আসন্ন নির্বাচন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ও কিছু কথা
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৮:১৫
দ্বিজাতিতত্ত্বের উপর ভিত্তি করে ১৯৪৭ সালের ১৪ এবং ১৫ আগষ্ট জন্ম হয় পাকিস্তান ও ভারত নামের দুটি রাষ্ট্রের। হিন্দুস্তান তথা ভারত হিন্দুদের এবং পাকিস্তান মুসলমানদের জন্য। তারপরও পাকিস্তানে বহু হিন্দু এবং হিন্দুস্তানে বহু মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ রয়ে গেছিলেন। ১৯৪৭ এবং ৪৮ এর দাঙ্গার পরেও তারা আপন জন্মভূমিতে রয়ে গেছিলেন। পাকিস্তানের দুটি অংশের একটা পূর্ব পাকিস্তান এবং অন্যটি পশ্চিম পাকিস্তান। ৪৭ এ ভাগ হওয়ার ২৩ বছরের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয় এবং বাংলাদেশ নামে নতুন একটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির জন্মের পিছনে শোষণ, বঞ্চনা, নিপীড়নের বহু ইতিহাসের পাশাপাশি এই ভূখণ্ডের মানুষের ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে একসাথে মিলেমিশে বসবাস করার বিষয়টিরও গুরুত্ব ছিলো। কারণ পাকিস্তান হয়ে যাওয়ার পরও বহু হিন্দু ধর্মাবলম্বী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশে রয়ে গেছিলো শুধু এই বঙ্গের মানুষের অসাম্প্রদায়িক মনোভাব এবং সম্পর্কের কারণে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে সকল ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে এদেশের মানুষ একতাবদ্ধ হয়ে দেশ স্বাধীন করেছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু সংবিধান প্রনয়ণ করেন এবং সংবিধানের ৪ টি মূলনীতির একটি ধর্মনিরপেক্ষতা রাখেন। বঙ্গবন্ধু সবসময় বলতেন এই বাংলাদেশে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সকলের সমান অধিকার। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে কলকাতার ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় দেয়া বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন “আমি ধর্ম নিরপেক্ষতার একটি চারা বাংলাদেশে রোপণ করেছি। এই চারা কেউ যদি ছিড়ে ফেলতে চায়, উপড়ে ফেলতে চায় তাহলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।” সেই চারাগাছটি ভালোভাবেই বেড়ে উঠছিলো। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার সাথে সাথে তার রোপিত সেই চারা গাছ টিকে সমূলে উৎপাটিত করে পরবর্তী সেনা শাসকেরা। একজন ধর্মনিরপেক্ষতা নষ্ট করলো আরেকজন সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম যুক্ত করলো। এটা যে অন্য ধর্মগুলোর প্রতি খুব বিদ্বেষের জন্য করেছে এমনটা নয়। উভয়ই তাদের ক্ষমতার খুঁটি শক্ত রাখতে একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় আবেগকে পুঁজি করেছিলো। তবে এরপর গনতান্ত্রিক সরকারের সময়েও সংবিধানের এই বিষয়গুলো কেউ পরিবর্তন করে নাই। কি জানি, তাদের মনেও ওদের মতো কোনো চিন্তা ভাবনা ছিলো কিনা।
৯০ এ স্বৈরশাসকের পতনের পর যখন এদের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় চিন্তা করেছিলো এবার হয়তো সংবিধান পরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধুর করা ৭২’ এর সংবিধানে ফেরত যাবে দেশ। কিন্তু সকল আশায় জল ঢেলে দিলো ১৯৯২ সালে হওয়া সংখ্যালঘুদের উপর চরম নির্যাতন ও সহিংসতার ঘটনা। ৯২’ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙার পর ৭ তারিখ থেকেই এদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর নেমে আসে নির্যাতন ও সহিংসতা। সংবাদমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী ঢাকা সহ ২১ জেলা শহরে সহিংসতা চালানো হয়। হিন্দুদের মন্দির ভাংচুর করা হয়, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়। তৎকালীন সরকার একরকম ব্যার্থ ছিলো এই সহিংসতা প্রতিরোধ করতে। তবে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বাম দল, ছাত্রসংগঠনগুলো এলাকায় এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল। ঢাকায় সাদেক হোসেন খোকা সহ কিছু জায়গায় সরকার দলীয় কয়েকজন নেতা সহিংসতা প্রতিরোধে পাহারার কাজ করেছিলো। এরপর ৯৬ এ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলো। স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরি নেতৃত্ব দেওয়া এবং সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর গড়া সংগঠন হওয়ায় দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কিছুটা নিশ্চিন্ত ছিলো। ছোটখাটো কিছু সমস্যা হলেও বড় কোনো দাঙ্গা বা সহিংসতা ওই সময়ে শোনা যায়নি। কিন্তু এই সুখ খুব বেশীদিন স্থায়ী হয়নি। পরবর্তীতে ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হওয়ার পর আবারও সহিংসতা শুরু হয়। হত্যা, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ, মন্দির ভাংচুর সহ বিভিন্ন ঘটনা ঘটে।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসলে চিন্তা করা হয় এবার বুঝি অবস্থার পরিবর্তন হবে। কিছু পরিবর্তন অবশ্যই হয়েছে। কিন্তু যতোটা আশা করা হয়েছিল তার কিছুই হয়নি। বিভিন্ন জায়গায় নামধারী নেতারা সংখ্যালঘুদের জমি দখল করেছে, জমি দখলের জন্য সহিংসতা করেছে। সিরাজগঞ্জের শাল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর,কুমিল্লা, রংপুর সহ বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সময় সহিংসতা হয়েছে।
২০২১ সালের দুর্গাপূজার সময় কুমিল্লায় একটি মন্দিরে মূর্তির পায়ের নিচে পবিত্র কুরআন শরীফ রাখাকে কেন্দ্র করে সারাদেশে অনেক মন্দির এবং প্রতিমা ভাংচুর হয়েছে। রংপুরের পীরগঞ্জে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে জানা যায় একটা পাগল এই কাজ করেছে এবং সে ইসলাম ধর্মাবলম্বী। এতো হামলা,ভাংচুর, অগ্নিসংযোগের পর যখন জানা গেলো এটা সনাতন ধর্মাবলম্বীরা করেনি তখন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মনে প্রভাব পড়েছে।সংখ্যালঘু শিক্ষকদের টার্গেট করা হচ্ছে। স্কুল শিক্ষক হৃদয় মন্ডল তার প্রমাণ। স্কুলের শিক্ষার্থীদের মাথায় কীভাবে শিক্ষকের কথা রেকর্ড করার বিষয় আসবে? কাদের আস্কারায় এগুলো হচ্ছে। শুধু মাত্র ফেসবুক পোস্ট কে কেন্দ্র করে বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে, লুটপাট করা হচ্ছে। এমন হাজারো ঘটনা রয়েছে। এই ঘটনা গুলো কেনো ঘটছে তা খুঁজে বের করে সমাধান করা দরকার।
বঙ্গবন্ধু নিজেই ভারতবর্ষ ভাগের পর সৃষ্ট দাঙ্গা এবং ৬৪’ র দাঙ্গা প্রতিরোধে মূখ্য ভূমিকা পালন করছিলেন। তিনি শুধু বিবৃতি দিয়ে বসে থাকেননি। তার লোকজন নিয়ে এলাকায় এলাকায় গিয়ে দাঙ্গা প্রতিরোধ করেছেন। হামলার শিকারও হয়েছেন। এখনকার কয়জন নেতা মাঠে নেমে দাঙ্গা প্রতিরোধ করে?
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, গত ৯ বছরে এই দেশে ৩ হাজার ৬ শ’ ৮৯ বার সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর হামলা হয়েছে। এটা প্রকাশিত তথ্যের কথা, প্রকৃত সংখ্যা আসলে আরও অনেক বেশি।
অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবুল বারকাতের মতে, ধর্মীয় লেবাসের আওতায় থেকে হিন্দুদের সম্পত্তি দখল করে আছে রাজনৈতিক নেতারা। কাজেই রাজনীতি এই সংঘাতের মূল কারণ। হিন্দুসমর্থিত দলকে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্যে এই সংঘাত ঘটানোর কারণ এই তত্ত্ব বোধ হয় উপরিভাসা অতি সরলীকরণ।
হিন্দুদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দূর্গা পূজার ছুটি বৃদ্ধির জন্য বহুদিন ধরে বলা হলেও এবিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সরকার। বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে পূজার দিনেও পরীক্ষা থাকে। এতে হিন্দু সম্প্রদায়ের শিক্ষার্থীদের মনে বিরূপ প্রভাব বিস্তার করছে।
২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বলেছিলো তারা আবার ক্ষমতায় এলে সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের দ্রুত বাস্তবায়ন পার্বত্য চুক্তি ও পার্বত্য ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনের দ্রুত বাস্তবায়ন। সম্প্রতি বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত এবিষয়ে কথা বলেছেন এবং দাবি আদায়ে আন্দোলন ও অনশনের কথা বলেছেন। দেশের ৬টি প্রশাসনিক বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি হিন্দু জনসংখ্যা চট্টগ্রাম বিভাগে (১৬.৬৫ শতাংশ), তারপর সিলেট বিভাগে (১৩.৫ শতাংশ), রংপুর বিভাগে (১২.৯৮ শতাংশ) ও খুলনা বিভাগে ১১.৫ শতাংশ। ঢাকা বিভাগে ৪.৯৭ শতাংশ ও রাজশাহি বিভাগে ৫.৮৫ শতাংশ। বাংলাদেশের হিন্দুরা সবসময়ই আওয়ামী লীগের উপর ভরসা করে এসেছে। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এই ভরসা অনেকটা নষ্ট হয়ে গেছে।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের হারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিন্দুদের ভোটকেন্দ্রে আনতে না পারা। দেশের ৩০০ আসনের মধ্যে প্রায় ৮০-১০০ টি আসনে জয়ের নির্ধারক হিন্দুরা। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা বর্তমানে মনে করেন যে তারদের অধিকাংশ ভোট আওয়ামী লীগের বাক্সে যায় কিন্তু আওয়ামী লীগ তাদের অধিকার বাস্তবায়ন করে না। আবার অন্য দলেরাও জানে যেহেতু তারা এদের ভোট খুব বেশি পায়না তাই তারাও খুব একটা গুরুত্ব দেয় না। ফলে তারা বঞ্চিত হচ্ছে। বর্তমান সরকারের উচিত তাদের নিজের ভালোর জন্য সংখ্যালঘুদের অধিকার বাস্তবায়ন করা। তা নাহলে ভবিষ্যতে বড় কোনো সমস্যা হতে পারে। আর বিভিন্ন দল থেকে আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারীদের কতৃক সংখ্যালঘু নির্যাতনের দায়ও তাদের মাথায় পড়বে। সেজন্য ওই সব লোকদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
পূর্বের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা বলে নির্বাচন আসলে সংখ্যালঘুদের টার্গেট করে কিছু গোষ্ঠী তাদের উদ্দেশ্য সফল করার চেষ্টা করে। সামনে সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দূর্গা পূজা। তাই শুধু পূজাকে কেন্দ্র করে নয়, নির্বাচনের আগে পরে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে সরকারের। এবং নিজেদের সুবিধার জন্য হলেও সংখ্যালঘুদের অধিকার বাস্তবায়ন করবে এটাই কাম্য।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
সারাবাংলা/এজেডএস