আসন্ন নির্বাচন ঘিরে তিস্তার জট খোলা জরুরি কেন
৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৬:১৮
এবারের ১৮তম জি-২০ (গ্রুপ অব টোয়েন্টি) শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ভারতে। দুই দিনের শীর্ষ সম্মেলনে আগামী ৯ সেপ্টেম্বর ও ১০ সেপ্টেম্বর নয়াদিল্লিতে মিলিত হবেন বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরা। ১৯টি সদস্যরাষ্ট্র ও একটি জোটসংস্থা ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ (ইইউ) বিশ্বের ৪০ দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রতিনিধিরা এ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করবেন। ভারতে প্রথমবারের মতো জি–২০ সম্মেলনের আয়োজন করা হচ্ছে।
গ্রুপ অব টোয়েন্টি (জি-২০) হলো আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সহযোগিতার প্রধান ফোরাম। এটি বৈশ্বিক স্থাপত্য গঠন ও শক্তিশালীকরণ এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে আন্তর্জাতিক অর্থনীতি পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।
গত শতকের নব্বইয়ের দশকে গভীর অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছিল এশিয়ার অনেক দেশ। এ সংকট শেষে ১৯৯৯ সালে বিশ্বের শীর্ষ ১৯টি ধনী দেশ ও একটি জোটসংস্থা মিলে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক জোট গড়ে। তারা বুঝতে পেরেছিল, এমন সংকট কোনো একটি দেশের সীমানার মধ্যেই আবদ্ধ থাকে না। তাই এ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে আরও অর্থনৈতিক সহযোগিতার প্রয়োজন। এ জোটই জি–২০। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় বৈশ্বিক অর্থনীতির বিভিন্ন সমস্যা ও সংকট নিয়ে এখানে আলোচনা করা হয়।
জি-২০’র সদস্য দেশগুলো হলো- আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, চীন, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইতালি, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মেক্সিকো, রাশিয়া, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা, তুরস্ক, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। জি-২০’র সদস্য দেশগুলো বিশ্বের জিডিপির প্রায় ৮৫ শতাংশ ও বিশ্ব বাণিজ্যের ৭৫ শতাংশ ও বিশ্বের দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে।
এবারের জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন-২০২৩-এর মূল প্রতিপাদ্য হলো, “এক পৃথিবী, এক পরিবার, এক ভবিষ্যৎ। মানুষ, প্রাণী, উদ্ভিদ ও অণুজীবসহ সব জীবনের মূল্য এবং পৃথিবী ও বিস্তৃত গ্রহে তাদের আন্তঃসম্পর্ককে কেন্দ্র করে এজেন্ডটি নির্ধারণ করা হয়েছে।
বিশ্বনেতাদের মধ্যে ভারতের জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যারা অংশ নেবেন তাদের মধ্যে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রডো ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাঁক্রো।
বাংলাদেশ জি-২০’র সদস্য না হলেও সম্মেলনে বিশেষভাবে ভারত আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও অংশ নেবেন। ১০ সেপ্টেম্বর সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেছেন, সে বৈঠকে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে আলোচনা হবে। এছাড়া ৫৪টি অভিন্ন নদী ইস্যু আছে, গঙ্গা পানি চুক্তির মেয়াদও ২০২৬ শেষ হবে। এসব বিষয় নিয়ে যৌথ নদী কমিশনও আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে এক দীর্ঘমেয়াদি অমীমাংসিত ইস্যু।
দীর্ঘ আলোচনার পর বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের মধ্যে ১৯৯৬ সালে গঙ্গা নদীর পানি বণ্টনের চুক্তি স্বাক্ষর হয়। ৩০ বছরের চুক্তির মেয়াদ ২০২৬ সালে শেষ হয়ে যাবে। সে দিক নিয়েও আলোচনা প্রয়োজন। দীর্ঘসূত্রতার পর গঙ্গা নদীর পানি বন্টন নিয়ে চুক্তি হলেও তিস্তা নদীর পানি ভাগাভাগির ব্যাপারে এখনও কোনো সুরাহা হয়নি। সর্বশেষ ২০১১ সালে দুই দেশের মধ্যে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে সব প্রস্তুতি নেওয়া হলেও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিরোধিতায় তা সম্পন্ন করা যায়নি। বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা দেশের জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুটির এবার সমাধান হোক, সেটাই প্রত্যাশিত। কেননা নির্বাচনের ওপর তিস্তা ইস্যুর প্রভাব রয়েছে।
বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন এসেছে। গত ১৫ বছরেরও বেশি সময়ে দুই দেশের মধ্যে বহুল প্রত্যাশিত বিভিন্ন চুক্তির ফলে সম্পর্কের উচ্চতা ক্রমাগত বেড়েছে। ভবিষ্যতে ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত ইস্যুগুলোর সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাধানে ঐতিহাসিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে, সেটাই প্রত্যাশা। খুব স্বাভাবিকভাবেই তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে প্রশ্ন ওঠছে বারবার।
আন্তর্জাতিক নদী হিসেবে ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার অধিকার থাকলেও শুকনো মৌসুমে তিস্তার পুরো পানিই ব্যবহার করছে ভারত, অন্যদিকে পানি পাচ্ছে না বাংলাদেশ। তিস্তা বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষি, মৎস্য ও খাদ্যব্যবস্থার জন্য পানির বড় উৎস। বিশেষ করে অববাহিকাসংলগ্ন প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার গ্রামের মানুষ তাদের জীবিকার জন্য এ নদীর ওপর প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক আইনি বিধি ব্যবস্থা অনুযায়ী, একটি আন্তঃদেশীয় নদী হিসেবে তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়া বাংলাদেশের ন্যায্য অধিকার। ভারতের চাওয়াসমূহের বেশিরভাগ পূরণ হলেও বাংলাদেশের কিছু অপ্রাপ্তি রয়ে গেছে।
দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের পানির গুরুত্বপূর্ণ উৎস তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তির অনিশ্চয়তা দূর হয়নি। এক দীর্ঘসূত্রতার বেড়াজালে আটকে আছে তিস্তার জট। রাজনৈতিক কারণেই তিস্তা চুক্তিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। তিস্তার পানি ভারতের একতরফাভাবে আটকে দেওয়া আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। আর তিস্তার পানির ন্যায্য হিস্যা আমাদের কাছে করুণা নয় বরং ন্যায্য অধিকার। এ ন্যায্য অধিকার থেকে আমাদের আর কতদিন বঞ্চিত রাখা হবে?
ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের বর্তমান সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার আন্তরিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ ও ভারতের দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত অনেক জনগুরুত্বপূর্ণ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান হয়েছে। বিশেষ করে স্থলসীমান্ত ও সমুদ্রসীমানার মতো জটিল বিষয়গুলো বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে সুষ্ঠু সমাধানের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারত প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিশ্বে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
ভারত আন্তরিক হলেই দীর্ঘসূত্রতার তিস্তা ইস্যু সমাধান হয়ে যায়। এক্ষেত্রে দুই দেশের জনগণের মধ্যে সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হবে বলে মনে করি। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মানুষের পানি নিয়ে যে হাহাকার সেটার লাঘব হবে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যগত ও ভৌগলিকগত যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সেটা অটুট থাকুক। আসন্ন জি-২০ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে তিস্তার পানি বণ্টন ইস্যুসহ অমীমাংসিত অন্য ইস্যুগুলোরও দ্রুত সমাধান হবে–এটাই প্রত্যাশা।
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট; ফিচার সম্পাদক, দৈনিক ফেনী
সারাবাংলা/এজেডএস