ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে জরুরি উদ্যোগ প্রয়োজন
৪ অক্টোবর ২০২৩ ১৮:০১
প্রতিটি রাত পেরিয়ে সূর্যের আলোকরশ্মি পরার মধ্য দিয়ে শুরু হয় আরেকটি কর্মমুখর দিন। শুরু হয় নিরন্তর ছুটে চলা। আর ক্লান্ত হয়ে অবসর নেওয়া। প্রতিটি ক্ষেত্রে হাসি-কান্না, আনন্দ-বিষাদ, সুখ-দুঃখ নিয়ে মানুষের জীবন। জীবনের দিনগুলো পার করা৷ সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে মানুষের পথচলা। সে সময়গুলো অতিবাহিত পথ চলতে হয়। কিন্তু মানুষের আনন্দ-বিষাদের মধ্যে আরো বিষাদময় করে দিচ্ছে ডেঙ্গু। ডেঙ্গুর প্রার্দুভাবে মানুষের জীবন নিঃস্তব্ধতা বিরাজ করছে। এডিস মশাবাহী ডেঙ্গু রোগের পরিস্থিতি ভয়াবহতা ধারণ করেছে। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ছুটছেন এবং মারা যাচ্ছেন। হাসপাতালে প্রচুর ডেঙ্গু রোগী। প্রতিনিয়ত হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। নিজ চোখে না দেখলে বুঝা মুশকিল। কত শত শত রোগী প্রতিদিন ভর্তি হচ্ছে। হাসপাতালে টাসা ডেঙ্গু রোগী। প্রতি ওয়ার্ডে রোগীর ভিড় অনেক। স্বজনদের পাশাপাশি চিকিৎসকরা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন ডেঙ্গু রোগীদের সুস্হ করতে। রোগীর ভিড়ের মধ্যে অসহ্য গরমে অনেকেই মশারি ব্যবহার করছেন না। যারা হাসপাতালের মেঝে ও বারান্দায় চিকিৎসা নিচ্ছেন তারা কয়েল জালাচ্ছেন। অথচ ডেঙ্গু রোগীদের অবশ্যই মশারি ব্যবহার করতে বলেছেন স্বাস্থ্য বিভাগ। ডেঙ্গু দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শহর থেকে গ্রামাঞ্জলেও। হাসাপাতালে প্রতিদিন নানা বয়সি রোগী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হচ্ছেন। তাদের এবং তাদের পরিবারের কষ্টের শেষ নেই। এ দুঃখের কথা শুনবে কে? শুনার মতো কেউ কি আছে? যার ডেঙ্গু হচ্ছে বা যাদের পরিবারে ডেঙ্গুর প্রকোপ আরো বলতে গেলে যারা নিজের আপনজনদের হারিয়ে পেলছে ডেঙ্গুর কারণে তারাই জানে কষ্ট টা কি। আমরা সাধারণ জনসাধারণরা ভয়ে থাকলেও আমরা যাদের উপর ভরসা করে থাকি তারা কি উপলব্ধি করতে পারতেছে? তারা কি পদক্ষেপ নিচ্ছে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের! তারা সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিচ্ছে তো নাকি একে অপরের দোষ দিয়ে নিজেকে ঠিক রেখে ঘুমাচ্ছে? তারা কি দায় এড়াতে পারবে কেন পরিস্থিতি ভয়াবহ হচ্ছে?
প্রতিবছর আমাদের দেশের জনসংখ্যার একটি বিশাল সংখ্যা ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে এবং অনেকে মৃত্যুবরণ করছে৷ প্রতিনিয়ত মানুষের মাঝে বাড়ছে দুশ্চিন্তা। ডেঙ্গু থেকে বাঁচার জন্য যেমন সচেতনতা দরকার তেমনি অন্যকে সচেতন করা জরুরি। বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গু জ্বর শনাক্ত হয় ২০০০ সালে৷ সেই থেকে প্রতিবছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মারা যাচ্ছেন অনেকে। ২০১৯ সালে ডেঙ্গু জ্বরে সারাদেশে মারা যায় ১৭৯ জন। এরপরের বছর ২০২০ সালে ডেঙ্গুতে মারা যায় ৭ জন। তখন আবার করোনা ভাইরাস ছিল। করোনা ভাইরাস মহামারির মধ্যে ২০২১ সালে ডেঙ্গুতে মারা যায় ১০৫ জন। আর ২০২২ সালে মারা যায় ২৮১ জন। সর্বোচ্চ সংখ্যক ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছিল গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালে, মোট ৬১ হাজার রোগীর মধ্যে ২৮১ জন মানুষের মৃত্যু হয়। কিন্তু প্রতিবছর কে ছাড়িয়ে এবছর প্রতিদিন অনেক রোগী শনাক্ত হচ্ছে। মারাও যাচ্ছে। কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ ব্যর্থতার কারণে সে ফল ভোগ করতে হচ্ছে পুরো দেশবাসীকে। ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। শহর ছাড়িয়ে এখন গ্রামাঞ্চলেও ডেঙ্গু শনাক্ত হচ্ছে। প্রতিদিন ২ হাজারের বেশি রোগী ভর্তি হচ্ছে। ডেঙ্গুবাহিত এডিস মশার আক্রমণ বিস্তার প্রভাব ধারণ করছে৷ এ মশা নিয়ন্ত্রণের কোন কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিপুল অর্থ খরচ করার পরও কর্তৃপক্ষ এডিস মশার কাছে পরাজয় বরণ করতে হচ্ছে।
তথ্য সূত্রে দেখা গেছে- ২০০০ সাল থেকে শুরু করে ২০২২ সাল পর্যন্ত বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সর্বোচ্চ মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২৮১ জন। সেখানে তার বেশি চলতি বছরে আগস্টের মধ্যে তা পেরিয়ে মারা গেছে ৩৪২ জন। আর সেপ্টেম্বরে তা টপকে মারা গেছে ৩৯৬ জন। রেকর্ড ভেঙ্গে রেকর্ড করতেছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা। সেপ্টেম্বরের শেষ ১৫ দিনে ছাড়িয়ে গেছে আগস্ট মাসের ভয়াবহতাকে৷ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের তথ্য অনুযায়ী গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ঢাকায় সাতজন ও ঢাকার বাইরে ছয়জন মারা গেছেন। এ সময় ডেঙ্গু নিয়ে ২ হাজার ৭৯৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। গতকাল মৃত্যু ও আক্রান্তের খবর জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গতকাল দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরও ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছর দেশে ডেঙ্গুতে ১ হাজার ৩০ জনের মৃত্যু হলো। আর অক্টোবর মাসের প্রথম ৩ দিনেই এডিস মশাবাহিত রোগে মারা গেলেন ৪১ জন। এমন পরিস্থিতির ফলে ২০১৯ সালের আক্রান্ত এবং ২০২২ সালের মৃত্যুর রেকর্ড ছাড়িয়ে দ্বিগুণ হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন চিকিৎসক এবং বিশেষজ্ঞরা। চলতি বছরের শুরুতে কীটতত্ত্ববিদরা আশঙ্কা করেছিলেন যে, ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে পারে। তখন ডেঙ্গুর সংক্রমণ কম ছিল। কম থাকা অবস্হায় মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকর ভূমিকা না রাখার কারণে এখন উদ্বেগ হারে বাড়ছে ডেঙ্গুর সংক্রমণ এবং মৃত্যুহার। চলতি বছরে ডেঙ্গুতে মৃত্যুতে ব্রাজিলকে টপকে এখন শীর্ষস্হানে বাংলাদেশ। তা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে আরো পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ হবে৷ দরকার হলে ক্রাশ প্রোগ্রাম পরিচালনা করে উড়ন্ত মশাগুলোকে মেরে পেলতে হবে। তাহলে দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভবপর হবে।
ডেঙ্গু একটি মশাবাহিত রোগ। এডিস মশার কামড়ে এ রোগ হয়ে থাকে৷ ডেঙ্গু বিস্তারে ৯০-৯৫ শতাংশ ভূমিকা রাখে বলে প্রাথমিক ভাবে ধারণা করা হয়। এডিস মশা সাধারণত পরিষ্কারবদ্ধ পানিতে হয়। বৃষ্টির পানি জমে এমন স্হানে। বাসার ছাদে জমে থাকা পানিতে, গাছের টব, ফুলদানির টব, পরিত্যক্ত টায়ার, ডাবের খোসা, প্লাস্টিকের ড্রাম, পানির চৌবাচ্চা, খোলা একুরিয়াম, বাসার আশেপাশে ময়লা আর্বজনায় জমে থাকা পানি, জমে থাকা নালার পানি ইত্যাদি। এগুলোর বিষয়ে সবচেয়ে সতর্ক অবস্হানে থাকতে হবে৷ ডেঙ্গু জ্বর একবার হলে এটি থেকে সহজেই আরোগ্য লাভ করা সম্ভব হয়ে উঠে না। যার দারুণ নিজের এবং পরিবারের উপর মানসিক অশান্তি সৃষ্টি হয়। ডেঙ্গু জ্বর থেকে রক্ষা পেতে বাড়ির আশেপাশে সব জায়গায় পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। বাড়ির ছাদে বা বাড়ির সামনে বাগান পরিষ্কার রাখতে হবে৷ বাড়ির কোথাও যাতে পানি জমে না থাকে, সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে৷ প্রতিবেশিদের সতর্ক রাখতে হবে৷ বাড়ির আশেপাশে নালা, ম্যানহোল ঢেকে রাখতে হবে। সবসময় মশার ঔষুধ দিতে হবে৷ বর্তমানে নগরায়নের ফলে শহরের পাশাপাশি উপজেলা, পৌরসভা, ইউনিয়নে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। মূলত অপরিকল্পিত ভাবে নগরায়নের কারণে বাড়ছে ডেঙ্গু। সচেতনতায় পারে ডেঙ্গু প্রতিরোধ করতে। তাই সবাইকে নিজ অবস্হান থেকে, নিজ দায়িত্ববোধ থেকে সচেতন হতে হবে। বাড়ির মধ্যে শিশু থাকলে তাদের কে যত্ন করবেন সতর্ক অবস্থানে রাখবেন। বাসার মধ্যে মশারি টাকাবেন। ঘর থেকে বের হলে হাত, পায়ে কাপড় দেওয়ার চেষ্টা করবেন। ডেঙ্গু হলে আতঙ্কিত হবেন না। দুশ্চিন্তা করবেন না, ছোটাছুটি করবেন না। ডাক্তারের পরামর্শ নিন। এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ডেঙ্গু হয়। এডিস মশার কামড়ে ভাইরাস সংক্রমণের তিন থেকে পনেরো দিনের মধ্যে সাধারণত ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গগুলো দেখা দেয়। উপসর্গগুলির মাঝে রয়েছে জ্বর, জ্বর ১০২ ডিগ্রি থেকে ১০৫ ডিগ্রি পর্যন্ত হতে পারে, এছাড়াও মাথাব্যথা, বমি, পেশিতে ও গাঁটে ব্যথা এবং গাত্রচর্মে ফুসকুড়ি ইত্যাদি উপসর্গ রয়েছে। ডেঙ্গু হলে পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশ্রাম নিন, মাথায় পানি দিন এবং যথেষ্ট তরল খাবার খান। ডেঙ্গুর কোন ভ্যাকসিন নেই। গত ২ অক্টোবর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জরুরি ভিত্তিতে জাপানের ঔষুধ ও টিকা প্রস্তুতকারি কোম্পানি ফার্মাসিউটিক্যালসের ডেঙ্গু টিকা ‘কিউডেঙ্গা’ কে ব্যবহারের ছাড়পত্র দিয়েছে। টিকা বাজারে আসার আগে নিজেকে সচেতন হতে হবে৷ জ্বর হলে জ্বর কমার জন্য প্যারাসিটেমল খেতে পারেন। কিন্তু দোকান থেকে অ্যান্টোবায়োটিক কিনে খাবেন না, এতে ক্ষতি হতে পারে। তিনদিনের বেশি জ্বর থাকলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।
প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। এটি বাঁচার জন্য ভালো হয়। ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে হলে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা জরুরি। মশা নিধনে জনপ্রতিনিধি, সিটি কর্পোরেশন, বিভিন্ন সংস্হা সম্মিলিত ভাবে কাজ করতে হবে। প্রত্যেকেই নিজে বাঁচতে দেশের মানুষকে বাঁচাতে নিজ জায়গা থেকে এগিয়ে আসতে হবে। ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও নজরদারি বাড়াতে হবে৷ স্বাস্থ্যসেবায় সিন্ডিকেট ভাঙতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা। এতে করে সবার অংশগ্রহণে কমবে দুর্ভোগ। ব্যক্তিগত উদ্যোগের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবেশিকেও সচেতন রাখতে হবে। ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে নিজে সচেতন হোন, অন্যকেও সচেতন করুন। তাইলেই সম্ভব হবে ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পেতে।
লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম কলেজ
সারাবাংলা/এসবিডিই
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে জরুরি উদ্যোগ প্রয়োজন মুক্তমত রায়হান উদ্দিন