কন্যা শিশু দিবস নিয়ে বিভ্রান্তি: গুরুত্ব হারাচ্ছে আসল দিবস
৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৪:০১
আজ শনিবার (৩০ সেপ্টেম্বর) জাতীয় কন্যা শিশু দিবস। এ বছর এই দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে “বিনিয়োগে অগ্রাধিকার- কন্যা শিশুর অধিকার।” মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ফরিদা পারভিন স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয় যে, প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও সারাদেশে অধিদপ্তরাধীন জেলা ও উপজেলা কার্যালয় সমূহ স্থানীয় প্রশাসনের সাথে সমন্বয় পূবর্ক এনজিও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহকে সাথে নিয়ে দিবসটির যথাযথভাবে উদযাপনে নানান কর্মসূচি পালন করবে।
কন্যা শিশু দিবস নিয়ে বিভ্রান্তি
আমাদের দেশে শিশুদের জন্য বেশ কয়েকটি দিবস উদ্যাপন করা হয়। শিশু বিষয়ে একাধিক দিবস থাকায় অনেকের কাছে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। যেমন আমাদের দেশে কন্যা শিশু দিবস মোট ৩ দিন বা ৩ বার উদ্যাপন করা হয়। তাই ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটি করে নিজের এবং অন্যদের সেই বিভ্রান্তি দূর করার চেষ্টা থেকে এই লেখা। চলুন দিবসগুলো সম্পর্কে সংক্ষেপে জেনে নেই।
জাতীয় কন্যা শিশু দিবস
কন্যা শিশুর প্রতি জেন্ডারভিত্তিক বৈষম্য রোধ, তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সুষ্ঠু বিকাশের বিষয়টিকে বৃহত্তর সামাজিক আন্দোলনে রূপ দেওয়ার লক্ষ্যে ২০০০ সালে তৎকালীন সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় একটি সরকারি আদেশের মাধ্যমে ৩০ সেপ্টেম্বরকে “জাতীয় কন্যা শিশু দিবস” হিসেবে পালনের ঘোষণা দেন। তখন থেকেই প্রতিবছর যথাযোগ্য মর্যাদায় সারাদেশব্যাপী দিবসটি পালিত হচ্ছে। প্রতি বছর এর একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। যেমন ‘শিক্ষা-পুষ্টি নিশ্চিত করি, শিশু বিয়ে বন্ধ করি’ ‘কন্যা শিশুর অগ্রযাত্রা, দেশের জন্য নতুন মাত্রা’ ‘আমরা সবাই সোচ্চার, বিশ্ব হবে সমতার’, ‘বিনিয়োগে অগ্রাধিকার-কন্যা শিশুর অধিকার’। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিবছর দেশব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দিবসটি উদ্যাপন করে।
বিশ্ব শিশু দিবস, শিশু অধিকার সপ্তাহ ও কন্যা শিশু দিবস
শিশুদের বিভিন্ন মৌলিক অধিকার, সুরক্ষা এবং শিশুর উন্নয়ন ও বিকাশে সংশ্লিষ্ট সকলকে অধিকতর উদ্যোগী ও এই বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার প্রতিবছর অক্টোবর মাসের প্রথম সোমবার ‘বিশ্ব শিশু দিবস ও এর পরের ৭দিন জাতীয় শিশু অধিকার সপ্তাহ’ পালন করে থাকে। সপ্তাহ ব্যাপী আয়োজিত এই অনুষ্ঠানের একটি দিন বিশেষভাবে নির্ধারিত থাকে কন্যা শিশুদের জন্য। এ লক্ষ্যে জাতীয় শিশু অধিকার সপ্তাহের দ্বিতীয় দিনকে কন্যা শিশু দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সেই হিসেবে আগামী ৩ অক্টোবর শুরু হওয়ায় জাতীয় শিশু অধিকার সপ্তাহের দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ ৪ অক্টোবর বুধবার কন্যা শিশু দিবস হিসেবে পালন করা হবে।
আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবস
বাংলাদেশে জাতীয় কন্যা দিবস ছাড়াও জাতিসংঘের এক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিবছর ১১ অক্টোবর “আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবস” হিসেবে পালন করা হয়। মেয়েদের শিক্ষার অধিকার পুষ্টি সহায়তা ও ন্যায় অধিকার, চিকিৎসা সুবিধা ও বৈষম্য থেকে সুরক্ষা নারীর বিরুদ্ধে হিংসা ও বলপূর্বক বাল্যবিবাহ বন্ধে কার্যকর ভূমিকা পালনের উদ্দেশ্যে এই দিবসের সূচনা হয়। ২০১২ সালে সারা বিশ্বব্যাপী এ দিবসটি পালন করা শুরু হলেও বাংলাদেশে এর পরের বছর অর্থাৎ ২০১৩ সাল থেকে “বিশ্ব কন্যা শিশু দিবস” পালন করা হচ্ছে।
উল্লেখ্য যে শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সচেতনতা সৃষ্টির জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বছরের একাধিকবার বিভিন্ন নামে শিশু দিবস পালন করা হয়। এর পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশগুলো বিভিন্ন সময় নিজেদের মতো করে পালন করে জাতীয় শিশু দিবস। যেমন আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে ২৪ জানুয়ারি “জাতীয় কন্যা শিশু দিবস” উদ্যাপন করে থাকে। এর বাইরে ভারত জাতিসংঘ ঘোষিত ১১ অক্টোবর “আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবস”ও পালন করে থাকে।
বিভ্রান্তি যেভাবে তৈরি হলো?
বিগত কয়েক বছর পূর্বে ভারতে সেপ্টেম্বর মাসের শেষ নাগাদ “কন্যা দিবস” উদ্যাপন করতে দেখা যায়। ভারতীয়দের সাথে মিল রেখে আমাদের দেশেও ব্যক্তি পর্যায়ে (বিশেষত ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে) সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রবিবার কন্যা শিশু দিবস পালনের প্রচলন শুরু হয়। যা উপরে উল্লিখিত তিনটি দিবসের বাহিরে পালন করা হচ্ছে। কিন্তু দিবসটি মোটেও ভারত বা বাংলাদেশের “জাতীয়” বা জাতিসংঘ ঘোষিত “আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবস” নয়। এই দুই দেশেও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দুটি কন্যা শিশু দিবস উদ্যাপন করা হয়। তাই নতুনভাবে আরেকটি দিবস পালনের কোনো যৌক্তিকতা নেই বরং এটি উদ্যাপন এর ফলে আমাদের মূল দিবস দুটি তার গুরুত্ব হারাচ্ছে বলে আমি মনে করি।
কারা তৈরি করলো এই বিভ্রান্তি?
সেপ্টেম্বর মাসের শেষ রবিবার যে কন্যা দিবস উদ্যাপন করা হয় তা মূলত শুরু করে “আর্কিস লিমিটেড” নামে ভারতীয় শুভেচ্ছা কার্ড নির্মাণকারী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। তারা কন্যা শিশু সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে দিবসটি সৃষ্টি করেছে বলে দাবি করলেও এটি মূলত তাদের কার্ডের ব্যবসা বাড়াতে একটি প্রচারণা বলে অনেকে মনে করেন। ফলে দিবসটি ভারতে জাতীয় দিবসের মর্যাদা পায়নি। কিন্তু “আর্কিস লিমিটেড সুচতুর ভাবে “আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবস” দাবি করে। উল্লেখ্য জাতিসংঘ ঘোষিত “আন্তর্জাতিক কন্যা দিবস ১১ অক্টোবর, যা ২০১২ সাল থেকে উদ্যাপিত হচ্ছে এবং ভারত সরকার কর্তৃক ঘোষিত জাতীয় কন্যা দিবস ২৪ জানুয়ারি যা ২০০৮ সাল থেকে ভারতে উদ্যাপন হচ্ছে। বাংলাদেশে ২০০০ সাল থেকে ৩০ সেপ্টেম্বরকে “জাতীয় কন্যা শিশু দিবস” হিসেবে পালন করে। তাহলে আমাদের দেশে হঠাৎ করে সেপ্টেম্বও মাসের শেষ রবিবার কন্যা দিবস পালনের যৌক্তিকতা কোথায়?
সমস্যা কোথায়?
প্রতি বছরের এবছরও সেপ্টেম্বরের শেষ রবিবার (২২ সেপ্টেম্বর) অবাক হয়ে লক্ষ করলাম আমাদের কয়েকজন সংসদ সদস্য থেকে শুরু সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকতা, সরকারি বেসরকারি কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, রাজনীতিবিদসহ সাধারণ মানুষ সবাই ২২ সেপ্টেম্বর (শেষ রবিবার) কন্যা দিবস দাবি করে ফেসবুকে ছবি পোস্ট করেছে। অর্থাৎ সবাই একটি “ভুয়া কন্যা দিবস” পালন করেছে। কেউ একজন বলেছে আজ কন্যা দিবস অমনি গুজবে বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়েছে কন্যা দিবস পালনে। কেউ যাচাই করার প্রয়োজন মনে করলো না। অনেকটা চিলে কান নিয়েছের মত অবস্থা। আচ্ছা, কন্যা দিবস পালন না হয় ভালো কিছু। এমনিভাবে কত গুজবে গাঁ ভাসাই তার হিসেব আছে কি আমাদের কাছে। আমাদের এসব গুজবে “তুবা” মনি’রা মা হারায়। আমি কন্যা দিবস পালনের বিরোধী না, তবে ভুয়া কন্যা দিবস পালনের বিরোধী।
তাহলে সমাধান কী?
বিগত বছরগুলোতে এবং এই বছর ইন্টারনেটে অনেকগুলো সাইট ঘাঁটাঘাঁটি করে এসব তথ্য সংগ্রহ করেছি এবং সত্যতা নিশ্চিত করেছি। এগুলি জানার পরও কেউ যদি নিজের সন্তানের ছবি যে কোন দিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করতে চান; তা আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে সেখানে “জাতীয় কন্যা দিবস”, “আন্তর্জাতিক কন্যা দিবস” “বিশ্ব কন্যা শিশু দিবস” এই জাতীয় শব্দ উল্লেখ না করাই বাঞ্ছনীয়- এর ফলে বিভ্রান্তি তৈরি হয়। আমি গত কয়েক বছরও এই বিষয়ে একটি বিস্তারিত লেখা লেখা বা প্রচারণার করার চেষ্টা করছি। এই বছরও এরকম একটি লেখার প্রকাশের উদ্দেশ্য হলো গত কয়েক বছর যাবৎ এটা লক্ষ্য করছি যে, সরকারি কর্মসূচি ছাড়া আমরা নিজেদের কন্যা দিবসগুলোতে কোন ধরনের কর্মসূচির পালন করি না। এমনকি অনেকে জানেই না আমাদের দেশে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কন্যা শিশু দিবস কবে, কখন বা কীভাবে পালন করা হয়। এমনকি সোশ্যাল মিডিয়াতেও বিষয়টি নিয়ে কোনো পোস্ট করে না। কিন্তু ভিনদেশি একটি দিবসের দিবস উদযাপনে ব্যস্ত থাকে। এইভাবে ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবস নামে একটি দিবস আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। আর এই দিবসে গা ভাসিয়ে দিয়েছে আমাদের তরুণ সমাজ। ভালোবাসা শুধু প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, এর ব্যাপকতা অনেক, এটা আর তরুণ তরুণীদের বোঝানো যায় না।
উপসংহার
এ কথা অনস্বীকার্য যে, কন্যা-জায়া-জননীগণ অন্ধকারাচ্ছন্ন, কুসংস্কার, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ও ধর্মীয় আবরণে হাজার হাজার বছর ধরে যেরকম নির্যাতিত-নিপীড়িত হয়েছিল, অধিকার বঞ্চিত হয়েছিলো তা বর্তমান বিশ্বে অনেকটাই কমে এসেছে। অনেক ক্ষেত্রেই নারীরা নিজের অধিকার আদায়, গ্রহণযোগ্যতা ও সক্ষমতা প্রদর্শন করছে। তথাপি বিশ্ব বাস্তবতায় কন্যা শিশুর শারীরিক যত্ন, একটি নিরাপদ, সমতাভিত্তিক সমাজ ও তাদের প্রাপ্য ন্যায্য অধিকার সমূহ এখনো পুরোপুরি অর্জিত হয়নি। এখনো দেশে দেশে নানান স্থানে, নানান ভাবে মেয়ে শিশুদেরকে বঞ্চিত করা হয়। তাদের খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, পোষাক-পরিচ্ছেদসহ নানা মৌলিক চাহিদা থেকেই বঞ্চিত করা হয়। ক্ষেত্রবিশেষে কন্যাশিশু বঞ্চিত হয় তার নিজের ঘরে, নিজের বাবা-মা ও নিকট আত্মীয়দের কাছ থেকে। তাই কন্যা শিশুর জন্য একটি সমতাভিত্তিক নিরাপদ বিশ্ব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে জনসচেতনতার বিকল্প নেই। সুতরাং এসব দিবস পালনের পালনের গুরুত্ব কম নয়। আগামীর বিশ্ব হোক আমাদের কন্যাদের জন্য নিরাপদ। সকল শিশুদের জন্য অনেক অনেক শুভ কামনা রইল।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক, ঝিলমিল একাডেমি, সম্পাদক-কিচিরমিচির, ব্রাহ্মণবাড়িয়া
সারাবাংলা/এজেডএস