদেশী ভাষায় অনুদিত হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

মার্কসবাদ, দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি, এমনকি সাহিত্য ও বিজ্ঞানেও তার দখল রয়েছে, আরও রয়েছে এই সকল বিষয়ে তার মূল্যবান রচনা। তাকে দেখা গেছে মাঠ কাঁপানো বক্তৃতা দিতে, যে কারণে ছাত্রজীবনে তাকে বলা হতো অনলবর্ষী বক্তা, আবার দেখা গেছে জটিল তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক বিষয়ে সব ধরণের শ্রোতার কাছে সহজবোধ্য আকর্ষণীয় করে তুলে ধরতে। পাশাপাশি তাকে দেখা গেছে সংগঠক হিসাবে এবং রাস্তার আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণ করে নেতৃত্ব প্রদান করতে। তাকে দেখা গেছে ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গণে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের যে সব গুণাবলী দরকার তার কোনটিরই অভাব নাই। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই নেতা। পরিপূর্ণরূপে সৎ আদর্শনিষ্ট, ত্যাগী ও সংগ্রামী নেতা হিসেবেই তার পরিচিতি রয়েছে যা আজকের বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরল।

বিজ্ঞাপন

শৈশব ও শিক্ষাজীবন

১৯৪২ সালের ৩১ আগস্ট কলিকাতায় নানা বাড়িতে হায়দার আকবর খান রনোর জন্ম হয়। ২য় মহাযুদ্ধের সময় জন্ম হয়েছিল বলে তার ডাক নাম রাখা হয়েছিল রনো। এখন তিনি এই নামেই পরিচিত। তার আদি নিবাস বৃহত্তর যশোরের নড়াইল। তার পিতৃভূমি নড়াইল থানার অন্তর্গত চিত্রা নদীর পাড়ে, বরশূলা গ্রাম (বর্তমানে নড়াইল পৌরসভার অন্তর্গত)। নানাবাড়ি নড়াইল থানার অন্তর্গত মির্জাপুর গ্রাম। পিতা হাতেম আলী খান ছিলেন প্রকৌশলী। ১৯৬৮ সালে মরহুম হাতেম আলী খান তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সড়ক ও জনপথ বিভাগের চিফ ইনজিনিয়ার হিসাবে অবসর গ্রহণ করেন। সৎ ও যোগ্য অফিসার হিসাবে তার খ্যাতি ছিল। সেতু নির্মাণ সংক্রান্ত প্রকৌশলগত বিষয়ে তার অবদান ছিল। সৎ, প্রগতিশীল ও মুক্তবুদ্ধি চিন্তার অধিকারী এবং সাহিত্যানুরাগী হিসাবে খ্যাতিমান ছিলেন তিনি। ১৯৯৯ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। রনো ভাইয়ের মাতা কনিজ ফতেমা মোহসিনা ছিলেন সৈয়দ নওশের আলীর দ্বিতীয় কন্যা। উত্তরাধিকারসূত্রে তিনি লাভ করেছিলেন প্রগতিশীল চিন্তাধারা। বাম রাজনৈতিক কর্মীদের প্রতি রনোর মাতার দরদ ছিল অকৃত্রিম। দরদ উজার করে আদর ও সহযোগিতা করার জন্য বাম প্রগতিশীল মহলের কর্মীদের কাছে তিনি বিশেষ পরিচিত ও শ্রদ্ধার স্থানে অবস্থান করেন।

কমরেড রনোর মানসিক গড়নের ক্ষেত্রে পিতা-মাতার বিশেষ ভূমিকা ছিল। কমরেড রনো তার আত্মজীবনীতেও স্বীকার করেছেন যে তার রাজনৈতিক জীবনে পিতা-মাতার বিশেষ সহযোগিতা ছিল। অনেক সময় তারা খুবই ঝুকি নিয়ে রাজনৈতিক কাজে সহযোগিতা করেছেন। কমরেড রনোরা দুই ভাই। ছোট ভাই হায়দার আনোয়ার খান জুনোও কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বিশিষ্ট রাজনৈতিক কর্মী, কারাবাস, রাজনৈতিক আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসাবে ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান এবং ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র অংশগ্রহণ (যার কিছু কিছু ঘটনা ঢাকার নিকটস্থ শিবপুর অঞ্চলে এখনও কিংবদন্তি হিসাবে রয়েছে) ইত্যাদি কমরেড রনোর ছোট ভাইয়ের রাজনৈতিক জীবনের অংশবিশেষ। এককথায় এক প্রগতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশে হায়দার আকবর খান রনোর জন্ম ও বেড়ে ওঠা।

কমরেড রনো যশোর জিলা স্কুল, রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল ও ঢাকার সেন্টগ্রেগরী স্কুলে ও পরে নটরডেম কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনা করেন। তিনি ছিলেন মেধাবী ছাত্র। স্কুল জীবনে সবসময় ক্লাসে ফার্স্ট হতেন। ১৯৫৮ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে তিনি মেধা তালিকায় ১২তম স্থান লাভ করেন। গণিত ও ইংরেজী বাংলা সাহিত্যে সমপরিমাণ দখল ছিল। ছোট বয়েসেই তিনি বাংলা ও বিদেশী ক্ল্যাসিকাল সাহিত্য পাঠ করেছিলেন। কিশোর বয়েসেই বাবার কাছ থেকে শুনে শুনে রবীন্দ্রনাথ, মাইকেল, নজরুল, সেকসপিয়ারের বিভিন্ন কাব্য কমরেড রনোর মুখস্ত হয়ে গিয়েছিল। তিনি খুব চমৎকার আবৃত্তি করতে পারেন। পাশাপাশি তিনি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিতর্ক ও সাহিত্য প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে বহু পুরস্কার লাভ করেছেন। পরবর্তীতে তিনি ভালো বক্তা হিসাবেও পরিচিতি লাভ করেছিলেন। ১৯৬০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু পদার্থ বিদ্যার কোর্স সম্পন্ন করতে পারেননি কারাবাস ও অন্যান্য কারণে। পরে তিনি আইনশাস্ত্রে ব্যাচেলর ডিগ্রী লাভ করেন। এল এলবি’র প্রথম পর্ব তিনি জেল থেকে পরীক্ষা দেন। পরবর্তীতে তিনি হাইকোর্টের সনদও লাভ করেছিলেন। কিন্তু কোনদিন ওকালতি পেশা গ্রহণ করেননি। একমাত্র রাজনীতি ছাড়া অন্য কোন পেশাও তার ছিল না। তিনি ছিলেন সার্বক্ষনিক রাজনীতিবিদ। তবে খবরের কাগজে কলম লেখা ও প্রকাশিত বইয়ের থেকে তিনি কিছু অর্থ উপার্জন করেছেন।

ছাত্র আন্দোলন

১৯৬২ এর ফেব্রুয়ারী সামরিক শাসন বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানের মধ্য দিয়েই হায়দার আকবর খান রনোর রাজনীতিতে প্রবেশ। ইতিপূর্বে তিনি গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। ১৯৬১ সালে তিনি মেধাবী ছাত্র হিসাবে যে সিয়াটো স্কলারশিপ পেয়েছিলেন, তার পুরোটাই কমিউনিস্ট পার্টিকে চাঁদা হিসাবে দিয়েছিলেন। তখন দেশে সামরিক শাসন চলছিল। প্রকাশ্য রাজনৈতিক তৎপরতা ছিল না। কোন ছাত্র সংগঠনের অস্তিত্ব ছিল না। অবশ্য গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন ছাত্র গোপনে সামরিক শাসন বিরোধী ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। তার মধ্যে প্রধান ভূমিকায় ছিলেন মোহাম্মদ ফরহাদ ও হায়দার আকবর খান রনো। টার্গেট ছিল ২১ শে ফেব্রুয়ারী মিছিল থেকে শুরু হবে সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন। ইতিমধ্যে ৩০ জানুয়ারী শহীদ সহরোওয়ার্দী গ্রেফতার হলে টার্গেট তারিখ এগিয়ে আনা হয়। ঠিক হয় পহেলা ফেব্রুয়ারী ছাত্র ধর্মঘট ডাকা হবে। রনো সহ অন্যান্যরা এই ধর্মঘটের ব্যবস্থা করেন। পহেলা ফেব্রুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘট হয় এবং ঐদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় যে ছাত্র সভা হয়েছিল, সেখানে একজনই বক্তা ছিলেন হায়দার আকবর খান রনো। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তিনিই প্রথম প্রকাশ্য বক্তব্য রেখেছিলেন। ৬২ সাল জুড়ে যে ঐতিহাসিক সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন ও পরবর্তীতে শিক্ষা আন্দোলন হয় রনো তার নেতৃত্বে ছিলেন। তখনো পর্যন্ত কোন সংগঠিত ছাত্র সংগঠন ছিল না। ছাত্র নেতারা ঠিক করলেন ১৯৫২ সালে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নকে (যা ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসনের পর বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলো) পূনর্জীবিত করা হোক। বস্তুত: পুরাতন নামগ্রহণ করলেও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নকে নতুন করে গঠন করা হয়েছিল। অকটোবর মাসে এক সম্মেলনের মধ্য দিয়ে এই সংগঠনের পুনর্জন্ম হয়েছিল। ঐ সম্মেলনে হায়দার আকবর খান রনো ৬২-এর আন্দোলনের উপর রাজনৈতিক রিপোর্ট পেশ করেন। ড. আহমদ জামানকে সভাপতি, কাজী জাফর আহমদকে সাধারণ সম্পাদক ও হায়দার আকবর খান রনোকে যুগ্ম সম্পাদক করে ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়েছিল। ৬২ সালে রনো দুইবার গ্রেফতার হয়েছিলেন। ৬২ এর মার্চ মাসে তাকে গ্রেফতার করে প্রথমে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে রাখা হয়েছিল, পরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়, যেখানে ছাব্বিশ সেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে একত্রে ছিলেন। পরের বৎসর ১৯৬৩ সালে হায়দার আকবর খান রনো পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তার নেতৃত্ব ও দক্ষ সাংগঠনিক যোগ্যতার কারণে সেই সময় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন ক্ষুদ্র অবস্থা থেকে দেশের সর্ববৃহৎ ছাত্র সংগঠনে পরিণত হয়েছিল। ছাত্র আন্দোলনের কারণে ১৯৬৪ সালে তার নামে হুলিয়া বের হয়, যা তখনকার সকল পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছিল। তিনি আত্মগোপনে গেলেন। কিন্তু দুই মাস পর ধরা পড়েন। তাকে গোয়েন্দা সংস্থার কার্যালয়ে দুই দিনরাত জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রাখা হয়েছিল। ঘুমাতে দেয়া হয়নি। মাথার উপর রাখা হয়েছিল অনেক পাওয়ারের বৈদ্যুতিক বাতি। সেবার তিনি বৎসরাধিকাল জেল খাটেন। ১৯৬৫ সালের তার জেলে থাকা কালেই ছাত্র ইউনিয়ন বিভক্ত হয়েছিল। ১৯৬৫ সালে কারামুক্তির পর তিনি ছাত্র ইউনিয়নের একাংশকে (মেনন গ্রুপ) সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন।ইতিমধ্যে ১৯৬৫ সালে তিনি রেল ধর্মঘটের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন এবং আবার স্বল্পকালের জন্য কারারুদ্ধ হন। জেলে থাকা অবস্থায় তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, মুক্তির পর তিনি আর ছাত্র সংগঠন করবেন না, এবার সরাসরি শ্রমিক বা কৃষক আন্দোলনের সাথে যুক্ত হবেন। ১৯৬৬ সালে তিনি সরাসরি শ্রমিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। শ্রমিক আন্দোলন :১৯৬৬ সালে কাজী জাফর আহমদ ও হায়দার আকরব খান রনো টঙ্গী শ্রমিক এলাকায় শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। এই দুইজন মিলে টঙ্গী অঞ্চলে যে শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন তা বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায়।হায়দায় আকবর খান রনো ঢাকার বাসা ছেড়ে টঙ্গীর শ্রমিক বস্তিতে বাস করতে শুরু করেন। সপ্তাহে এক আধবার ঢাকায় আসতেন রাজনৈতিক কারণে। মধ্যবিত্ত ঘর থেকে আসা রাজনৈতিক কর্মীর নিজস্ব বাড়ী ঘর ছেড়ে শ্রমিক বস্তিতে দিনের পর দিন থেকে তৃণমূল পর্যায়ে শ্রমিক আন্দোলন ও বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলার ঘটনা আমাদের দেশে খুব বেশী নাই। কমরেড রনোর এই জীবন বিপ্লবীদের জন্য দৃষ্টান্তস্থানীয়।গ্রেফতারী পরওয়ানা এড়িয়ে তিনি শ্রমিক কলোনী বা বস্তিতে বাস করতেন। টঙ্গীতে যে ধরণের শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলা হয়েছিল তাতে এবং শ্রমিকদের মধ্যে তার যে ধরণের বিশাল জনপ্রিয়তা ছিল, তাতে টঙ্গী অঞ্চল থেকে তাকে পুলিসের পক্ষে খুব বড় রকমের প্রস্তুতি ও ঝুকি নেয়া ছাড়া গ্রেফতার করা সহজ ছিল না। এরপর তিনি আর কখনো গ্রেফতার হননি। তবে আত্মগোপনে গেছেন অনেকবার।১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানেও তার ভূমিকা ছিল। একদিকে টঙ্গীতে শ্রমিক আন্দোলন, পাশাপাশি জাতীয় রাজনৈতিক আন্দোলনে সংগঠকের ভূমিকা দুটোই পাশাপাশি চালিয়ে গেছেন। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে টঙ্গী থেকেই শুরু হলো ঐতিহাসিক ঘেরাও আন্দোলন। এই আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দেন। পরে ঘেরাও আন্দোলন অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে। রনোকে তখন টঙ্গীর বাইরে অন্যান্য শ্রমিক অঞ্চলেও যেতে হয়েছে, সংগঠন গড়ে তুলতে ও নেতৃত্ব দিতে। বলা যেতে পারে তার নেতৃত্বে এক নতুন ধারার শ্রমিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। ১৯৬৯-৭০ সালে দ্বিতীয় সামরিক শাসন আমলে টেকসটাইল শ্রমিকদের যে ঐতিহাসিক দুইমাস ব্যাপী বেআইনী ধর্মঘট হয়েছিল কমরেড রনো ছিলেন তার নেতৃত্বে। টঙ্গী অঞ্চলে অসংখ্য বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ে সেনাপতির ভূমিকা পালন করেছিলেন এই সাহসী নেতা হায়দার আকরব খান রনো। সেসব ঘটনা এখনো কিংবদন্তির মতো রয়েছে। ১৯৭০ সালে তিনি তদানিন্তন সর্ববৃহৎ শ্রমিক সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন।

রাজনৈতিক আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও কমিউনিস্ট আন্দোলন

ছেলেবেলায় পারিবারিক সূত্রে তিনি কমিউনিস্ট মতাদর্শের সংস্পর্শে আসেন। কিছু কিছু মার্কসবাদী সাহিত্য তিনি স্কুল জীবনে কলকাতা থেকে সংগ্রহ করে পাঠ করেছিলেন। ১৯৬৫ সালের আগে এদেশে মার্কসবাদী সাহিত্য নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৬০ সালে তিনি গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সংস্পর্শে আসেন। ১৯৬৯ সালের দিকেই তিনি এই দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব। ১৯৬৬ সালে গোপন কমিউনিস্ট পার্টি আন্তর্জাতিক মহাবিতর্কের যুগে বিভক্ত হলে তিনি চীনপন্থী অংশের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। পরবর্তী দুই বৎসরে ঐ অংশ কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়। ১৯৬৯ সালে তিনি আরও কয়েকজনের সঙ্গে একত্রে গঠন করেন “কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি”। ১৯৭১ সালে এই সমন্বয় কমিটির নেতৃত্বে বাংলাদেশে ১৪টি সশস্ত্র ঘাটি এলাকা তৈরী হয়েছিল। এই সকল অঞ্চলগুলির সঙ্গে যোগাযোগ ও রাজনৈতিক পারিচালনার এবং মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার কাজে তিনি নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ অন্যান্য সহকর্মীদের সঙ্গে তিনি শিবপুর যান, যেখান থেকে পরবর্তীতে সমন্বয় কমিটির নেতৃত্বাধীন সশস্ত্র ঘাটি অঞ্চলগুলির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা হতো। শিবপুরেও সমন্বয় কমিটির অন্যতম সদস্য মান্নান ভুঁইয়ার নেতৃত্ব গড়ে উঠেছিল বিশাল মুক্তিবাহিনী এবং ঘাটি অঞ্চল। সেখান থেকে তিনি এবং রাশেদ খান মেনন নানা পথ ঘুরে টাঙ্গাইলের বিন্নাফুর গ্রামে গিয়েছিলেন মওলানা ভাসানীর সঙ্গে সাক্ষাত করতে (৩ এপ্রিল)। পরদিনই মওলানা ভাসানীর বাসা পাক বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হয়েছিল। একদিন পরই ভাসানীর সঙ্গে রনো-মেনন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। যুদ্ধের সময় অনেক চেষ্টা করেও তারা আর যোগাযোগ করতে পারেননি।১৯৭১ এর ১ ও ২ জুন কলকাতার বেলেঘাটায় ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির সহায়তায় বামপন্থীদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় যেখানে ‘বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি’ গঠিত হয়েছিল। হায়দার আকবর খান রনো এই কমিটির ঘোষণাপত্র রচনা ও পেশ করেছিলেন। ছাত্র জীবন থেকেই মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসার সুযোগ তার হয়েছিল। পরবর্তী জীবনে তিনি মওলানা ভাসানীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে থেকে জাতীয় রাজনীতিতে ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৯৭১ সালেই রনোর পরিচয় ঘটে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মোজাফ্ফর আহমদ সহ ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির বিভিন্ন নেতার। কমরেড রনো তার আত্মজীবনীতে বলেছেন যে, সিপি আই (এম) এর এই সকল নেতা, যারা অবিভক্ত বৃটিশ ভারতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের ভিত্তি ভূমি তৈরী করে গেছেন, তাদের কাছ থেকে তিনি যে শিক্ষা লাভ করেছেন, তা ছিল তার জীবনের দুর্লভ সম্পদ। কমরেড রনোর কাছে এখনও সংরক্ষিত আছে তার কাছে লেখা কমরেড মুজাফফর আহমদ, পি সুন্দরাইয়া, ইএমএস নম্বুদিরিপাদ প্রমুখের চিঠি। কমরেড রনোর সঙ্গে অনেক বিদেশী কমিউনিস্ট, ওয়ার্কার্স, মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পার্টির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। কমিউনিস্ট পার্টি সমুহের অনেক আন্তর্জাতিক সম্মেলনেও তিনি যোগদান করেছেন। ১৯৭২ সালে কমরেড রনো ও অন্যান্য সহকর্মীরা মিলে গঠন করেন বাংলাদেশের কমিউনিট পার্টি (লেনিনবাদী)। পরে ১৯৭৯ সালে পার্টির নাম পরিবর্তন করা রাখা হয় বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পাটি। প্রথম থেকেই (১৯৭২) তিনি এই পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য ছিলেন। ১৯৭৯-৮৪ সাল পর্যন্ত তিনি পার্টির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মওলানা ভাসানীর ঘনিষ্ঠ অনুসারী হলেও এবং বিভিন্ন সময় ন্যাপের কর্মকান্ডে ভূমিকা রাখলেও তিনি কখনও ন্যাপের সভ্য হননি। ১৯৭৪ সালে ইউপিপি গঠিত হলে তিনি তার সহ-সভাপতি ছিলেন ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত। সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে জাতীয় পর্যায়ের সকল রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে তিনি যে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন শুধু তাই-ই নয়, বিভিন্ন সময় তিনি বুর্জোয়া সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছেন এবং প্রতিটি রাজনৈতিক প্রশ্নে শ্রমিকশ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন, তত্ত্বগতভাবে এবং বাস্তব সাংগঠনিক ও আন্দোলনগত কাজের মধ্য দিয়ে। রনোর মধ্যে বাস্তব সংগ্রাম ও তত্ত্বের সমন্বয় লক্ষ্য করা যাবে। সাহস, দৃঢ়তা, কৌশলগত নমনীয়তা ও বুদ্ধিমত্তার এক অপূর্ব সমন্বয় দেখা যাবে।এরশাদ সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে তিনি প্রথম থেকেই নেতৃত্বর ভূমিকা পালন করেছেন। সাতবার তার নামে হুলিয়া জারী হয়েছে। প্রতিবারই তিনি আত্মগোপনে থেকে আন্দোলনকে সংগঠিত করেছেন। এরশাদ আমলের নয় বৎসরে তার বাসা পঞ্চাশ বারের বেশী মিলিটারী পুলিশ রেইড করেছিল। ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের তিনি ছিলেন অন্যতম রূপকার।

লেখালেখি

রাজনৈতিক কর্মকান্ডের পাশাপাশি তিনি লেখালেখি করেছেন প্রচুর। তার প্রথম বই প্রকাশিত হয় ২৪ বৎসর বয়সে “সাম্রাজ্যবাদের রূপরেখা”। এপর্যন্ত প্রকাশিত বই-এর সংখ্যা ১৫। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য শতাব্দী পেরিয়ে, ফরাসী বিপ্লব থেকে অকটোবর বিপ্লব, সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের সত্তর বছর, রাজনীতির কথা প্রসঙ্গে, বিবিধ প্রসঙ্গ, গ্রাম শহরের গরীব মানুষ জোট বাধো, মার্কসবাদের প্রথম পাঠ, মার্কসীয় অর্থনীতি, মার্কসবাদ ও সশস্ত্র সংগ্রাম, কমিউনিস্ট আন্দোলনের তিনধারা (পুস্তিকা), সিপিবির বন্ধুদের প্রতি (পুস্তিকা), চীনপন্থী বন্ধুদের প্রতি (পুস্তিকা), তার কিছু কিছু বই ও প্রবন্ধ বিশেষ সময়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। ২০০৫ সালে তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ “শতাব্দী পেরিয়ে” প্রথম আলোর নির্বাচনে বৎসরের সেরা বই হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল। তাছাড়াও তার লেখা অজস্র প্রবন্ধ আছে দর্শন, অর্থনীতি, রাজনীতি, সাহিত্য, এমনকি বিজ্ঞান বিষয়ক।

অন্যান্য

কমরেড রনো খুব সরল জীবন যাপন করেন। নিরাহঙ্কার মানুষটি সহজ সরলভাবে মিশতে পারেন যে কোন স্তরের মানুষের সঙ্গে এবং সকলেই তার আন্তরিকতার স্পর্শে মুগ্ধ হন। বিশেষ করে যে গরীব জনগোষ্ঠীর মধ্যে তিনি কাজ করেন, তারা তাকে আপন বলে গ্রহণ করতে পারে রনোর নিজস্ব চারিত্রিক ও আচরণগত বৈশিষ্টের কারণে। তিনি সাহিত্য পড়তে ভালবাসেন। বাংলা ইংরেজী সাহিত্যের বহু কবিতা তার এখনও মুখস্ত আছে। সুযোগ পেলেই তিনি ভালো সিনেমা ও নাটক দেখেন। ক্রিকেট খেলায় তার আগ্রহ আছে।হায়দার আকবর খান রনো এক কন্যার (রানা সুলতানা) পিতা এবং এক নাতির (অরিত্র) নানা।

লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

মার্কসবাদী তাত্বিক কমরেড হায়দার আকবর খান রনো মুক্তমত সৈয়দ আমিরুজ্জামান

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর