বাংলাদেশের ওপর আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা ও প্রাসঙ্গিক কথা
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৫:৩১
সম্প্রতি আমেরিকার নিষেধাজ্ঞার বিষয় ‘হট কেক’ ও ‘টক অব দ্য কান্ট্রিতে’ পরিণত হয়েছে। প্রথমে এই নিষেধাজ্ঞা শুধু রাজনৈতিক ব্যক্তি, আমলা ও প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের ওপর আরোপিত হলেও এখন নতুন করে যুক্ত হয়েছে গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমকর্মীরা। বাংলাদেশের কিছু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, ক্ষমতাসীন দলের সদস্য ও রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে কতজনের ওপর এই বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, তা পরিষ্কার করেনি মার্কিন দূতাবাস। ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের মুখপাত্র ব্রায়ান শিলার বলেছেন, ‘আমরা যখন এই ভিসা নীতি ঘোষণা করেছি, তখন থেকেই যুক্তরাষ্ট্র সরকার ঘটনাবলির ওপর গভীর দৃষ্টি রাখছে। সতর্কতার সঙ্গে তথ্য-প্রমাণ পর্যালোচনার পর আমরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, ক্ষমতাসীন দলের সদস্য ও রাজনৈতিক বিরোধীদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করেছি।’
মার্কিন দূতাবাসের মুখপাত্রকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ভিসা বিধিনিষেধের আওতায় আসা ব্যক্তিদের নাম যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ করবে কি না। জবাবে তিনি বলেন, ‘না, এসব ভিসা বিধিনিষেধের আওতায় আসা ব্যক্তিদের নাম আমরা প্রকাশ করব না।’ কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আইনে ভিসা রেকর্ড গোপনীয়।
ব্রায়ান শিলার এই কথা বলার ঘণ্টাখানেক আগে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে এ বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলারের ওই বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আজ (শুক্রবার) স্টেট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত থাকা বাংলাদেশি ব্যক্তিদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করার পদক্ষেপ নিচ্ছে। এ ব্যক্তিদের মধ্যে আইন প্রয়োগকারী, ক্ষমতাসীন দল এবং রাজনৈতিক বিরোধী দলের সদস্য রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন যাতে শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয় তার সমর্থনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এই ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে প্রমাণিত অতিরিক্ত ব্যক্তিরাও ভবিষ্যতে এই নীতির অধীনে মার্কিন ভিসার জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হতে পারে। এর মধ্যে বর্তমান এবং প্রাক্তন বাংলাদেশী কর্মকর্তা, বিরোধী ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সদস্য এবং আইন প্রয়োগকারী, বিচার বিভাগ এবং নিরাপত্তা পরিষেবার সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।’
কারা কারা নতুন করে এই নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত হবেন, সেটি নিয়ে জল্পনাকল্পনার শেষ নেই। কিছুদিন আগে নাইজেরিয়ার ওপরও নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। নাইজেরিয়ার ক্ষেত্রে শুধু সেসব ব্যক্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যারা কোনো না কোনোভাবে নির্বাচনী অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই নতুন নিয়মের আওতায় পড়বেন, এমন ব্যক্তির সংখ্যা এত বিস্তৃত যে বিস্মিত হতে হয়। সরকার, বিচার বিভাগ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য—সবাই ভিসা না পাওয়ার তালিকায় রয়েছেন। ইতঃপূর্বে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ র্যাবের কতিপয় শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। এবার বিচার বিভাগের সদস্যদেরও এই তালিকায় আওতাভুক্ত করা হলো। এ থেকে ধারণা করা যায়, যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, নির্বাচনী অনিয়মের সঙ্গে শুধু সরকারি কর্তাব্যক্তিরা নন, বিচার বিভাগের সদস্যরাও সংশ্লিষ্ট থাকতে পারেন।
এটা যদি নতুন কোনো নিষেধাজ্ঞা না হয়, তা হলো ঘটা করে এমন আগাম ঘোষণা দেওয়ার কী প্রয়োজন পড়ল? বলা যায়, এই ঘোষণার মাধ্যমে মার্কিন সরকার ঢাকাকে একটি আগাম বার্তা দিতে চায় যে নির্বাচনে যদি বড় ধরনের অনিয়ম ঘটে, তাহলে ওয়াশিংটন কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারে।
বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সূচকে উল্লেখযোগ্যভাবে পিছিয়ে পড়ছে–এমন উদ্বেগবার্তা যুক্তরাষ্ট্রে বেশ আগে থেকেই বাংলাদেশকে দিচ্ছে। এমনকি সার্বিক অবস্থার পরিবর্তন না হলে ব্যবস্থাও নেওয়া হবে, সে কথাও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সাম্প্রতিককালের গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ না দেওয়া সে ঘটনার একটি নজির ছিল। বলা যেতে পারে, আগাম বলে দেওয়া সে ‘ব্যবস্থার’ অংশ। পরপর দুই বছর এই সম্মেলনে ডাক না পাওয়াতে বাংলাদেশ শুধু অবহেলিত নয়, অপমানিতও বোধ করেছে। কিন্তু সেখান থেকে বাংলাদেশ কোনো শিক্ষা নেয়নি।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন রাজনীতিবিদ, আমলারা ও প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রে সম্পত্তির মালিক। অনেকের পুত্র-কন্যা সেখানে উচ্চশিক্ষায় নিয়োজিত। সেসব ব্যক্তিবর্গ যদি যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণের সুযোগ হারান, তাহলে সেটি রীতিমতো অবমাননাকর, সম্পত্তি হাতছাড়া হলে তো আরও ভয়ের কারণ। র্যাবের ওপর যাতে এই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়, সে জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে নানাভাবে দেনদরবার করা হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন নিজেও এ ব্যাপারে মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেটের সঙ্গে কথা বলেছেন, তা আমরা জানি। মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কাছে বাংলাদেশের ‘ইমেজ’ সাফসুতরো করতে একটি লবিং ফার্ম নিয়োগ করা হয়েছে, তাও অজানা নয়। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। উল্টো নতুন নতুন নিষেধাজ্ঞা আসছে। সবশেষে এসেছে গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর।
মূলত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে গত ডিসেম্বরে মানবাধিকার বিষয়ক একটি প্রোগ্রামে যাওয়াকে কেন্দ্র করে পাকড়াও ও গোলযোগের ঘটনায় মার্কিন অ্যাম্ব্যাসি ক্ষেপে ওঠে বাংলাদেশের ওপর। এরপর থেকে ঘটমান বিভিন্ন ঘটনার নজির কারও অজানা নয়। সেদিন কারা কী উদ্দেশ্যে ভদ্রলোক পিটার হাসের সঙ্গে এমন ঘটনা ঘটিয়েছে—সে প্রশ্ন না ওঠে পারে না। দেশে আজকের এই কঠিন পরিস্থিতির জন্য কিন্তু সেদিনটিই দায়ী!
শেষমেশ নিষেধাজ্ঞায় গণমাধ্যমের বিষয়টি খুব কৌশলেই যুক্ত করেছে মার্কিন অ্যাম্ব্যাসি। সর্বশেষ নির্বাচনে গণমাধ্যমের “ঘুঁটির চাল” বদলে দিয়েছিল তৎকালীন পুরো প্রেক্ষাপট!
নিষেধাজ্ঞার আওতায় গণমাধ্যমের বিষয়টিকে অমূলক বলার অবকাশ নেই। যে গণমাধ্যম রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হয়ে গণমানুষের অধিকারের পক্ষে কথা বলবে—সে গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমকর্মীরা যখন ব্যক্তিগত স্বার্থ সিদ্ধিতে নিয়োজিত থেকে দেশের কথা, দেশের মানুষের কথা বলা ভুলে যায়—গণমাধ্যমের প্রকৃত উদ্দেশ্য থেকে সরে যখন গণমাধ্যমকে সেলফ-সেন্সরশিপ, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল, আক্রমণ-কাউন্টার দেওয়া, অনিয়ম, দুর্নীতি ও ধান্দাবাজির প্লাটফর্ম বানায়—তখন এ ধরনের নিষেধাজ্ঞাকে অযৌক্তিক বলার কোনো সুযোগ নেই। এরপরও কি আমাদের টনক নড়বে? আমাদের গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমকর্মীরা কি গণমাধ্যমের সঠিক পথে চলবেন?
ইতিহাস বিশ্লেষণ করে বলা যায়, মোড়লরাষ্ট্র আমেরিকার সঙ্গে বাড়াবাড়ি করা কারোরই পরিণতি ভালো হয়নি। ইতিহাসের পাতা ওলটালে আমরা দেখি, এক সাদ্দামের কারণেই কিন্তু ইরাক ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়েছিল। এদেশের সবারই স্বপ্নের দেশ আমেরিকা। এদেশের রাজনীতিবিদ, আমলারা দেশ থেকে লুটপাট করে আমেরিকায় সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন—আমেরিকায় বানান ‘সেকেন্ড হোম’। নিষেধাজ্ঞা ইস্যুতে মুখে এক কথা বললেও ভেতরে ভেতরে কিন্তু কাঁপাকাঁপি চলমান। এদেশের রাজনীতিবিদ, আমলারা নিজেদের ছেলে-মেয়েদেরও নিজ দেশে না পড়িয়ে আমেরিকায় পড়ান। কিন্তু কেন? কেউ কি সেসব প্রশ্ন তোলেন?
লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট; ফিচার সম্পাদক, দৈনিক ফেনী
সারাবাংলা/এজেডএস
ইমরান ইমন বাংলাদেশের ওপর আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা ও প্রাসঙ্গিক কথা