প্রফেসর অ্যানি ও আমাদের শিক্ষকেরা
৫ অক্টোবর ২০২৩ ১৫:১৬
নোবেল প্রাইজ নামক ভেরিফাইড পেজে অ্যানি এল’হুলিয়ারের ফোনে কথা বলার একটি ছবি পোস্ট দিয়ে বলা হয়েছে, একজন নিবেদিত প্রাণ শিক্ষকের গল্প! পদার্থবিজ্ঞানে ২০২৩ সালের নোবেল পুরস্কার পাওয়া অ্যানি এল’হুলিয়ারকে তার শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আলাদা করা যায়নি। যখন আমাদের নতুন পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ীকে কল দেয়া হয় তখন তিনি লুন্ড ইউনিভার্সিটিতে লেকচারে ব্যস্ত ছিলেন। পরবর্তীতে এক পর্যায়ে তিনি লক্ষ করেন তার ফোনে একাধিক মিস কল রয়েছে। অতঃপর ক্লাস বিরতিতে ফোন রিসিভ করেন তিনি। তবে পুরস্কারের খবরের পর, এল’হুলিয়ার পুনরায় তার শিক্ষার্থীদের কাছে ফিরে যান।
প্রফেসর অ্যানির প্রসঙ্গ টেনে বাংলাদেশের শিক্ষক সমাজের গুষ্ঠি উদ্ধার চলছে। কি অদ্ভুত আমরা! আমরা যখন কারো প্রশংসা করি তখন এতো বেশি আবেগঘন বক্তব্য দেই যে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি উপস্থাপিত খেতাবে লজ্জিত হোন। আবার যখন কারো সমালোচনা করি তখন এতো বেশি বিবেকহীন হই যে, তাহার গুষ্ঠি উদ্ধার করি। গণহারে আমাদের শিক্ষকদের মুখে চুনকালি মাখানো হচ্ছে। আচ্ছা, আমাদের শিক্ষকগণ কি এতোটাই নিচে নেমে গেছেন? আমাদের শিক্ষকগণ কি ক্লাসে বসে ফোনে প্রেমালাপে লিপ্ত থাকেন? আমাদের শিক্ষকগণ কি নূন্যতম অবদান রাখছেন না? আমাদের শিক্ষকদের সবাই কি রাজনৈতিক চাটুকার হয়ে গেছেন?
কখনোই না। ফুলের সুবাস থেকে ময়লার দুর্গন্ধ বেশি ছড়ায়। এটা স্বাভাবিক। আমাদের শিক্ষকদের বড় অংশই জ্ঞানে-গুণে বিজ্ঞ-অভিজ্ঞ, চারিত্র ও মাধুর্যতায় অনন্য। তবে কতিপয় শিক্ষক নামের তথাকথিত পেশাজীবীর কারণে মহান শিক্ষকদের অবদান চাপা পড়ে যাচ্ছে।
নোবেল কমিটির মুখপাত্র অ্যাডাম স্মিথ প্রফেসর অ্যান ল’হুইলারকে ফোন দিলে তিনি ক্লাসে থাকার দরুন ফোন রিসিভ করেন নাই। বিরতিতে ফোন রিসিভ করে ক্লাসের কথা বলে এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন। এটা সাধারণ একটা বিষয়। অনেকের ধারণা নোবেল কমিটির মুখপাত্রের ফোন কিভাবে উপেক্ষা করা যায়? এটা আমাদের জন্য অসাধারণ প্রশ্ন হলেও প্রফেসর অ্যানীদের জন্য খুব স্বাভাবিক। ভৌগোলিক ও পারিপার্শ্বিক কারণে প্রফেসর অ্যানীরা নোবেল কমিটির মুখপাত্র এমনকি চেয়ারম্যান বা জাতিসংঘ সদর দপ্তরের উর্ধ্বতন কর্তা ব্যাক্তিদের সহিত আলাপন মামুলি ব্যাপার। যার কারণে প্রফেসর অ্যানী নোবেল কমিটির মুখপাত্রের ফোন উপেক্ষা করা স্বাভাবিক ছিলো। নোবেল জয়ের সংবাদে আত্মহারা হওয়ার মত ব্যক্তিতো আর নোবেল পাবেন না। যিনি যোগ্যতায় বিশেষ কিছু অর্জন করেন তিনি তাতে আকাশে উড়েন না। বরং দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাসে আরো বলীয়ান হয়ে ওঠেন। যাহা প্রফেসর অ্যান এল’হুলিয়ারের হয়েছে।
প্রফেসর অ্যানী ক্লাসের বিরতিতে মোবাইল ফোন রিসিভ করেছেন। আমাদেরও এমন অনেক শিক্ষককে দেখেছি, যারা ক্লাসে ডুকেই মোবাইল বন্ধ করে দেন বা মোবাইল বন্ধ করে ক্লাসে প্রবেশ করেন। আবার অনেককেই ক্লাসে ফোন রিসিভ না করতে দেখেছি। কেউ কেউ আবার ফোন রিসিভ করলেও ক্লাসের কথা বলে কেটে দিতে দেখেছি। খুব কম শিক্ষক’ই দেখেছি যারা ক্লাসে বসে ব্যক্তিগত আলাপ করে থাকেন। মাস্টার্স প্রথম সেমিস্টারের কোনো এক ক্লাসে আমার জনৈক শিক্ষককে বারবার একটা ফোন কল এড়িয়ে যেতে দেখেছি। বারংবার কল আসায় বাধ্য হয়ে তিনি ফোন রিসিভ করে বললেন, “স্যার আমাকে মিনিট সময় দেন। আমি ক্লাসটা শেষ করে আসছি”। পরবর্তীতে জানতে পারলাম ভার্সিটির এক গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে যোগদানের জন্য প্রশাসনের কর্তা ব্যক্তি স্যারকে ফোন দিচ্ছিলেন। যেখানে কতিপয় শিক্ষক প্রশাসনের কর্তাদের তেল মারায় ব্যস্ত থাকেন। সেখানে যেসকল শিক্ষক ক্লাস ও কাজের ফলে কর্তাদের এড়িয়ে চলেন তারা প্রফেসর অ্যানী হতে কোনো অংশে কম নন।
প্রথা, সভ্যতা ও সংস্কৃতিগত ভাবে পশ্চিমা দেশ গুলোর শিক্ষার মান অনেক উন্নত। যাহা আমাদের প্রাচ্য দেশে, বিশেষত ভারতীয় উপমহাদেশে নেই বললেই চলে৷ এটা এক চিরন্তন সত্য কথা। কিন্তু আমাদের শিক্ষকদের বড় এক অংশ আছেন যারা নৈতিক মানে পশ্চিমাদের চেয়ে হাজার গুণে শ্রেষ্ঠ।
শিক্ষক পদে চাকুরী নিলেই শিক্ষক হওয়া যায় না। শিক্ষক হতে হলে জ্ঞানে, গুণে, কর্মে ও আচরণে উৎকর্ষতা থাকতে হয়। বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ তোফায়েল আহমেদ স্যার বলেছিলেন, যখন আমরা উদীয়মান রাজনীতিবিদ তখন আমরা বুদ্ধি-পরামর্শের জন্য প্রফেসরদের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতাম। অথচ বর্তমান সময়ে ঘুম থেকে জেগেই শুনি অমুক-তমুক প্রফেসর আমাদের সাক্ষাতের জন্য হাজির। বাংলাদেশের গত দুই দশকে সব গুলো ভার্সিটিতে প্রশাসন নিয়োগ হয়েছে দলীয়করণ ও চাটুকারিতার ভিত্তিতে। আওয়ামী লীগ আমলে প্রভাবটা বেশিই পড়েছে। যাহার ফলে আমাদের সময়কালের শিক্ষার্থীরা উচ্চ শিক্ষার স্বাদ হতে বঞ্চিত। বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে শিক্ষক নিয়োগেও একই কান্ড। দলীয়করণ ব্যাতিত খুব কম শিক্ষকই নিয়োগ পেয়েছেন।
আপনি আপনার ভার্সিটি ও বিভাগের দিকে তাকালেই দেখবেন, অর্থ ও দলবাজি করে যারা শিক্ষক হয়েছেন তাদের বড় অংশ পাঠদানে অযোগ্য ও অপদার্থ প্রকৃতির। তারা ক্লাসে বসে রাজনীতি করেন। হাম্বাতাম্বা নেতার পা চাটতে ক্লাস-পরিক্ষার রুম ছেড়ে দলীয় অফিসে ঘুরে বেড়ান। তাদের নিয়ে কিছু বলা যায় না। কিছু বললেই হুমকিধামকিসহ পরিক্ষার খাতা ও শিক্ষার্থী মূল্যায়নে অবমূল্যায়ন করা হয়। এতদ শিক্ষকনামের রাজনৈতিক গুন্ডাদের কারণে আমাদের সময় কালের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় গুলো থেকে সনদ নামক কাগজ ব্যতিত তেমন কিছু নিতে পারছেন না। যাহার ফলেই মূলত প্রফেসর অ্যানীর প্রসঙ্গ টেনে বাংলাদেশের শিক্ষকদের জাত উদ্ধার করা হচ্ছে। কথিত পেশাজীবী শিক্ষকদের জাত উদ্ধারে আমার কোনো আপত্তি নেই বরং অথর্ব শিক্ষক রোস্টিংয়ে সমহারে ভালো লাগা আছে৷ কিন্তু কতিপয়ের অপকর্মের দরুন গণহারে শিক্ষকদের অবমূল্যায়ন করাতেই আমার আপত্তি। শিক্ষকদের সমালোচনা করতে গেলে নির্দিষ্ট বিষয় উল্লেখপূর্বক সমালোচনা করতে হবে। শিক্ষক শব্দ দ্বারা মূলত প্রফেসর অ্যানীদেরকেই বুঝায়। আর আমাদের দেশের যাদের জাত উদ্ধার করা হচ্ছে তারা আদতে শিক্ষক নন। কারণ শিক্ষক কখনো কুলাঙ্গার হয় না। দু’পাঁচটা কুলাঙ্গারের কারণে শিক্ষক শব্দ মেনশন দিয়ে গালি দেওয়া যায় না।
আমাদের ভাবতে হবে, প্রফেসর অ্যানীর উৎকর্ষতা ও আমাদের পাঁঠারূপ বলদদের বলদামি বুঝার যে যোগ্যতা সেটা কিন্তু মহান শিক্ষকদের হাত দিয়েই শেখা। আমাদের যত জ্ঞানগত দক্ষতা তার সবটুকু অর্জন ঐ’শিক্ষকদের কারণেই। তাই শিক্ষক শব্দ দিয়ে সমালোচনা করা সমীচীন নয়। আপনি শিক্ষক শব্দের সাথে নেতার পা চেটে শিক্ষক, অর্থের বিনিময়ে শিক্ষক, বাপ-চাচার জোরে শিক্ষক, দলবাজি করে শিক্ষক, আঞ্চলিকতার বলয়ে শিক্ষক, এমন ভাবে উপস্থাপন করে সমালোচনা করতে পারেন। কিন্তু শুধু মাত্র ‘শিক্ষক’ শব্দ দিয়ে গণহারে সমালোচনা করবেন না। শিক্ষক মহান মানুষ। শিক্ষকতা এক মহান পেশা। শিক্ষকদের মহত্ত্ব বিবেচনা করেই শিক্ষক নামের হীন ব্যক্তিদের সমালোচনা করুন।
জগতের সকল মহান শিক্ষকদের প্রতি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পাশাপাশি পেশাজীবী শিক্ষকদের প্রতি একরাশ ঘৃণা।
লেখক: শিক্ষার্থী
সারাবাংলা/এসবিডিই
প্রফেসর অ্যানি ও আমাদের শিক্ষকেরা মুক্তমত মুহাম্মদ ইয়াসিন আরাফাত ত্বোহা