শান্তির বিপরীতে পৃথিবীর যাত্রা
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৫:৪৫
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে পৃথিবী অনেক বেশি সংঘাতপূর্ণ,অশান্ত,অস্থিতিশীল এবং প্রতিযোগীতামূলক। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে শুরু হয়ে এখনও চলছে এবং কবে শেষ হবে তা অনিশ্চিত। বস্তুত পৃথিবীর নেতৃবর্গ স্বার্থ ছাড়া আর কিছুই ভাবছে না এমন ধারণাই দৃশ্যমান। আশ্চর্য হলেও এটাই সত্যি। আফ্রিকায় একের পর এক সেনা অভ্যূত্থানে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। মিয়ানমারে গণতন্ত্র বন্দী বন্দুকের নলের কাছে। লাখ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী দেশ ছাড়া। এছাড়াও রাজনৈতিক অস্থিরতা পৃথিবীকে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এই সমস্যা যেতে না যেতেই আবার যুুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়েছে মধ্য এশিয়া। এ অঞ্চলের প্রতিবেশী দুই দেশ কিরগিজস্থান ও তাজিকিস্তানের মধ্যে সংঘাত হয়েছে। দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে তুমুল লড়াইের খবর পাওয়া গেছে। এর ফলে পুরো বিশ্বই এক কথায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এখানেও সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর দ্বন্দ্ব রয়ে গেছে। প্রায় সপ্তাহব্যাপী শুরু হওয়া এই লড়াইয়ে হতাহতের ঘটনাও ঘটেছে। এর ফলে বিশ্ব শান্তির পথে হাঁটার কথা বললেও চলছে উল্টো পথে। অর্থাৎ মুখে এক কথা বললেও বাস্তবতা ভিন্ন। পৃথিবী ইতিমধ্যেই দুটি বলয়ে ভাগ হয়েছে। যার একদিকে পশ্চিমা দেশগুলো এবং অন্যদিকে রাশিয়া-চীন। সংঘাতপূর্ণ পৃথিবীতে শান্তি একটি কাঙ্খিত কিন্তু প্রায় অধরা শব্দ। বিশ্ব নেতারা শান্তি ফেরাতে বহু উদ্যোগ নিলেও কার্যত বিশ্বে অস্থিরতা এবং স্বার্থের দ্বন্দ্বে অশান্তির পরিস্থিতি বিরাজ করছে। পরাশক্তিগুলোর টানটান উত্তেজনা এবং ক্ষমতায় টিকে থাকার লড়াইয়ে বেজে ওঠে যুদ্ধের দামামা। বিশ্ব শান্তি দিবসে তাই বিশ্ব নেতাদের হিসাব করার সময় এসেছে বিশ্ব আজ কতটা শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতিতে অগ্রসর হচ্ছে। আজ যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব রয়েছে তা বিদ্যমান থাকলে এবং অস্ত্রের মহড়া বন্ধ না হলে প্রকৃতপক্ষে শান্তি অধরাই থেকে যাবে। বিভিন্ন দেশে আভ্যন্তরীণ অস্থিরতা, শরণার্থী সংকট, দারিদ্রতা, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধাবস্থা প্রভৃতি বিশ্বকে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করছে। ২১ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাপী পালন করা হয় বিশ্ব শান্তি দিবস। পৃথিবী থেকে যুদ্ধ,হিংসা,আগ্নেয়াস্ত্র প্রয়োগের মতো ঘটনা মুছে ফেলতেই প্রতি বছর ২১ সেপ্টেম্বর দিনটি পালন করা হয়। সত্যি কথা বলতে যে উদ্দেশ্যে বিশ্ব এই দিনটি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা কতটা বাস্তবায়িত হচ্ছে তা নিয়ে সংশয় থেকে যায়। কারণ অস্ত্র এবং তা নিয়ে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এখন একটি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বিশ্ব প্রকৃতপক্ষে শান্তি চায়। কিন্তু শান্তি বজায় রাখার পথে বিশ্ব হাঁটছে না।
