প্রতিবন্ধীদের জন্য সরকার কী করেছে
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৭:৩৩
সময়ের কারণে বাংলাদেশ বলে কথা নয়, পৃথিবীজুড়ে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা বাড়ছে। আর প্রতিবন্ধী ব্যক্তি মানেই বোঝা, তা এখন আর সত্য নয়। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির বিশ্ব জয় করার উদাহরণ যথেষ্ট। বাংলাদেশেও এ শ্রেণির মানুষ এগিয়ে যাচ্ছে। তবে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন দরকার। প্রতিবন্ধী হলেই তিনি কিছু পারবেন না, এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তাদের জন্য সম্মিলিতভাবে জায়গা অবারিত করে দিতে হবে। এর বড়ো কারণ হলো একজন ব্যক্তি যদি পরিবারে বোঝা হয় আস্তে আস্তে সে সমাজের বোঝা হিসাবে পরিণত হয়। তাকে আলোর দিকে নিয়ে যেতে পারলে মঙ্গল সবার জন্যই। ব্যক্তি নিজেও তখন মানসিক শক্তি পায়। অন্যদের ক্ষেত্রে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়।
সব মিলিয়ে যদি বলি, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি কখনোই সমাজের বোঝা নয়। তাদের সম্পদে পরিণত করার দায়িত্ব সবার। সে কাজটি এখন পরিবার থেকে সমাজ তথা সর্বোপরি রাষ্ট্র করছে। রাষ্ট্র এগিয়ে আসা মানেই সমাজের সবার চোখ খুলবে, তারাও এগিয়ে আসবে। আস্তে আস্তে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ব্যাপারে সবাই আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করবে এমন বিশ্বাস রয়েছে।
মূল কথা হলো, অদম্য ইচ্ছা আর কঠিন অধ্যবসায় থাকলে প্রতিবন্ধিতাও কাউকে আটকে রাখতে পারে না। এমন সফল উদাহরণ গোটা দুনিয়ায় অসংখ্য। প্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়েও মার্কিন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেছেন। বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ পদার্থবীদ স্টিফেন হকিং স্নাতকোত্তর পড়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন। হাতের আঙুল ছাড়া আর কিছুই কাজ করে না তার। তবুও তিনি থেমে থাকেননি। দেড় বছর বয়সে বাক্-দৃষ্টি-শ্রবণশক্তি হারান হেলেন কেলার। পরে লেখিকা ও সমাজকর্মী হিসাবে দুনিয়াজুড়ে খ্যাতি লাভ করেন।
নিকোলাস জেমস ভুজিকিকের জন্ম থেকে শরীরের নিচের অংশ সংকুচিত। বিরল রোগ ফোকোমেলিয়া নিয়ে তিনি বিশ্বের অন্যতম সেরা মোটিভেশনাল স্পিকার। অন্ধ কবি হিসাবে জন মিল্টন বিশ্বখ্যাত।
ইতোমধ্যে সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়াধীন শারীরিক প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছে। মৈত্রী শিল্প প্রতিবন্ধীবান্ধব একটি প্রতিষ্ঠান হিসাবে এই ট্রাস্টকে গড়ে তোলা হচ্ছে। এ প্রতিষ্ঠানের আওতায় দেশসেরা বোতলজাত বিশুদ্ধ মুক্তা পানি ও মৈত্রী প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন ও বিপণন করা হয়। এ উৎপাদন ও বিপণন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত রয়েছেন, তাদের সিংহভাগই প্রতিবন্ধী। এ প্রতিষ্ঠানের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দ্বারা উৎপাদিত মুক্তা বোতলজাত বিশুদ্ধ পানি ও মৈত্রী প্লাস্টিক পণ্যের বিক্রয়লব্ধ সমুদয় আয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তির কল্যাণেই ব্যয় করা হয়ে থাকে। সত্যিই এ ধরনের উদ্যোগ প্রশংসার দাবি রাখে। একসময় দেখা যাবে, বেসরকারি খাতেও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিয়ে এ ধরনের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের পথচলা শুরু হয়েছে।
সবচেয়ে বড়ো বিষয় হলো, মহামারি করোনা পরিস্থিতি এবং চলমান ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বাংলাদেশ তথা গোটা বিশ্বকে আর্থিক চরম মন্দার মধ্যে ফেলেছে। তেমনই দেখা দিয়েছে খাদ্যসংকট। বাংলাদেশে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে সবার অসন্তুষ্টি রয়েছে। এর মধ্যে একটি পরিবারে যদি একাধিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি থাকেন আর তারা যদি কর্মহীন হন, তাহলে সত্যিই তারা পরিবারের জন্য বোঝা। একজন অভিভাবকের পক্ষে এই বোঝা ধারাবাহিকভাবে টেনে নিয়ে যাওয়া অনেক কঠিন কাজ। এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধী ব্যক্তি যদি কর্মে নিয়োজিত থাকেন, তাহলে নিজেও মানসিকভাবে ভালো থাকেন এবং পরিবার ও সমাজের কাছে করুণার পাত্র হয়ে তাকে বাঁচতে হয় না। এর মধ্যে যারা কর্মের অনুপযোগী, তাদের সামাজিক সুরক্ষা খাত প্রসারিত করে নিজের মতো করে বাঁচার স্বাধীনতা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জীবনমান উন্নয়ন ও অধিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতি তাঁর মানবিকতাবোধ থেকে সরকার মৈত্রী শিল্পের আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণে ১৯৯৭ সালে ‘শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য শিল্প উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন’ শীর্ষক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। এছাড়াও বিগত ১৩ বছরে (২০০৯-২০২১) প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জীবনমান উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর অনুশাসন অনুযায়ী মৈত্রী শিল্পের আমূল পরিবর্তন ও সংস্কারের মধ্য দিয়ে শারীরিক প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্ট, মৈত্রী শিল্প আজ রুগ্ণ শিল্প থেকে প্রতিবন্ধীবান্ধব একটি লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। গর্বের সঙ্গে বলতেই হবে, এটি সরকারের একটি বড়ো রকমের সফলতা। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমাজে কর্মক্ষম হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এক্ষেত্রে তাদের দিয়ে একটি প্রতিষ্ঠান লাভজনক করা সত্যিই বড়ো ধরনের সফলতা বলতে কোনো দ্বিধা নেই। এতে প্রমাণ হয়, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সুযোগ নিশ্চিত করা গেলে তারাও ভালো কিছু করে দেখাতে পারেন।
মৈত্রী শিল্পের বর্তমান উৎপাদন কার্যক্রম দুটি ভাগে বিভক্ত। এর একটি মুক্তা ড্রিংকিং ওয়াটার। সরকারি সহায়তায় মৈত্রী শিল্পের উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন প্রকল্পের আওতায় মুক্তা ড্রিংকিং ওয়াটার প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়। আমেরিকান বিশ্ববিখ্যাত ওয়াটার পিউরিফিকেশন অ্যান্ড বোটলিং প্ল্যান্ট মেশিনারিজ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ইউনিভার্সাল অ্যাকুয়াম্যান টেকনোলজিস ইনকরপোরেট থেকে আমদানিকৃত মুক্তা ড্রিংকিং ওয়াটার প্ল্যান্ট। মুক্তা বোতলজাত সুপেয় পানি অত্যাধুনিক মেশিন দ্বারা ১১টি ধাপে ‘রিভার্স অসমোসিস পদ্ধতিতে’ পরিশোধিত হয়। উৎপাদন কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের সার্বক্ষণিকভাবে হাইজেনিক চেক, পরিষ্কার-পচ্ছিন্নতা ও স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করা হয়। প্রতি ব্যাচে উৎপাদিত মুক্তা বোতলজাত সুপেয় পানি ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা ও গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়ে থাকে। মুক্তা বোতলজাত বিশুদ্ধ পানির মিনারেল কম্পোজিশন বাজারে প্রচলিত অন্যান্য বোতলজাত পানির তুলনায় ভারসাম্যপূর্ণ, যা মানবদেহের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত।
অপরটি মৈত্রী প্লাস্টিকসামগ্রী। মৈত্রী শিল্পে প্লাস্টিকসামগ্রী উৎপাদন বিভাগে দৈনন্দিন ব্যবহার্য ৯৭টি প্লাস্টিক পণ্য যেমন: গামলা জগ, মগ, থালা, বাটি, বিভিন্ন সাইজের ঢাকনাযুক্ত কনটেইনার, ডাবল কালার স্যুপ বাটি, কোট হ্যাংগার, টিফিন বক্স, ওয়েট পেপার বাস্কেট, প্লাস্টিক ট্রে, বেবি বাস্কেট তৈরিসহ প্লাস্টিক পণ্য যেমন: চায়ের কাপ, টি-স্পুন, স্বচ্ছ গ্লাস, ডিনার ট্রে, সালাদ/ডেজার্ট বাটি তৈরি করা হচ্ছে। বিভিন্ন ধরনের কম্পিউটারাইজড সেমি-অটোমেটিক মেশিনের মাধ্যমে এসব পণ্য তৈরি করা হয়, যা আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির দ্বারা উৎপাদিত এসব প্লাস্টিকসামগ্রী ‘মৈত্রী’ ব্র্যান্ড নামে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করা হচ্ছে।
মৈত্রী শিল্পের কাজ: প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সমাজের মূল স্রোতোধারায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য শিল্পবিষয়ক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তর করা। প্রতিবন্ধীদের আর্থসামাজিক সুরক্ষার লক্ষ্যে তাদের কর্মসংস্থান ও পুনর্বাসন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা। মৈত্রী প্লাস্টিক পণ্যসামগ্রী ও মুক্তা ন্যাচারাল ড্রিংকিং ওয়াটার উৎপাদন ও বিপণনের কাক্সিক্ষত মানে উন্নীতকরণের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা। প্রতিবন্ধী শিক্ষিত ব্যক্তিদের সামাজিক নিরাপত্তার অংশ হিসাবে ‘প্রতিবন্ধী মেধাবৃত্তি’ প্রদান। মৈত্রী শিল্পের উৎপাদিত প্লাস্টিক পণ্যসামগ্রী ও মুক্তা ন্যাচারাল ড্রিংকিং ওয়াটার সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানসহ সর্বস্তরের ভোক্তার মাঝে সরবরাহ নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী দেশে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির সংখ্যা ৪৬ লাখ, যা মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ৮ ভাগ। এর মধ্যে ৯৮ ভাগই বৈষম্যমূলক আচরণ ও নিগ্রহের শিকার। প্রতিবেশীদের ৯১ ভাগ অংশ তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। ১ দশমিক ৩৬ ভাগ সবচেয়ে বেশি শারীরিক প্রতিবন্ধী ব্যক্তি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রতিবন্ধী ভাতাভোগীর সংখ্যা করা হয়েছে ২৯ লাখ। তারা প্রতিমাসে ৮৫০ টাকা ভাতা পান।
মোদ্দা কথা হলো, সমাজের একটি বড়ো অংশ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে এগিয়ে চলা সম্ভব নয়। তাই তাদের জন্য আরও আন্তরিক হতে হবে। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় আনার পাশাপাশি আর্থিকভাবে এই শ্রেণির মানুষকে কাজে লাগানো জরুরি। তাহলেই আমরা প্রতিবন্ধিতা জয় করে এগিয়ে যেতে পারব।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই