বিমান হাইজ্যাকার লায়লা খালেদ ও ফিলিস্তিনিদের সংগ্রাম
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৬:৩৯
ফিলিস্তিনিরা সত্যিই ভাগ্যচ্যুত। তারা প্রায় এক শতক ধরে নিজেদের হাজার বছরের ভূখণ্ডে দখলদার ইহুদিদের সাথে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। ফিলিস্তিনের বহুপ্রজন্ম ঝরছেন রক্ত নিজেদের ভূ-খণ্ডের জন্য। লাশের স্তুপ আকাশ ছুয়েছে। ফিলিস্তিনিরা এখনো লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাবো, ফিলিস্তিন ছিল অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে। আরব মুসলমানেরা ছিল সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ। পৃথিবীর বুকে উনিশ শতকের শেষ দিকে ইহুদিদের একটি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠে। ইহুদি জাতির চোখ পড়ে আরব ভূখণ্ড ফিলিস্তিনের উপর। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা ইহুদিরা ফিলিস্তিনে এসে একত্রিত হতে থাকে। তাদের সংখ্যা ক্রমশই বাড়তে থাকে। হঠাৎ ফিলিস্তিনের বুকে ইহুদিদের জনসংখ্যা বাড়তে থাকার মূলে ছিল,নিজের একটি একক ভূ-খণ্ড তাই তারা আস্তে আস্তে ফিলিস্তিন দখল করে আবাসভূমি গড়ে তুলতে থাকে।
বিশ শতকের শুরুর দিকে অটোমান সাম্রাজ্য ভঙ্গুর হয়ে পড়লে এই সুযোগে ইউরোপীয় শক্তিগুলো তাদের প্রভাব বিস্তার করতে থেকে আরব ভূ-খণ্ডের উপর। স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সমর্থনের প্রতিশ্রুতি ও সহযোগিতার কথা দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অটোমানদের বিরুদ্ধে আরবদের বিদ্রোহে নামায় ব্রিটিশ শাসকেরা।শোনা যায় ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ইহুদিদেরও গোপনে আশ্বাস দেয় ব্রিটিশ শাসকেরা।
১৯১৭ সালে যখন ব্রিটিশ সরকারের পররাষ্ট্র সচিব আর্থার জেমস বেলফোর ঘোষণায় ফিলিস্তিনে ‘ইহুদিদের একটি জাতীয় বাসস্থান’ প্রতিষ্ঠায় সমর্থন জানায়। যখন আরব জনগণের বিদ্রোহের ফলে অটোমান সাম্রাজ্যের পতন হয়, তখন ফিলিস্তিনির ম্যানডেট পায় ব্রিটিশ শাসকেরা । ততদিনে ফিলিস্তিনে দলে দলে অভিবাসী ইহুদিরা জনবসতি গড়ে তুলতে থাকে। ফিলিস্তিনি ও আরব জনগণের বিরোধিতা সত্ত্বেও সেখানে তাঁরা বসতি গড়ে তোলে। বিরোধিতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য ১৯২০, ’২১, ’২৮, ’২৯ ও ’৩৬ সালে আরবদের সঙ্গে ইহুদিদের সংঘর্ষ হয়। এ সময় ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে।
১৯৩৩ সালে অ্যাডলফ হিটলার জার্মানির শাসক রূপে ক্ষমতায় এলে ইহুদিদের ওপর নিপীড়ন শুরু হয়।হিটলারের আগ্রাসন থেকে বাঁচতে সেখানকার ইহুদিরা পালিয়ে ফিলিস্তিনের দিকে অগ্রসর হয়। ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইহুদিদের তত্পরতা আরো বৃদ্ধি পায়। ব্রিটিশদের ষড়যন্ত্র যখন আরবেরা আঁচ করতে পারে তখন ব্রিটিশ শাসন ও ইহুদি দখলদারির বিরুদ্ধে ১৯৩৬-১৯৩৯ সালে সংঘটিত হয় আরব বিদ্রোহ। আরব বিদ্রোহ দমন করা হয়। নিহত হয় পাঁচ হাজার আরব সামরিক ও বেসরকারি জনগণ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফিলিস্তিন নিয়ে আরব ও ইহুদিদের মধ্যে বৈরিতা চরম আকার ধারণ করে। কুল কিনারা না পেয়ে ফিলিস্তিনের ওপর ম্যানডেট ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটিশ শাসকেরা। একই সঙ্গে এই ভূ-ভাগ্য নির্ধারণে সদ্যগঠিত জাতিসংঘকে অনুরোধ জানানো হয়।
১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ফিলিস্তিনিকে দ্বিখণ্ডিত পৃথক ইহুদি ও আরব রাষ্ট্রের পক্ষে ভোট দিয়ে ভাগ করা হয়। আরবদের বিরোধিতা সত্ত্বেও পরিকল্পনাটি এগিয়ে যায়। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের নীলনকশায় ইহুদিদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হয়।
১৯৪৮ সালের ১৪ মে ব্রিটিশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনির ম্যানডেট ছেড়ে দেয়। ওই দিনই ইহুদি নেতারা ইসরায়েল রাষ্ট্রের ঘোষণা দেন। পরদিন আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের যুদ্ধ বেধে যায়। ওই যুদ্ধে আরবরা পরাজিত হয়। উপরন্তু প্রস্তাবিত আরব রাষ্ট্রের একটা বড় অংশ দখল করে নেয় ইসরায়েল। সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনি শরণার্থী হয়ে যায়।
মিত্রদের সহযোগিতায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে ইসরায়েল। ষাটের দশকে পারমাণবিক বোমার মালিক বনে যায় ইসরায়েল । দখলদারি ও বর্বরতার মাত্র দিন দিন বাড়তে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের এক আগ্রাসী হিংস্র রাষ্ট্র হয়ে উঠে ইসরায়েল রাষ্ট্র, অন্যদিকে দখলদারত্বের নৃশংসতায় ফিলিস্তিনে রক্তের নদী বইতে থাকে। আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে আরও তিনটি যুদ্ধ হয়। এতে ফিলিস্তিনের ভাগ্যে রক্ত ঝরা ইতিহাস ছাড়া আর কিছুই জোটেনি।
আরব বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মুক্তির সংগ্রামের লক্ষ্যে ১৯৫০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে এটি আরব বিশ্বের ঐক্য ও সামাজিক অগ্রগতির জন্য আরব চেতনা বিপ্লবে অগ্রণী ভূমিকা নেবে এমন একটি জাতীয় সচেতন বুদ্ধিজীবী সমাজ গঠনের উপর জোর দেওয়ার নীতি নিয়ে গড়ে উঠে। আদর্শিকভাবে, এটি সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। এই সংগঠন টির আরব জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির অর্থ ছিল সাধারণভাবে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের প্রতি আপোষহীন বিরোধিতা ও সংগ্রাম। ফিলিস্তিনের মানুষের কাছে “পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন” নামে সংগঠনটি পরিচিত। বিপ্লবী সংস্থা পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইনের একজন সদস্য ছিলেন বিপ্লবী লায়লা খালেদ।
লায়লা খালেদ ছিলেন বিমান হাইজ্যাক অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত আসামী। লায়লাকে পরে তার সহকর্মীরা নাটকীয়তার মাধ্যমে মুক্ত করে আনেন। লায়লা খালেদের জন্ম ১৯৪৪ সালের ৯ এপ্রিল। লায়লা খালেদ জন্মগ্রহণ লায়লা খালেদ করেন হাইফা শহরে।
লায়লা ও তার পরিবার ১৯৪৮ সালে লেবাননে চলে আসেন। ছোটবেলা থেকে লায়লা তার বড় ভাইকে অনুসরণ করতেন। তার বড় ভাই ছিলেন ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্টের একজন অগ্রগামী সদস্য। বড় ভাইয়ের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে মাত্র ১৫ বছর বয়সে লায়লা যোগ দেন ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্টে। লায়লা খালেদ লাইমলাইটে আসেন ১৯৬৯ সালের ২৯ আগস্ট রোম থেকে এথেন্সের উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা একটি বিমান হাইজ্যাকের মাধ্যমে। লায়লা দাবি করেন, হাইজ্যাকিংয়ের সময়ে কোনো যাত্রী আহত বা নিহত হননি। এ হাইজ্যাকিংয়ের সময় তার একটি ছবি তোলা হয়। যেখানে তিনি একে-৪৭ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। এ ছবিটি পরে হয়ে যায় ইতিহাস। এখনও পোস্টার হিসেবে বহু বিপ্লবীর অন্তরে সাহস জোগায় লায়লা।
সাহস ও চালাকী কোনোটাতেই পিছিয়ে ছিলেন না লায়লা খালেদ। প্লেন হাইজ্যাকিংয়ের ছবি বিশ্বমিডিয়ায় প্রকাশিত হওয়ার পরপরই তিনি নাক ও চিবুকে ৬টি প্লাস্টিক সার্জারি করেন। চেহারার ধরণ পাল্টে ফেলেন লায়লা।লায়লা সবসময়ই আরব-ইসরায়েলে শান্তি প্রক্রিয়ার ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন।
লায়লা মনে করতেন, বর্তমান সময়ে যে প্রক্রিয়ায় শান্তির কথা বলা হয়, তা মোটেও শান্তির পথ নয়। এ প্রক্রিয়া রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। যার মাধ্যমে ইসরায়েলের হাতেই সবধরনের তাস তুলে দেওয়া হয়েছে। বিপ্লবের অংশ হিসেবেই তিনি ফিলিস্তিন ন্যাশনাল কাউন্সিলের একজন সদস্য হিসেবে রাজনীতিতে যোগদান করেন। এতে করে বিশ্বের কাছে নিজের মনের কথা সোচ্চারভাবে যেন বলতে পারেন। ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের দাবিতে ফিলিস্তিনিদের জীবন রক্তক্ষয়ী লড়াই সংগ্রাম চলছে। এই রক্ত ঝরা লড়াই সংগ্রাম তাদের ভূখণ্ড স্বপ্নের স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে ধরা দেবে একদিন এই প্রত্যাশা।
লেখক: দপ্তর, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক, কবি নজরুল সরকারি কলেজ সাংবাদিক সমিতি
সারাবাংলা/এসবিডিই
বিমান হাইজ্যাকার লায়লা খালেদ ও ফিলিস্তিনিদের সংগ্রাম মুক্তমত শিতাংশু ভৌমিক অংকুর