যুদ্ধ এবং উত্তেজনা শান্তির অন্তরায়। বর্তমান অস্থির বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন হলেও মাঝে মধ্যেই উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠে কোনো দেশ বা অঞ্চল। মূলত নিজের আধিপত্য জানান দিতেই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্ব শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া এবং কেউ তার নিজের নিজের অবস্থান থেকে সরে আসতে সম্মত নয়। এই যে আজ বিশ্ব এক মহা সংকটের সামনে দাড়িয়ে রয়েছে এবং এখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য ঐক্যমত অত্যন্ত জরুরী, তা সত্ত্বেও কিন্তু বিশ্বে অস্থিরতা বিরাজ করছে। ইয়েমেনের জন্য আমরা গত কয়েকটি বছরে কি করতে পেরেছি? সেখানে দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতির জন্য আমরাই দায়ী। রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করে মিয়ানমার অশান্তির আগুন জে¦লে দিয়েছে। যার সমাধান একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া বলে মনে হচ্ছে। এরকম আরও উদাহরণ আছে বর্তমান বিশ্বে যার দায় কেবল মানুষেরই। অন্যায্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তা জোরপূর্বক বাস্তবায়ন করতে গিয়ে যত অশান্তির জন্ম হচ্ছে। তার ফল ভোগ করতে হচ্ছে সারা বিশ্বকেই। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ আভ্যন্তরীণ শান্তির জন্য অবিরত কাজ করে যাচ্ছে।
করোনা মহামারীর চেয়ে বিশ্বে ক্ষমতার প্রয়োগের মানসিকতার মহামারী মানুষের ধ্বংসের জন্য বেশি দায়ী। মানুষের মনে অশান্তির বীজ রোপিত হয়েছে তা থেকে মানুষ কি কোনোদিন বেরিয়ে আসতে পারবে? তা করতে হলে নিজেকে নিজের জায়গা থেকে একটু সরে আসতে হবে। আর শক্তিমত্তা যাচাইয়ে মানুষ তা কোনোদিনই করবে বলে মনে হয় না। সামরিক খাতে নতুন নতুন অস্ত্র যোগ করা এবং বিশ্ব প্রতিযোগীতায় নিজেকে উপযুক্ত করে গড়ে তোলা এখন প্রতিযোগীতামূলক বিশ্বের প্রবণতা।
প্রত্যেকেই যার যার মতো করে নিজের সুরক্ষায় ব্যস্ত। এক্ষেত্রে কোনোদেশই পিছিয়ে থাকতে চাইছে না। প্রতিটি দেশেরই বহিঃশত্রুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। সেই অধিকার থেকেই নিজেকে সুরক্ষার প্রচেষ্টা করে। দুর্বল বা সবল কোনো দেশ এক্ষেত্রে ছাড় দিতে রাজি নয়। প্রয়োজনে মিত্রদেশের সাথে জোটভুক্ত হয়েও নিজেকে সুরক্ষা দিতে ব্যস্ত। যুদ্ধ আসলে মানব সভ্যতাকে কোনোদিনই ভালো কিছু দিতে পারেনি। যা দিয়েছে তা হলো মানবিক যন্ত্রণা যা দীর্ঘমেয়াদে নারী-পুরুষ ও শিশুরা ভোগ করছে। দিয়েছে অশান্তি যার আগুনে পুড়েছে পুরো মানব সভ্যতা। অসংখ্য মানুষ তাদের বাস্তুচুত্য হয়েছে। তারা আজ আশ্রয়হীন হয়ে পরাধীন জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। অথচ তাদের দায় কেউ নিচ্ছে না।
দেশগুলো নিজেদের ব্যয়িত অর্থের একটি বড় অংশই অস্ত্র প্রতিযোগীতার পেছনে ব্যয় করছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর থেকে এই হিসাব অনেকটা বদলে গেছে। প্রতিরক্ষা খাত আরও বেশি শক্তিশালী করতে এ খাতে আরও বরাদ্দ বৃদ্ধি করছে। আধুনিক অস্ত্র কিনতে বিপুল অর্থ ব্যয় করছে। অনেক দেশে সামরিক খাতের ব্যয় অনেক বেশি। কিন্তু কেন এই প্রতিযোগীতা? আমরা কার কাছ থেকে নিরাপদে থাকতে চাইছি? আমাদের প্রধান শত্রু কে? এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানা আবশ্যক। সময় এসেছে আমাদের আত্মবিশ্লেষণ করার। নিজেকে সুরক্ষিত রাখা বা অন্যকে ভয় দেখানো যদি আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য হয় তাহলে আমাদের মূল উদ্দেশ্য থেকে দূরে সরে যাচ্ছি বলেই আমার মনে হয়। পৃথিবীর অস্তিত্তই যদি হুমকির সম্মুখীন হয় তাহলে নিজেকে সুরক্ষিত করার কোনো অর্থ হয় না। আজকের যে আক্রমণাত্বক প্রবণতা তা অতীতেও ছিল। যখন রাজায় রাজায় যুদ্ধ হতো আর উলুখাগড়ার প্রাণ যেতো। তারাও তাদের শক্তিমত্তা জানান দিতে প্রায়ই অন্যদেশ আক্রমণ করতো। যুদ্ধের নতুন নতুন কৌশল বের করতো। নতুন নতুন অস্ত্র দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতো। মানুষকে মারার জন্য মানুষের এত কৌশল! সে সময়ও ছোট ছোট রাজ্যগুলো একজোট হয়ে বড় রাজ্যকে প্রতিহত করতো। সেই কৌশলের আজও কোনো পরিবর্তন হয়নি। পরিবর্তন হয়েছে রণক্ষেত্রের। মানুষের এসব কাজের দ্বারা, অস্ত্রের দ্বারা মানুষের কি উপকার হয়েছে। মানব জাতি আজ অস্তিত্ব সংকটে।
যুদ্ধ এবং শান্তি পরস্পর বিপরীতমুখী প্রক্রিয়া। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে বর্তমান বিশ্বে দুটো বিষয়ই পাশাপাশি চলছে। একদিকে একে অন্যকে আক্রমণাত্বক বক্তব্য ছুড়ছে অন্যদিকে শান্তির বুলি। মানুষ আসলে কি চায় তা মনে হয় নিজেও জানে না। যুদ্ধ না শান্তি? অস্ত্র না মানবতা? এসব তো পাশাপাশি চলতে পারে না। প্রত্যেকেই সামরিক সক্ষমতা বাড়াতেই ব্যস্ত। এসব করতে গিয়ে পৃথিবীর কি হবে তা নিয়ে ভাবার কোনো অবকাশ নেই। আমরা কি নিজেদের রক্ষা করতে গিয়ে হারিয়ে ফেলবো? মানুষ সত্যিই কত বোকা! যখন পৃথিবীর অস্তিত্ত নিয়েই প্রশ্ন ওঠে তখন কেবল নিজেকে রক্ষা করার জন্য বিপদমুক্ত করার জন্য অত্যাধুনিক সব মারণাস্ত্র অর্থ ব্যয় করছি। এর থেকে অনেক বেশি জরুরী পৃথিবী বসবাসযোগ্য করা। পৃথিবীতে বহু মানুষ আজ আশ্রয়হীন, খাদ্য নিরাপত্তায় ভুগছে। বহু শিশু তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশগুলো পুর্নগঠন করা জরুরি। তারপরেও মানুষ অস্ত্র প্রতিযোগীতার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন অস্ত্রের জন্ম হচ্ছে। ধ্বংস দিয়ে শান্তি আনা যায় না। ক্ষমতার আধিক্যের এই যুগে শান্তি প্রক্রিয়া কতটা দীর্ঘস্থায়ী হবে সেটাই এখন প্রশ্নের বিষয়। মূলত এটা হাস্যকর ব্যাপার। কারণ হিংসা, দ্বন্দ্ব দিয়ে আর যাই হোক শান্তি আনা যায় না। সুতরাং মানুষকে প্রথমে ঐক্যমত হতে হবে যে তারা আসলে কি চায়। পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠিত করতে হলে অবশ্যই যুদ্ধ,হানাহানি বন্ধ করে ক্ষমতার দম্ভ ত্যাগ করে নিজেকে শান্তির পক্ষে দাড় করাতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই