পর্যটন খাতে সম্ভাবনা ও প্রতিবন্ধকতা
১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৫:৫১
বিশ্বের অন্যতম সম্ভাবনাময় শিল্পের খাত হচ্ছে পর্যটন খাত। যা বিভিন্ন দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। বিপুল সম্ভাবনাময় এ শিল্প খাতের মাধ্যমে শুধু উন্নত দেশই নয়, বরং অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হতে পারে।
পর্যটন আবাসন খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে দেশের সবচেয়ে বড় একটি লাভ হবে, কর্মসংস্থান তৈরি। এছাড়াও পর্যটনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করার বিরাট সুযোগ রয়েছে। এজন্য প্রয়োজন দেশের পর্যটন স্পটগুলো আকর্ষণীয় ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা। প্রয়োজন বিনিয়োগ ও ব্র্যান্ডিং করা। শুধু দেশের নয়, বিদেশের বিনিয়োগও সুফল বয়ে আনতে পারে এই খাতে। বর্তমান বিশ্বের প্রতিযোগিতামূলক অর্থনীতিতে টিকে থাকার জন্য পর্যটনশিল্পের ভূমিকা অতুলনীয়।
বর্তমানে বাংলাদেশের জিডিপির প্রায় দুই শতাংশ আসে পর্যটন খাত থেকে। এটি আরও বৃদ্ধি করার জন্য প্রয়োজন বিনিয়োগ এবং পরিকল্পনা। এ দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথে পর্যটনশিল্প বড় নিয়ামক হতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বহুমাত্রিক পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনা রয়েছে শুধু কক্সবাজারে। বহুমাত্রিক পর্যটনে সাংস্কৃতিক, ইকো, স্পোর্টস, কমিউনিটি ও ভিলেজ ট্যুরিজম ব্যবস্থা অত্যাবশ্যক। বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পে বেসরকারি বিনিয়োগ ধীরে ধীরে বাড়ছে। পর্যটকদের আবাসন সুবিধা বৃদ্ধির অভিপ্রায়ে কক্সবাজারে রাজধানী নগরী ঢাকা থেকেও বেশি হোটেল-মোটেল গড়ে উঠেছে। সব পর্যটনকেন্দ্রেই বেসরকারি উদ্যোগের কারণে অভ্যন্তরীণ পর্যটকদের আকর্ষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে উল্লেখযোগ্য হারে। এটি পর্যটন খাতের জন্য ভালো দিক বলা যেতে পারে।
গণমাধ্যম বরাত জানা যায়, ২০২৫ সালের মধ্যে পর্যটনশিল্পের সর্বোচ্চ বিকাশে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। পুরো দেশকে আটটি পর্যটন জোনে ভাগ করে প্রতিটি স্তরে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রথমবারের মতো সরকারি-বেসরকারি যৌথ বিনিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর অংশ হিসাবে কক্সবাজারে পর্যটন অবকাঠামো নির্মাণে ২৫টি প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এগুলোয় প্রায় প্রত্যক্ষভাবে বিনিয়োগ হবে ৩৭ হাজার কোটি টাকা। পরোক্ষভাবে বিনিয়োগ হবে ১ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া সরকারের প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে কক্সবাজার বিমানবন্দর উন্নয়ন, আধুনিক হোটেল-মোটেল নির্মাণ, মহেশখালীতে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ, সোনাদিয়াকে বিশেষ পর্যটন এলাকা হিসাবে গড়ে তোলা, ইনানি সৈকতের উন্নয়ন, টেকনাফের সাবরাংয়ে ইকো ট্যুরিজম পার্ক নির্মাণ, শ্যামলাপুর সৈকতের উন্নয়ন, ঝিলংঝা সৈকতের উন্নয়ন, চট্টগ্রাম কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ, কুতুবদিয়ায় বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পের সম্প্রসারণ, চকরিয়ায় মিনি সুন্দরবনে পর্যটকদের গমনের জন্য যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন, ডুলাহাজরা সাফারি পার্কের আধুনিকায়ন প্রভৃতি।
এছাড়া আরও চারটি নতুন প্রকল্প নিতে যাচ্ছে সরকার। এসব বাস্তবায়ন হলে আগামী দিনে দেশের পর্যটন খাত আরও চাঙা হবে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতেও পিপিপির মাধ্যমে বিনিয়োগ করা হবে। দেশের নৌ, বিমান, রেল এবং সড়ক যোগাযোগ অবকাঠামোতে আমূল পরিবর্তন আসায় পর্যটনখাত বিকাশের বড় সুযোগ তৈরি হয়েছে। বিদেশী পর্যটক আকর্ষণে দ্রুত ই-ভিসা চালু এবং বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনালের মাধ্যমে ফ্লাইট বৃদ্ধির উদ্যোগও নেওয়া হচ্ছে।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশে বিদেশি পর্যটকরা ভ্রমণ করতে আসেন। এটি আরও দিগুণ করা যায় যদি কিছু বিষয়ে বাড়তি গুরুত্বে দেয়া যায়। পর্যটকদের নিরাপত্তা, যোগাযোগের সুবিধা ও আকর্ষণীয় অফার দিলে বিভিন্ন দেশের মানুষ আগ্রহ নিয়ে বাংলাদেশ ঘুরে দেখতে চাইবে। সেইসাথে দেশের ১৮ কোটির বেশি মানুষের ৫ শতাংশ মানুষও নিজ দেশ ভ্রমণ করার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠবে। যা ধীরে ধীরে বাড়বে। আর এতে করে আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা সৃষ্টি হবে।
দেশের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন আনতে পারে পর্যটনশিল্প। বাংলাদেশের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হবেন না এমন পর্যটক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। বাংলাদেশ সৌন্দর্যের লীলাভূমি। তাই এদেশের পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনাও অপরিসীম। আমাদের রয়েছে সুবিশাল সমুদ্রসৈকত, পাহাড়, জলপ্রপাত, প্রতœতত্ত্বের প্রাচুর্য, ঐতিহাসিক নিদর্শনসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যম-িত স্থান; যা পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্য যথেষ্ট। নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ ইতিহাস, বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি আমাদের দেশকে পরিণত করেছে একটি বহুমাত্রিক আকর্ষণসমৃদ্ধ অনন্য পর্যটন গন্তব্যে। আমাদের খাদ্য, সংস্কৃতি, প্রকৃতি সবই হৃদয়ে ধারণ করতে বাধ্য হবে ভিনদেশীরা।
তাহলে প্রশ্ন আসতেই পারে আমরা কেন পিছিয়ে? আমাদের সমস্যাটা আসলে কোথায়? প্রতিবন্ধকতা কি? বিশ্বের তুলনায় বাংলাদেশ এ শিল্পে পিছিয়ে থাকার কিছু কারণ রয়েছে। এসব কারণ হচ্ছে, পর্যটনসমৃদ্ধ অঞ্চলের অবকাঠামো উন্নয়ন, পর্যটকদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা শতভাগ নিশ্চিত করা, পর্যটন স্পটে পর্যটকদের জন্য বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তোলা, পর্যটন এলাকায় পুলিশকেন্দ্র স্থাপন, যাতায়ত ব্যবস্থার উন্নয়ন, বিদেশি পর্যটকদের জন্য পর্যাপ্তসংখ্যক গাইডের ব্যবস্থা করা, বিদেশে বাংলাদেশের ট্যুরিজম প্রমোশনে রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারের উদ্যোগী ভূমিকা পালন, পাঠ্যপুস্তকে পর্যটন বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, ইন্টারনেট ও ওয়েবসাইটের মাধ্যমে প্রচারণা, পর্যটন বিষয়ে শিক্ষা ও গবেষণার ওপর গুরুত্বারোপ, পর্যটন এলাকায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, গ্যাস ও টেলিফোন ব্যবস্থা, পর্যটন এলাকা বা এর আশপাশে সরকারি উদ্যোগে প্রয়োজনীয়সংখ্যক থ্রি-স্টার/ফাইভ-স্টার হোটেল নির্মাণ করা, পর্যটকদের জন্য বিভিন্ন অফার প্যাকেজ চালু রাখা প্রভৃতি।
তবে একটা কথা বলে রাখতে হয়, পর্যটনশিল্প রাতারাতি গড়ে ওঠে না। পর্যটনের সঙ্গে ১১৯টি সাব সেক্টর জড়িত। দেশের ১৭টি মন্ত্রণালয় প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। তাই এটি সমৃদ্ধ করতে প্রয়োজন সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। আশার কথা হচ্ছে, ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে বছরে প্রায় দুই কোটির বেশি দেশি পর্যটক ভ্রমণ করেন। আর বিদেশি পর্যটক আসেন প্রায় ৫ লাখ।
পরিশেষে বলা যায়, জাতীয় অর্থনীতির বিকাশে পর্যটন শিল্পের উন্নয়ন করা ছাড়া বিকল্প নেই। পর্যটন শিল্পকে উন্নত এবং দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে পর্যটন স্পটগুলোকে আকর্ষণীয় করে তুলে ধরতে হবে। বাংলাদেশে গণমাধ্যমের দায়িত্বও রয়েছে এ ব্যাপারে। সব স্থান থেকেই আন্তরিক হতে হবে এ বিষয়ে। তাহলেই সফলতা আসবে বলা যায়।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই