Tuesday 26 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ধ্বংসস্তুপের শ্মশানেই রচিত হোক সৃষ্টির অমর মহাকাব্য

এস. এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার
১ অক্টোবর ২০২৩ ১৭:১৮

বর্তমানের দাম্ভিক সাম্রাজ্যবাদের পুঁজিবাদী চরিত্র এতটাই স্বতন্ত্র যে, তাকে শুধুমাত্র মানুষের মধ্যে অজ্ঞতার দুর্বলতায় গড়ে ওঠা মৌলবাদী মানসিকতার সাথেই তুলনা করা যায়। ক্ষমতার মেরুকরণের প্রবনতার সাথে সাম্প্রদায়িকতার কিছু বৈশিষ্ট্যগত মিল সহজেই দৃশ্যমান। আবার শিক্ষার প্রয়োগের ক্ষেত্রে এরা সম্পূর্ণ বিপরীত। বস্তুগত উচ্চশিক্ষা অর্জন করে তার অপপ্রয়োগের মাধ্যম ক্ষমতা ও পুঁজির সম্প্রসারণে জোরপূর্বক অন্যের স্বাধীনতা হরণ করা সাম্রাজ্যবাদের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য। কিন্তু প্রকৃত ধর্মশিক্ষার আলোয় নিজেকে আলোকিত না করেই ধর্মীয় অনুভূতির অপব্যবহার করে একটি সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলে নিজেদেরকে সমবেত করা এবং অজ্ঞানতার কারণে ধর্মের সাথে সংঘাতপূর্ণ কিছু বিধি-বিধানকে সামাজিক বা রাষ্ট্রীয়ভাবে সকল নাগরিকের উপরে ধর্মীয় বিধান হিসেবে চালিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা মৌলবাদীদের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য, যা ঘুরেফিরে জোরপূর্বক সাম্রাজ্যবাদীদের কায়দায় নিজেদেরকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করার একমাত্র লক্ষ্যকেই চিহ্নিত করে। সাম্রাজ্যবাদীরা মানবতার নামে কিছু লোকদেখানো কার্যক্রম গ্রহণ করে যেমন তাদের নিজেদের সকল অপকর্ম ঢাকতে চেষ্টা করে, তেমনি মৌলবাদীরাও ধর্মীয় কিছু নীতি-নৈতিকতাকে তাদের মূল লক্ষ্য হিসেবে চালিয়ে দেবার চেষ্টা করে থাকে, যাতে সমাজের বেশিরভাগ অশিক্ষিত ও সাধারণ মানুষ তাদের সাধুবাদ জানায়।

বিজ্ঞাপন

পুঁজিবাদভিত্তিক সাম্রাজ্যবাদ মানবজাতিকে যে মননে তাড়িত করে তথাকথিত উন্নত সভ্যতা গড়ে তুলেছে বলে বিশ্বাস করিয়েছে, তার অনিবার্য পরিণতি তাদেরকে লোভী, প্রতারক, ষড়যন্ত্রকারী, দখলবাজ ও মানবিক মূল্যবোধহীন অমানুষে পরিণত করছে নিশ্চিতভাবেই। আত্মরক্ষার নামে তারা এখনও ক্রমাগত ধ্বংসাত্মক অস্ত্রের প্রতিযোগীতা করতে স্বাচ্ছন্দবোধ করে। বিপরীতে মানবতার লক্ষে উন্নত মননের মানুষ গড়ার জন্য তারা প্রত্যক্ষভাবে নূন্যতম বিনিয়োগও করেনি। এমনকি পরম্পরার ধারাবাহিকতায় বলা যায় যে, মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন আদর্শ মানুষ গড়ে তোলার চেতনাজাত মনন তাদের মস্তিষ্ক থেকে চিরতরে বিস্মৃত হয়ে গেছে। অবশ্য জাতি হিসেবে তাদের পূর্বপুরুষদের মধ্যে এমন ধরনের চেতনা আদৌ ছিল কিনা, সেটিও গবেষণা ছাড়া বলা কঠিন। ফলে মানবতার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মানবজাতিকে ধ্বংস করা একদিকে যেমন তাদের কাছে নেশার মতো, অন্যদিকে এই বর্বরতাকে তারা পূর্বপুরুষের ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা বিবেচনা করে বিকৃত আনন্দ উপভোগ করে। তথাকথিত এই উন্নত বিশ্ব নিজেদের মধ্যে উন্মাদ ধ্বংসলীলায় মত্ত হয়ে পৃথিবীর একটি বড় অংশকে অচিরেই বিনাশ করবে─এমন আশংকা উড়িয়ে দেয়া যায় না কোনভাবেই।আর সেই প্রেক্ষাপটের বিশ্বসংকটে প্রয়োজন হবে মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন আদর্শ সৃষ্টিশীল মানুষদের, যা বাস্তবিক তাদের অবশিষ্ট জীবিত মানুষের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

বিজ্ঞাপন

করনীয় কী? কোথায় মুক্তি? কবিতার ভাষায় বলতে চাই-

‘তোমাদের পোড়ানো বারুদের গন্ধমাখা হাতে
আমি প্রানপনে ফুল ফুটিয়ে যাব,
তোমাদের জমানো চিতাভস্মের প্রলেপ
মাখিয়ে যাব প্রতিটি আহত গাছের শরীরে,
উন্মত্ত আগুনের লেলিহান শিখার উষ্ণতা
ছড়িয়ে দেব পৃথিবীর শীতলতম স্থানের মানুষের মাঝে
তোমাদের তৈরী করা বিনাশযজ্ঞে
আহুতি দেব সকল অকল্যাণ, অশুভ শক্তিকে
ধ্বংসস্তুপের শ্মশানে দাঁড়িয়ে
আমি রচনা করে যাব সৃষ্টির অমর মহাকাব্য।’

হ্যাঁ, যদি কেউ আগুন নিয়ে খেলতে থাকে, তাকে বুঝিয়ে বিরত করা না গেলে আমাদের উচিত হবে সেই আগুন নেভাতে জলের যোগান নিশ্চিত করা। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোকে তাই বারুদের প্রতি অগ্রসরতা পরিহার করে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় অংশগ্রহণের পরিবর্তে ভবিষ্যত পৃথিবীকে মানবিক বিশ্বে পরিণত করার প্রয়োজনে, প্রকৃত মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ গড়ে তোলার লক্ষ্যে এখনই সুপরিকল্পিতভাবে দ্রুততম সময়ের মধ্যেই কিছু দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সকল ধর্ম-বর্ণ, সংস্কৃতির মানুষকে নিজের সমমূল্যে মূল্যায়িত করে সাম্য, ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দের আবেশ মিশিয়ে অসাম্প্রদায়িক বিশ্ব গড়ে তোলাই হবে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রধান লক্ষ্য। সাম্রাজ্যবাদের আত্মঘাতী যুদ্ধে এই আগ্রাসী পুঁজিবাদীদের অনিবার্য পতনের পর সেই প্রকৃত আদর্শের মানুষেরাই নতুন বিশ্বব্যবস্থার উপযোগী মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে সক্ষম হবে।

সুতরাং, এখন থেকেই নিরলস প্রচেষ্টার মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পরিকল্পিত উপায়ে শিক্ষা, জ্ঞান ও সংস্কৃতির সঠিক বিনিয়োগ ও উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সাম্য, মানবতা ও ভাতৃত্ববোধের সমন্বয়ে একটি মানবিক প্রজন্ম সৃষ্টি করে যেতে হবে। যাদের স্মৃতির সাথে পরিচিত হবেনা ক্ষমতা, দম্ভ, অহংকার, অশুভ শক্তিমত্তা, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও পুঁজির অপব্যবহারের প্রবণতা। মৌলবাদী আগ্রাসন ও পুঁজিবাদী পেশীশক্তিকে চিরতরে কালের গর্ভে বিসর্জন দিতে হবে। মানুষের ডিএনএ থেকে সম্পূর্ণভাবে মুছে দিতে হবে মৌলবাদ ও পুঁজিবাদের অশুভ চিহ্ন।

নতুন করে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের যুদ্ধে প্রায় সমগ্র বিশ্ব যেভাবে নিজেদেরকে জড়িয়ে ফেলছে, তাতে তাদের প্রত্যেকের মননই আজ মৌলবাদী চরিত্র ধারণ করেছে। আর, সেই আগুনে ঘি ঢালছে পুঁজিবাদের পেশীশক্তি। সর্বগ্রাসী আত্মহননের এই প্রক্রিয়ায় দ্রুত ধ্বংস হচ্ছে একের পর এক জনপদ, নষ্ট হচ্ছে সমাজ ব্যবস্থা, এমনকি প্রাকৃতিক ভারসাম্য। পার্থিব প্রতিটি সম্পদের মালিকানা দখলের নেশায় জৈবিক পরিচয় ছাড়া মানুষ হিসেবে আর কোনো বৈশিষ্ট্য তাদের মধ্যে অবশিষ্ট নেই বর্তমানে। এই আগ্রাসনের শেষ কোথায়? কোন পরিণতির দিকে ধাবিত হচ্ছে সমগ্র বিশ্ব? পৃথিবীকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে তার একচ্ছত্র মালিকানা দিয়ে বিশেষ শুভ ফলাফলের স্বপ্ন দেখা তার শুধুমাত্র বদ্ধ উন্মাদেরাই দেখতে পারে।

মানবসভ্যতার এই সুনিশ্চিত বিলুপ্তি রোধ করতে পৃথিবীর যে সামান্য অবশিষ্ট অঞ্চল এখনো অস্ত্রের মহড়ার বাইরে, যেখানে বাতাস এখনো বারুদের গন্ধে দূষিত হয়নি, সেখানেই সাজিয়ে নিতে হবে একটি নিষ্পাপ, মূল্যবোধযুক্ত, শিল্পসমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সৃষ্টির বাতাবরণ। একমাত্র সাম্য ও মানবতাবোধের সমন্বিত শক্তিই পারে পৃথিবীকে নতুন করে বাসযোগ্য হিসেবে পুর্ননির্মাণের স্বপ্ন দেখাতে। তাই আর বিন্দুমাত্র কালক্ষেপণ না করে দেশ, ধর্ম, জাতিসত্ত্বা নির্বিশেষে পৃথিবীর অনুন্নত, স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের সকল মুক্তপ্রাণ, সাম্যবাদী, স্বপ্নবাজ মানুষদের একসাথে এগিয়ে আসতে হবে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, বুর্জোয়া পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে, সভ্যতার নামে আত্মহননের সকল অশুভ প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে। আমাদের নেতৃত্বেই ফিরে আসতে পারে একটি বাসযোগ্য মানবিক বিশ্ব।

লেখক: পুলিশ সুপার ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

সারাবাংলা/এজেডএস

এস. এম জাহাঙ্গীর আলম সরকার: এক শব্দসৈনিকের সৃষ্টির সাতকাহন ধ্বংসস্তুপের শ্মশানেই রচিত হোক সৃষ্টির অমর মহাকাব্য

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর