তালেবানদের সাথে প্রতিবেশীদের সম্পর্কের সমীকরণ
৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৬:০৪
আফগানিস্তান থেকে আমেরিকা ও ন্যাটো জোটের সেনা প্রত্যাহারের দুই বছর পার হয়েছে। এই দুইবছরে আফগানিস্তানের ভিতরে কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা বাদে তালেবানদের নিজভূমিতে তেমন কোনো সমস্যায় পড়তে হয়নি। সে জায়গায় তালেবানরা নিজেদের অবস্থানকে অনেকটাই পাকাপোক্ত রাখতে পেরেছে। কিন্তু এখনো তালেবান সরকারকে বহির্বিশ্বে কেউ স্বীকৃতি দেয় নি। এমনকি তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোও না। বিশ্বের মোড়ল রাষ্ট্রগুলোর অবস্থানও স্পষ্ট। প্রতিবেশী চীন তালেবান সরকারের বড় প্রকল্পগুলোতে মোটা অংকের বিনিয়োগ করছে। আমেরিকা নারী ইস্যু নিয়ে তালেবানের সাথে দরকষাকষি করছে। রাশিয়াও তালেবানের সাথে সম্পর্ক শিথিল রেখেছে। যদিও এসব প্রচেষ্টার মানে এই নয় যে তালেবান শাসনকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে কিন্তু এসব প্রচেষ্টা থেকে এটা বলা যায় যে, ধীরে হলেও তালেবানের শাসনকে স্বীকৃতি দেওয়া অবধারিত। এ ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তালেবানদের সাথে সম্পর্ক বাড়ানোর বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখছে এবং সম্পর্ক শিথিল করাও শুরু করেছে। এক্ষেত্রে তালেবানদের উত্তরের প্রতিবেশী মধ্য এশিয়ার পাঁচটি দেশও ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু পানি সংকট, আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাকে মাথায় রেখে ভেবে চিন্তে অগ্রসর হচ্ছে মধ্য এশিয়ার এসব রাষ্ট্র।
আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী মধ্য এশিয়ার এ ৫টি রাষ্ট্র হচ্ছে কাজাখস্তান, কিরগিজিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও উজবেকিস্তান। আফগানিস্তানকে নিয়ে প্রত্যেকটি দেশের রয়েছে আলাদা আলাদা স্বার্থ। কাজাখস্তান আয়তনে পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র। মধ্য এশিয়ার বৃহত্তম এ দেশটি তালেবানের সাথে সম্পর্কের কথা চিন্তাও করেনি৷ ২০০৫ সালে কাজাখস্তানের সুপ্রিম কোর্ট তালেবানকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। তালেবানের বিরুদ্ধে যেকোনো কার্যক্রমকে উৎসাহিত করেছে। কিন্তু তালেবান ক্ষমতায় আসার পর এসব বিষয় নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ফাটল ধরে নি। বরং জ্বালানি সমৃদ্ধ এ দেশের সাথে তালেবান বাণিজ্য সম্পর্ক আরো বাড়িয়েছে৷ কাজাক ও তালেবানদের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা খুব শিগগিরই ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত করার ঘোষণা দিয়েছে কাজাক কর্তৃপক্ষ। আফগানিস্তান তাদের আমদানির ৬০ শতাংশ আটা কাজাখস্তানের উৎপাদনকারীদের থেকে আমদানি করেন৷ গত মাসের (আগস্ট) শুরুর দিকে দুই দেশের বাণিজ্য চুক্তি দাড়িয়েছে ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এমনকি প্রতিবেশী কাজাক আরো বেশি খাদ্য পণ্য সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তালেবানকে। কারণ দক্ষিণ এশিয়ার সাথে যোগাযোগ রাখতে চাইলে আফগানিস্তান তাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ট্রানজিট। সম্প্রতি আফগান রুট ব্যবহার করে কাজাকরা পাকিস্তান পণ্য সরবরাহ করছে। প্রতিবেশী উজবেকিস্তানও একই ভূ-রাজনৈতিক লক্ষ্যকে সামনে রেখে তালেবানের সাথে সম্পর্ক শিথিল করার দিকে এগোচ্ছে।
চলতি বছরের ১৮ জুলাই উজবেকিস্তান, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে রেলযোগাযোগ নিয়ে একটি ত্রিদেশীয় চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর মধ্য দিয়ে উজবেকিস্তান তালেবানের ভূমি ব্যবহার করে দক্ষিণ এশিয়ার সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক স্থাপন করবে। এছাড়া উজবেকিস্তান ও কাজাখস্তান তাদের পণ্য রপ্তানির জন্য পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলের দিকে তাকিয়ে আছে। দক্ষিণ এশিয়ার সাথে বাণিজ্য করতে পারলে তাদের রাশিয়া নির্ভরতা অনেকটাই কমবে। এই দুই রাষ্ট্রসহ কিরগিজিস্তানেরও তালেবানদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার একমাত্র কারণই দক্ষিণএশিয়ার সাথে বাণিজ্য পথ চালু রাখা৷ আর এর একমাত্র উপায় তালেবানদের ভূমি আফগানিস্তান। কিন্তু এই মৌলবাদী ও কট্টরপন্থী গ্রুপের সাথে উজবেকিস্তানের নানা কারণে সম্পর্ক বজায় রাখা খুব সহজ হবে না৷ এর মধ্যে একটি হল এই দুই দেশের মধ্যে পানি নিয়ে বড় ধরনের বিরোধ দেখা দিয়েছে।
তালেবান ক্ষমতায় আসার পরই মেঘা প্রকল্প হিসেবে কস টেপা সেচ খাল নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। আমু দরিয়া নদীকে কেন্দ্র করে এই সেচ প্রকল্প নির্মাণ করা হলে উজবেকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তানের পানি প্রবাহ ১৫ শতাংশ কমে যাবে। আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলের জমি পানি পেয়ে উর্বর হবে। এতে কয়েকশত একর জমিতে ফসল চাষ করতে পারবে আফগানরা৷ কিন্তু উজবেক ও তুর্কমেন কৃষকদের চাষাবাদে সমস্যা হবে। উজবেকিস্তানের পানির রিজার্ভ কমে যাবে এবং প্রচন্ড খরা তৈরি হবে ঐসব অঞ্চলে। এ সমস্যা থাকার পরেও উজবেকিস্তান এই প্রকল্পকে কেন্দ্র করে তালেবানের সাথে কোনো সম্পর্কের অবনতি করতে চায় না। কারণ এই প্রকল্পে বাঁধা দিলে তালেবান উজবেকদের দক্ষিণ এশিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিবে। একই অবস্থা তাজিকিস্তানেরও। কিন্তু দুশানবে তালেবানকে নিজেদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করে এবং তালেবান বিরোধী যেকোনো কর্মকাণ্ডে দেশের ভিতরে ও বাইরে নানা তৎপরতা চালিয়েছে৷ তাদের এই মনোভাবের উপর তালেবান ক্ষুদ্ধ। ২০২৩ সালের মে মাসে সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার সম্মেলনে তাজিকিস্তান এ সম্পর্ক আরো খারাপের দিকে নিয়ে যায়। আফগানিস্তানের মাদক চোরাচালান ও নিরাপত্তা হুমকির বিষয়টি সকলের সামনে এনে বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। আফগানিস্তানকে ঘিরে একটি নিরাপত্তা বলয় তৈরি করার উপর জোর দিয়েছে দেশটি। এ নিয়ে তাদের মধ্যে বৈরিতা তৈরি হয়। ফলশ্রুতিতে তালেবান তাজিকিস্তানের কয়েকটি ট্রাক আটক করে ও জামাত আনসারুল্লাহ যোদ্ধাদের তাজিক সীমান্তে মোতায়েন করে।
আবার আফগানদের দক্ষিণের প্রতিবেশী পাকিস্তান। তালেবানদের খারাপ সময়ের বন্ধু বলা যায় পাকিস্তানকে। ইমরান সরকারের সাথে তালেবানদের সম্পর্ক ভালো থাকলেও বর্তমান পাকিস্তানের জন্য তালেবানদের হুমকি মনে করা হয়। পাকিস্তান তাদের নিরাপত্তার জন্য তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) কে হুমকি মনে করে। আর এই জঙ্গিগোষ্ঠির স্বর্গস্থান বলা হয় আফগানিস্তানকে। জাতিসংঘের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে জানা যায়, কয়েকটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর দলছুটদের একত্র করে টিটিপি আফগান-পাকিস্তান সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। আফগানদের সাথে পাকিস্তানের সীমান্ত রয়েছে প্রায় ২৪০০ কিলোমিটার। তাই পাকিস্তানের সাথে তালেবানদের সম্পর্কের সমীকরণ কোনদিকে মোড় নিবে সেটা বলা দুষ্কর। এ দিকে ইরানের সাথে তালেবানদের পানিকেন্দ্রিক সমস্যা রয়েছে। ১৯৭৩ সালে ইরান ও আফগানিস্তানের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির শর্তানুযায়ী তেহরান পানি না দেওয়ায় তালেবানরা আত্মঘাতী বোমা হামলাকারীসহ সেনাদের প্রস্তুতের খবর প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু ইরানের উপর আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা তালেবানদের সাথে তেহরানের বাণিজ্য সম্পর্কে চিড় ধরাতে পারেনি। সর্বোপরি, তালেবানদের সাথে তার প্রতিবেশীদের সম্পর্কের বিষয়টি তালেবানদের মনোভাবের উপরই অধিকাংশ নির্ভর করে। আবার দক্ষিণ এশিয়ার এই সমস্যা পীড়িত রাষ্ট্র থেকে আমেরিকা নিজেদেরকে সরিয়ে নিতে পারলেও প্রতিবেশীরা কিভাবে বিষয়টি সামাল দিবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
লেখক: শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এজেডএস
তালেবানদের সাথে প্রতিবেশীদের সম্পর্কের সমীকরণ মো. জাহিদ হোসেন