Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিপ্লবী প্রীতিলতা: সংকটে সংগ্রামে প্রজন্মের প্রেরণা

ইমরান ইমন
২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৪:৫০

বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের আত্মদানকারী প্রথম নারী। ২৪ সেপ্টেম্বর এ বীরকন্যার আত্মাহুতি দিবস। এবছর প্রীতিলতার ৯১তম আত্মাহুতি দিবস। ১৯১১ সালের ৫ মে চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার ধলঘাট গ্রামে এ বীরকন্যা জন্মগ্রহণ। তার বাবার নাম জগবন্ধু ওয়াদ্দেদার। তিনি চট্টগ্রাম মিউনিসিপাল অফিস কর্মকর্তা ছিলেন। তার মায়ের নাম প্রতিভা ওয়াদ্দেদার। ছয় ভাইবোনের মধ্যে প্রীতিলতা ছিল দ্বিতীয় সন্তান। তার পারিবারিক ডাকনাম ছিল ‘রাণী’। ছদ্মনাম ছিল ‘ফুলতার’।

বিজ্ঞাপন

১৯১৮ সালে প্রীতিলতার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শুরু হয়। চট্টগ্রামের ডা. খাস্তগীর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে তার শিক্ষাজীবন শুরু হয়। প্রীতিলতা অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা শুরুই হয়েছিল তৃতীয় শ্রেণী থেকে। ১৯২৬ সালে তিনি মেধা তালিকায় বৃত্তি লাভ করেন। তিনি ডা. খাস্তগীর উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় থেকে ১৯২৭ সালে লেটার মার্কসহ ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। এরপর উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে লেখাপড়ার জন্য তিনি ভর্তি হন ইডেন মহিলা কলেজে। ১৯২৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মিলিত মেধা তালিকায় পঞ্চম স্থান এবং মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে আইএ পাস করেন প্রীতিলতা। এরপর প্রীতিলতা কলকাতার বেথুন কলেজে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৩২ সালে তিনি দর্শনে স্নাতক পাস করেন। ১৯৩২ সালে চট্টগ্রামে ফিরে এসে তিনি নন্দনকানন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের (যা বর্তমানে অপর্ণা চরণ সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় নামে পরিচিত) প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেন।

বিজ্ঞাপন

স্বদেশী আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রীতিলতাই প্রথম নারীবিপ্লবী। প্রীতিলতা যখন বিপ্লবী দলের সদস্য হতে চাইছিলেন তখন মাস্টার দা সূর্য সেন ছিলেন পলাতক। প্রীতিলতার ভীষণ ইচ্ছা ছিল মাস্টারদার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার। প্রীতিলতার প্রবল আগ্রহে এবং বহু চেষ্টার পর ১৯৩২ সালের মে মাসে মাস্টার দা সূর্য সেনের সঙ্গে তার দেখা হয়। পরবর্তীতে স্বদেশী আন্দোলনের সর্বাধিনায়ক মাস্টার দা সূর্য সেন প্রীতিলতার দায়িত্ববোধ, সাহসিকতা ও চারিত্রিক দৃঢ়তায় সন্তুষ্ট হয়ে তাকে পাহাড়তলীতে অবস্থিত ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ অভিযানের নেতৃত্বদানকারী হিসেবে নিযুক্ত করেন।

দলের প্রস্তুতিপর্ব শুরু করে দেওয়া হল। অভিযান সফল করার লক্ষ্যে তাদের অস্ত্রচালনা প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। আট সদস্য বিশিষ্ট এই দলের দলপতি ছিলেন প্রীতিলতা। তিনি ছাড়াও এ দলের বাকি সাতজন হলেন—বিপ্লবী কালিকিংকর দে, শান্তি চক্রবর্তী, বীরেশ্বর রায়, প্রফুল্ল দাস, সুশীল দে, মহেন্দ্র চৌধুরী এবং পান্না সেন। প্রীতিলতার নেতৃত্বে এই অভিযান শুরু করা হয় ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর রাত ১০টায়। সেদিনের বিপ্লবীদের এই অভিযান সফল হয়েছিল। নিয়মে আছে, সামরিক কায়দায় আক্রমণের সময় নেতা থাকবে সবার আগে এবং ফেরার পথে সাথীদের নিরাপদে সরে যাওয়ার সুযোগ করে দিয়ে নেতা ফিরবে সবার পরে। এই নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন প্রীতিলতা। অভিযান সফল হওয়ার পর হুইসেল বাজিয়ে সদস্যদের ফিরে যাওয়ার ইঙ্গিত দেন তিনি। পরবর্তীতে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন প্রীতিলতা। কিন্তু শেষ মুহূর্তে আত্মগোপনকারী এক ইংরেজ সৈনিকের গুলিতে বিদ্ধ হন প্রীতিলতা। ইতোমধ্যে দলের অন্যান্য সকল সদস্য নিরাপদ স্থানে পৌঁছে যেতে সক্ষম হয়েছেন।

দলের সকল সদস্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পরই প্রীতিলতা তার সঙ্গে বহন করা ‘পটাশিয়াম সায়ানাইড’ পান করে আত্মাহুতির পথ বেছে নেন। যাতে ইংরেজসৈন্যরা তাকে জীবিত অবস্থায় মারতে না পারে। এখানে উল্লেখ্য, পূর্বেই নির্দেশ ছিল যেকোনো অবস্থাতেই শত্রুর হাতে জীবিত অবস্থায় ধরা দেওয়া যাবে না। আহত অবস্থায় যাতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীশক্তি তাকে জীবিত ধরে ফেলতে না পারে সে জন্য তিনি পূর্বনির্দেশের প্রতি অবিচল থেকে সায়ানাইড বিষপান করে আত্মাহুতি দেন। প্রীতিলতা প্রমাণ করেছেন মাস্টার দা সূর্য সেনের সিদ্ধান্ত একদম সঠিক ছিল, প্রীতিলতা এই অভিযানের যোগ্য নেতৃত্বদানকারী ছিলেন। পরদিন ২৪ সেপ্টেম্বর ভোরে ব্রিটিশ পুলিশ প্রীতিলতার মৃতদেহ খুঁজে পেতে সক্ষম হয়। একজন নারীকে আক্রমণকারী হিসেবে শনাক্ত করে তারা হতভম্ব হয়ে যায়।

৮০ বছর পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের দুই প্রাক্তন শিক্ষার্থী, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেত্রী বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও বীণা দাসকে মরণোত্তর স্নাতক ডিগ্রি প্রদান করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে পাওয়া তথ্যমতে, বিপ্লবীদের প্রতি সম্মান জানাতেই এই মরণোত্তর ডিগ্রি প্রদান করা হয়েছে। ২০১২ সালের ২২ মার্চ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে এই ডিগ্রি দেওয়া হয়। রাজ্য সরকারের পক্ষে এই ডিগ্রির সনদ গ্রহণ করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য এবং তিনি তা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেন। এই সনদ বিশ্ববিদ্যালয়েই সংরক্ষণ করা হয়।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ১৯৩২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও বীণা দাস এই দুইজনেরই স্নাতক ডিগ্রী পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এর পূর্বেই প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার চট্টগ্রামের অস্ত্রাগার লুঠ করে ব্রিটিশ সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াইতে যোগ দেন ও পরে পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে দীর্ঘদিন আত্মগোপনে ছিলেন। ফলে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে কৃতিত্বের সাথে স্নাতক পাস করলেও সেদিন এই দুইজনের কারোরই স্নাতক ডিগ্রি নেওয়া হয়নি।

পরবর্তীতে ১৯৩২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারীর সমাবর্তন অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের প্রশংসাপত্র দিতে হাজির হওয়া তৎকালীন গভর্নর এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য স্ট্যানলি জ্যাকসন। হঠাৎ জ্যাকসনকে লক্ষ্য করে গুলি করেন ২০-২১ বছরের এক তরুণী। এই তরুণীই বীণা দাস। তিনি চেয়েছিলেন চট্টগ্রামে বিপ্লবীদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে। মঞ্চ থেকে লাফিয়ে নেমে তৎকালীন বাংলার প্রধানমন্ত্রী ও উপাচার্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ধরে ফেললেন সে তরুণীকে। তখনও গুলি চালিয়ে যাচ্ছে সে। সেদিনের সেই তরুণীই ছিলেন বীণা দাস। ইতিহাসের একটি সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে, ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা যুদ্ধের বীরযোদ্ধা বীণা দাস চুলের খোঁপার মধ্যে রিভলবার লুকিয়ে সমাবর্তন কক্ষে ঢুকেছিলেন সেদিন। স্ট্যানলি জ্যাকসনকে লক্ষ্য করে পরপর পাঁচটি গুলি চালিয়েছিল বীণা। তবে স্ট্যানলি জ্যাকসন সম্পূর্ণ অক্ষত ছিলেন কারণ সবকটি গুলিই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছিল এবং চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে যাওয়ায় সেখান থেকেই গ্রেপ্তার করা হয় বীণা দাসকে।

চট্টগ্রাম নগরীর পাহাড়তলিতে তৎকালীন ইউরোপিয়ান ক্লাব বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় প্রকৌশলীর কার্যালয়। এই ইউরোপিয়ান ক্লাবের সামনেই স্থাপিত হয়েছে ‘বীরকন্যা প্রীতিলতা’ স্মারক ভাস্কর্য। এটি উদ্বোধন করা হয়েছে ২০১২ সালের ২ অক্টোবর। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ‘বীরকন্যা প্রীতিলতা’ স্মারক ভাস্কর্য স্থাপনের পূর্বে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় প্রকৌশলীর কার্যালয়ে পাহাড়তলি রেলওয়ে স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র সমিতির দেওয়া একটি ‘স্মৃতি ফলক’ এবং ইউরোপিয়ান ক্লাবসংলগ্ন পাহাড়তলি সাবপোস্ট অফিসের সামনের সড়ক দ্বীপে একটি স্মৃতিস্মারক ছাড়া আর কোনো কিছু নেই এই বীরকন্যার স্মরণে। তবে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ধলঘাটে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নিজগ্রামে তার একটি আবক্ষ মূর্তি রয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রীতিলতার নামে রয়েছে আবাসিক হল।

সাম্প্রতিককালের কথা, প্রীতিলতার আত্মাহুতি দিবসে একটি প্রতিবেদন দেখানো হচ্ছিল একটি টেলিভিশন চ্যানেলে। সেখানে দেখা যায়, এ প্রজন্মের বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে বিপ্লবী প্রীতিলতার নাম জানেন না! কেউ নাম শুনলেও তার সম্পর্কে বিস্তারিত কিছুই জানেন না। আরও অবাক করার ব্যাপার এই যে, তার নিজের জেলার মানুষের কাছেও তিনি প্রায় অপরিচিত। দুঃখজনক হলেও এটি সত্য যে, প্রীতিলতা যেসব স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করেছিলেন সেখানকার শিক্ষার্থীরাও ঠিকভাবে জানেন না প্রীতিলতার বীরত্বের কথা।

বর্তমান প্রজন্ম প্রীতিলতা সম্পর্কে জানে না—এটি একটি লজ্জাকর ব্যাপার। এটি প্রজন্মের জন্য, দেশের জন্য অশনিসংকেত! বর্তমান প্রজন্ম কীভাবে বেড়ে ওঠছে—তা এ দৃশ্যগুলো থেকে সহজেই প্রতীয়মান। তারা বইপড়ায়, ইতিহাসচর্চায়, জ্ঞানচর্চায় নেই। তাই দেশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস তারা জানেন না। দেশপ্রেমিক বিপ্লবী এই মানুষগুলোর নামও এখন তাদের কাছে দুর্বোধ্য। বাধ্য হয়ে পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার আশায় তাদের ইতিহাস সম্পর্কে একটু জানতে হয়, এগুলো আবার তারা পরের বছর নতুন বই আর নতুন পড়ার ভিড়ে ভুলে যান। তবুও এখনও অনেকে আছেন, যারা ব্যক্তিগত ইচ্ছায় ইতিহাস সম্পর্কে জানতে ইচ্ছুক। তারা অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার বাইরে বইপড়ায়, ইতিহাসচর্চায়, জ্ঞানচর্চায় নিজেদের নিয়োজিত রাখেন। কিন্তু সে সংখ্যাটা খুবই নগণ্য। দিনদিন প্রজন্মের মাঝে বইপড়ার অভ্যাস হারিয়ে যাচ্ছে। তারা শুধু অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার গন্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বাইরের জীবন-জগত সম্পর্কে তাদের ধারণা নেই। শুধু পরীক্ষায় ভালো করার জন্যই বাধ্য হয়ে তারা এখন পড়াশোনা করেন।

বর্তমান প্রজন্মকে সৃজনশীল কোনো কাজে জড়িত থাকতে কিংবা সৃজনশীলতা চর্চা করতে তেমনভাবে দেখা যায় না। কিন্তু এভাবে একটি প্রজন্ম বেড়ে ওঠতে পারে না। প্রজন্মকে হতে হবে জ্ঞানে-গুণে-মানে সবদিক থেকে সমৃদ্ধ। তাদের হতে হবে ইতিহাস ও অধিকার সচেতন। তরুণ প্রজন্ম একটা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মানবসম্পদ। তাদেরকে সঠিকভাবে যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলতে না পারলে একটা রাষ্ট্রের সুষম উন্নয়ন কোনভাবেই সম্ভব নয়।
প্রীতিলতাসহ অন্যান্য সকল বিপ্লবীদের বীরত্বগাঁথা ইতিহাস আমাদের জানতে হবে। আর এজন্য ইতিহাস পড়তে হবে, চর্চা করতে হবে, গবেষণা করতে হবে।

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে আত্মদানকারী প্রথম নারী বীরকন্যা প্রীতিলতার এবছর ৯১তম আত্মাহুতি দিবস। প্রীতিলতার মতো এমন বিপ্লবী দেশপ্রেমিক ফিরে আসুক যুগে যুগে শতবার। জাতির ক্রান্তিকালে প্রীতিলতার মতো বীরকন্যাদের বড়োই প্রয়োজন। বীরকন্যা প্রীতিলতার দুঃসাহসী মনোভাব, সংগ্রামীজীবন ও দেশপ্রেমিক চেতনা সংকটে সংগ্রামে প্রজন্মের জন্য প্রেরণার প্রতীক।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

ইমরান ইমন বিপ্লবী প্রীতিলতা: সংকটে সংগ্রামে প্রজন্মের প্রেরণা মুক্তমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর