সুইডেনের বনভোজনে খাবারের মেনু ছিলো অমৃত লাউ খিচুড়ি
৪ অক্টোবর ২০২৩ ১৭:৫৫
মনে কি পড়ে বহু বছর আগের সেই ছড়া কবিতার কথা? নুরু, পুশি, আয়েশা, শফি সবাই এসেছে/আম বাগিচার তলায় যেন তারা হেসেছে। রাঁধুনীদের শখের রান্নার পরে গেছে ধুম, বৈশাখ মাসের এই দুপুরে নাইকো কারো ঘুম। বাপ-মা তাদের ঘুমিয়ে আছে এই সুবিধা পেয়ে, বনভোজনে মিলেছে আজ দুষ্টু কটি মেয়ে। বসে গেছে সবাই আজি বিপুল আয়োজনে, ব্যস্ত সবাই আজকে তারা ভোজের নিমন্ত্রণে। কেউবা বসে হলদি বাটে কেউবা রাঁধে ভাত, কেউবা বলে ধুত্তুরি ছাই পুড়েই গেলো হাত। বিনা আগুন দিয়েই তাদের হচ্ছে যদিও রাঁধা, তবু সবার দুই চোখেতে ধোঁয়া লেগেই কাঁদা। কোর্মা পোলাও কেউবা রাঁধে, কেউবা চাখে নুন, অকারণে বারে বারে হেসেই বা কেউ খুন। রান্না তাদের শেষ হলো যেই, গিন্নী হলো নুরু, এক লাইনে সবাই বসে করলে খাওয়া শুরু। ধুলোবালির কোর্মা-পোলাও আর সে কাঁদার পিঠে, মিছিমিছি খেয়ে সবাই, বলে- বেজায় মিঠে। এমন সময় হঠাৎ আমি যেই পরেছি এসে, পালিয়ে গেল দুষ্টুরা সব খিলখিলিয়ে হেসে।
আজও মনে পড়ে ছোটবেলার ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। শুধু যে ধুলোবালির কোর্মা-পোলাও রান্না করেছি তা নয়, বন্ধুরা মিলে সত্যিকার বনভোজন করেছি অনেকবার জীবনে। বাড়িতে মজার মজার খাবার খেয়েছি তারপরও রাতের আঁধারে বন্ধুরা মিলে হাঁস, মুরগী বা মোরগ রান্না করা নিরিবিলি জায়গায়, তারপর কলার পাতায় একত্রে বসে বন্ধুরা মিলে বনে বসে ভোজন করা ছিল সত্যিই মধুময় সময়।
প্রায় চল্লিশ বছর আগের দিনের স্মৃতিচারণে ফিরে এসেছি। তখন রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে বিভাগ-জেলা-মহকুমা এমনকি গ্রামগঞ্জ পর্যন্ত পিকনিকের প্রীতিপ্রদ উৎসব বেশ চালু ছিল। বনভোজনের ঋতু ছিল শীতের সময়। শীত ঠিকমতো না পড়তেই শুরু হয়ে যেতো বনভোজন। আমার জন্ম গ্রামে, গ্রাম ছেড়েছি ১৯৮৩-তে। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে দেখেছি শীত শুধু গ্রামবাংলার মানুষের প্রিয় ঋতুই নয়, উৎসবেরও ঋতু। ঘরে ঘরে নতুন গুড়ের পিঠা নানা নামের, নানান ধাঁচের। নতুন গুড়ের নাড়ু, পায়েস, খেজুরের রসের সঙ্গে ঘন দুধে ভেজানো ঢেঁকিছাঁটা চালের চিতই পিঠা। ময়রার দোকানে নতুন গুড়ের বাতাসা, কদমা, খোরমা ইত্যাদি ছিল প্রিয় খাবার। গ্রামের মানুষের পায়ে তখন জুতা-স্যান্ডেল ছিল না। কাঁপুনি শীতে খড় জ্বালিয়ে গোল হয়ে বসে আগুন পোহানোর মধ্য দিয়ে সময় কাটানো, মাঠ থেকে ছোলা গাছ পুড়িয়ে ছাই থেকে ছোলা কুড়িয়ে কুড়িয়ে খাওয়া বনভোজনেরই একটি অংশ ছিল তখন। ছোটবেলার সেসব কথা এখনোও মনে পড়ে।
আমি এখন বসত করি সুইডেনে। প্রশ্ন হতে পারে সুইডেনে কি এগুলো হয়? হয় মানে বেশি বেশি হয়। তবে কিছুটা ভিন্ন ধরনের বা ভিন্ন নামে। এখানে সুইডিশ ভাষায় যে শব্দটি বেশি ব্যবহার করা হয় তার নাম হচ্ছে সুইডিশ ফিকা। বন্ধু বান্ধবী মিলে কফিশপে বা পার্কে বসে আড্ডা মারাকে ফিকা বলা হয়। ইংরেজি ভাষায় ফিকা মানে পিকনিক। পিকনিক অর্থ হলো নিজ নিজ বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে গিয়ে পার্টিতে একত্রে ভোজন করা।
আমেরিকান বা ইংরেজরা এ কাজটি করে থাকে। তবে সুইডিশরা এটা সব সময় করে পার্কে বা জঙ্গলে। এরা বলে ‘উতে ফিকা’ বা বনভোজন। আমি সুইডেনে প্রায়ই বনেভোজন করি বিধায় বনভোজন শব্দটি বেশি ব্যবহার করি।
এই তো সেদিন গত ২৩ সেপ্টেম্বর আমার সুইডিশ গ্রামে বিশাল পার্টির আয়োজন করা হয়। মোটামুটি কনকনে শীত শুরু হয়েছে তবে পুরো আকাশ নীল, মেঘের কোনো বালাই নেই, সূর্য কিরণ দিচ্ছে। এ সময় সুইডেন সহ ইউরোপের অনেক দেশেই শরৎ পার্টির (Höst fest) আয়োজন করা হয়। এবারে আমাদের আয়োজন কিছুটা ভিন্ন ধরনের। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে শুরু করে স্থানীয় খবরের কাগজে, লোকের মুখে ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশের শাকসবজি দিয়ে নিরামিষ এবং অদ্ভুত এক বনভোজনের আয়োজন করা হয়েছে সুইডেনের শরতের এই প্রথম দিনে। সুইডেনের শরৎ নানা বর্ণের এবং নানা রংয়ের এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য ভরা, যার বর্ণনা শরৎ নিজেই, তারপর বেশ ঠান্ডা, এসময় যদি সূর্যের দেখা মেলে তবে পৃথিবীতে বেহেশতের দেখা মিলবে এ বিষয়ে সুইডিশ জাতির সন্দেহের কারণ নেই। এমন একটি দিনে যদি খাবারে অমৃতের স্পর্শ না থাকে তাহলে তো বেহেশতের পরিপূর্ণতা পাওয়া যাবে না।তারপর এ বনভোজন আর দশটা বনভোজনের মতো নয় এটা হতে হবে সেই আমার ছোটবেলার গোলাম মোস্তফার বনভোজনের মতো—জন, মারিয়া, মারিয়ানা, জোহানা, স্টেফান, সাকো, ফল্কে সবাই এসে জড় হয়েছে শরতের শিশির ভেজা সুইডিশ কৃষিক্ষেতে লাল শাক, কুমড়া, শসা, টমেটো, লাউ গাছের পাশে। সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে—একটি বাংলাদেশ, আমার জাগ্রত জনতার, সারা বিশ্বের বিস্ময়, তুমি আমার অহংকার।
আমাদের এই শরতের শখের রান্নায় বড় ধরনের ধুমধাম শুরু হয়ে গেছে। খিচুড়ির নাম শুনেছেন সবাই নিশ্চিত এবং জীবনে দু-একবার হলেও খেয়েছেন সবাই বিশেষ করে বাংলাদেশিরা, তবে ’অমৃত লাউ খিচুড়ি’ খেয়েছেন কি?
তাহলে আসুন জেনে নিই উপকরণগুলো; বাসমতি চাল, মুগ, মটর এবং মসুরের ডাল সাথে লাউ পাতা, কুমড়া পাতা, পুঁই শাক, লাল শাক, টমেটো, মিস্টি কুমড়া এবং লাউ।
মসলাপাতির মধ্যে খুব অল্প পরিমাণ মরিচ, পিয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ, ধুনিয়া, জিরা এবং পাঁচ ফোড়ন। লবণ, সরিষার তেল, একটু ঘি এবং শেষে একটু ধনিয়ার পাতা।
মজার ব্যাপার হলো যেসব উপকরণ রান্নায় ব্যবহার করেছি তার বেশির ভাগই আমাদের সুইডিশ কৃষিক্ষেতে উৎপাদিত। যেমন মরিচ, পিয়াজ, রসুন, মটর, টমেটো, লাল শাক, পুঁই শাক, হলুদ, সরিষার তেল, ঘি, ধনিয়া, কুমড়া, লাউ এবং তার পাতা।
এত সব চমৎকার শাকসবজি সব উপকরণের মিশ্রণের সমন্বয়ে তৈরি এই মজাদার ভেজিটেরিয়ান খাবারের নামকরণ করা হয়েছে ‘অমৃত লাউ খিচুড়ি’ যা এখন সুইডিশ খাবারের মেনুতে জায়গা করে নিয়েছে।
দিনটির শুরুতেই আমি সহ পুরো সহপার্টিরা নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। কাঠকয়লা দিয়ে রান্না বাংলাদেশের মতো পাখা দিয়ে বাতাস করা থেকে শুরু করে সত্যি সত্যি চোখ মোছা চলছে। পরে যখন রান্না শুরু হলো কেউ ব্যস্ত নাড়তে, কেউ ব্যস্ত ঝোল পরীক্ষা করতে, লবণ ঠিক হলো কিনা সেটা বার বার চেক করা হচ্ছে। কেউ ঘন ঘন নাড়ছে আর আমি চেয়ে চেয়ে দেখছি—মনে হচ্ছে এই তো সেদিন কতবার এমনটি করেছি বাংলার সেই গ্রামে, মাঠে, কখনও বাগানে।
মধুময় বনভোজনের মুহূর্তটি হঠাৎ ছোটবেলার অনেক স্মৃতি মনে করিয়ে মনটাকে বেশ দুর্বল করে দিলো। যাইহোক শুরুতে জেনেছিলাম তিনশো লোক হবে। পরে চারশো পঞ্চাশ জন সুইডিশ বনভোজনের এক মহোৎসব দেখতে এসেছে। সবাই এই অমৃত খাবার খাবে এবং যারা আসতে পারেনি তাদের জন্য একটু নিবে। কী বিপদ খাবার তো শেষের পথে!
এদিকে কথা দিয়েছি পার্টি চলবে সকাল এগারোটা থেকে বিকেল পাঁচটা অবধি। চারটে ত্রিশ যখন বেজেছে এমন সময় দুই জন এসে হাজির, কী ব্যাপার জিজ্ঞেস করলাম। উত্তরে বললো পথে শুনলাম এক মজাদার শরৎ পার্টি চলছে তাই এলাম। হবে কি একটু আমাদের ভাগ্যে? আমার সহধর্মিনী, মারিয়া সুইডিশে শুধু বললেন প্রাণ ভরে হবে কিনা জানিনে তবে যতটুকু আছে হাত দিয়ে চেটেচুটে খাও, এতো যে সে খাবার নয় ‘অমৃত লাউ খিচুড়ি’ আমি একথা শুনে অবাক হয়ে মারিয়ার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। আমার চোখেব় পলক দেখি পড়ে না। আমি তার রূপের ঝলক দেখে জ্ঞান হারানোর পথে। তার কাজল কালো নীল দু’টি চোখে পড়েছে আমার দুটি চোখ। চেয়ে দেখি সে তার সোনালী গোলাপ রাঙা ঠোঁটে এবং মুখে একটু মায়াবী মধুর হাসি দিয়ে আমাকে বলছে— চমৎকার হয়েছে সব কিছু।
লেখক: সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন থেকে
সারাবাংলা/এসবিডিই
মুক্তমত রহমান মৃধা সুইডেনের বনভোজনে খাবারের মেনু ছিলো অমৃত লাউ খিচুড়ি